Ajker Patrika

ইয়াজিদের শাসনামলে ঘটেছিল যে ভয়াবহ তিন অপরাধ

হাফেজ মাওলানা আল আমিন সরকার
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ইসলামি ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেদনাবিধুর, হৃদয়বিদারক ও চিরন্তন শিক্ষা বহনকারী ঘটনা হলো কারবালা ট্র্যাজেডি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, হজরত ফাতেমা (রা.) ও আলী ইবনে আবু তালেব (রা.)-এর পুত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করে যে জীবনোৎসর্গ করেছেন, তা আজও কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে অমলিন অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।

কারবালা ইরাকের বাগদাদ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ময়দানের নাম। ৬১ হিজরির ১০ মহররম আশুরার দিন ফোরাত নদীর তীরে এই প্রান্তরে সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ৭২ জন শাহাদত বরণ করেন। তাঁর একমাত্র জীবিত পুত্র হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া কেউই সেদিন বাঁচতে পারেনি।

এই কারবালার যুদ্ধ কোনো আকস্মিক সংঘর্ষ নয়, বরং এটি ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের ফল। কারবালা যুদ্ধের অন্যতম কারণ হলো ইয়াজিদের অবৈধ মনোনয়ন। মহান সাহাবি হজরত মুআবিয়া (রা.) নিজের পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকার ঘোষণা করলে অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি এর বিরোধিতা করেন। এটি হজরত হাসান (রা.) ও মুআবিয়ার পূর্ব চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবেও বিবেচিত হয়। এর ফলে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ইয়াজিদের চরিত্র, জীবনাচার ও শাসননীতি ইসলামের মৌল নীতিমালার পরিপন্থী হওয়ায় ইমাম হুসাইন (রা.) তাঁর প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং খেলাফতের ন্যায়পরায়ণতা রক্ষায় তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। (তারিখে তাবারি: ৫ম খণ্ড)

ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, উমাইয়া শাসনের অধীনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছিল। তখন ইমাম হুসাইন (রা.) খেলাফতের পুনর্জীবন এবং নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের লক্ষ্যে মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। এর পেছনে ছিল কুফাবাসীর আহ্বান।

কারবালার ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা। কুফাবাসী ইয়াজিদের শাসনের বিরুদ্ধে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-কে নেতা হিসেবে আহ্বান জানায়। তবে পরে তারা ভীত হয়ে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। পথিমধ্যে ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনকে আটকে ফেলার নির্দেশ দেয়। কারবালা নামক স্থানে হুসাইনি কাফেলাকে অবরোধ করা হয়। তখন ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীকে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১. তাঁকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক। ২. সীমান্তে গিয়ে জীবন কাটাতে দেওয়া হোক। ৩. এ দুটোর একটিও না হলে ইয়াজিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ দেওয়া হোক। কিন্তু নিষ্ঠুর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান থেকে এক চুলও সরে আসেনি।

ঐতিহাসিকেরা লেখেন, ১০ মহররম, ফজরের নামাজের পর ইয়াজিদের চার হাজার সৈন্য ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারকে পানি সরবরাহ বন্ধ রেখে ঘিরে ফেলে। এ দিন দুপুর পর্যন্ত এক অসম যুদ্ধ চলে। ইমাম হুসাইন (রা.) একে একে তাঁর পরিবার ও অনুচরদের শাহাদত প্রত্যক্ষ করেন। শেষে তিনি নিজেও শাহাদত বরণ করেন।

তাঁর শাহাদত এতটাই নির্মম ছিল যে, শরীরে ৩৩টি বর্শা, ৩৪টি তরবারির আঘাত এবং অসংখ্য তীরের ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায়। হত্যাকারী ছিল সিনান ইবনে আনাস নাখায়ি, এবং সহযোগী হিসেবে ছিল খাওলি ইবনে ইয়াজিদ। তাঁর মস্তক কেটে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে পাঠানো হয়। (কারবালার ইতিহাস, আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি)

ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদত ইয়াজিদের জন্য এক ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে। ইয়াজিদ ছিল ইসলামি ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত শাসকদের একজন। তাঁর তিন বছরের শাসনামলে তিনটি ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়। ১. ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদত। ২. মদিনায় লুট ও ধর্ষণ এবং মসজিদে নববীর অবমাননা। ৩. কাবা শরিফে আগুন লাগানো। এই অপরাধগুলোর কারণে ইসলামি ইতিহাসে ইয়াজিদের মৃত্যু রহস্যজনকভাবে ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কেউ বলেন, বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে, কেউ বলেন পানির পিপাসায় বা দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। সব মতেই এটি একটি করুণ ও অপমানজনক মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুআবিয়া মাত্র তিন মাসেই মৃত্যুবরণ করেন এবং উমাইয়া শাসনের এই অযাচিত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। (ইসলামি ঐতিহাসিক দলিল, তাবারি, ইবনে আসাকির, বদায়েউজ্জমান, ইবনে কাসির)

ইয়াজিদের ব্যাপারে জমহুর আহলে সুন্নতের মত হলো, ইয়াজিদ একজন ফাসেক শাসক ছিল। কেউ কেউ ফতোয়া দিয়েছেন, তাকে কাফের বলা যাবে না। আবার তার প্রশংসাও করা যাবে না। চুপ থাকাই উত্তম। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর বিপক্ষে গিয়ে ইয়াজিদ যে অন্যায় করেছে, তাতে সে চিরকাল ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পতিত থাকবে। (শরহুল আমালি, মোল্লা আলী কারি)

তবে তাফসিরে রুহুল মাআনিতে আল্লামা আলুসি এক দীর্ঘ আলোচনায় দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছেন, ইয়াজিদ নবীজির রিসালাতকে অস্বীকার করত এবং সে নিকৃষ্ট কাফেরদের একজন ছিলেন।

কারবালা কেবল এক ইতিহাস নয়, এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, সত্যের জন্য আত্মোৎসর্গের চিরন্তন দৃষ্টান্ত। ইমাম হুসাইন (রা.) আমাদের শিখিয়ে গেছেন, শক্তিশালী শাসক হলেও যদি সে অন্যায় করে, তবে তার সামনে মাথা নত নয় বরং সত্যের পথে দৃঢ় থাকতে হয়।

আর আশুরা মানেই কেবল শোক নয়, বরং চেতনার পুনর্জাগরণ। হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, আত্মত্যাগই প্রকৃত বিজয়। আমাদের উচিত তাঁর জীবন ও আদর্শ থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সত্য, ন্যায় ও ইসলামের মূল নীতিতে অবিচল থাকা।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, চরপাথালিয়া সালমান ফারসী (রা.) মাদরাসা, মুন্সিগঞ্জ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খানসামায় ১১ বছর আগের ঘটনায় সাবেক জামায়াত নেতার মামলা

‘স্ত্রী পরিচয়ে’ নারীর সঙ্গে রেস্ট হাউসে থানার ওসি, খবর পেয়ে ছাত্রদল নেতার হাঙ্গামা

হুসাইন (রা.)-এর হত্যার পেছনে দায়ীদের মৃত্যু হয়েছিল যেভাবে

বিশেষ ফ্লাইটে ২৫০ জনকে সীমান্তে এনেছে ভারত, পাঠাবে বাংলাদেশে

হানিমুন থেকে ফিরেই মার্কিন আটককেন্দ্রে ১৪০ দিন, রাষ্ট্রহীন এক তরুণীর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত