Ajker Patrika

পশ্চিম তীর দখলে মরিয়া ইসরায়েল, ১০ মাসে বাস্তুচ্যুত ৩২ হাজার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ১২
পশ্চিমতীরকে জেরুসালেম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ই–১ নামে একটি অবৈধ বসতি গড়ে তুলছে ইসরায়েল। ছবি: আনাদোলু এজেন্সি
পশ্চিমতীরকে জেরুসালেম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ই–১ নামে একটি অবৈধ বসতি গড়ে তুলছে ইসরায়েল। ছবি: আনাদোলু এজেন্সি

দখলকৃত গাজা উপত্যকার মতো পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলি নীতি হাজারো ফিলিস্তিনিকে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করছে। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকাশ্য অবজ্ঞা করেই এই কর্মকাণ্ড চলছে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার ফিলিস্তিনিকে বিভিন্ন শরণার্থীশিবির থেকে উৎখাত করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, চলতি বছর এখন পর্যন্ত, অর্থাৎ ১০ মাসের বেশি সময়ে মাত্র তিনটি শরণার্থীশিবির থেকে ৩২ হাজার ফিলিস্তিনিকে উৎখাত করা হয়েছে। জানুয়ারিতে শুরু হওয়া জেনিন, নুর শামস ও তুলকারেম শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি অভিযান ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীরে সবচেয়ে বড় গণবসতিচ্যুতির ঘটনা বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি।

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সহিংসতা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলিদের হাতে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। বেআইনি বসতিতে থাকা ইসরায়েলিরাও হামলা বাড়িয়ে তুলছে।

পশ্চিম তীরের ‘এরিয়া সি’ নামে পরিচিত এলাকায় ফিলিস্তিনি প্রশাসনের প্রতীকী নিয়ন্ত্রণও নেই, সেখানে জাতিসংঘের হিসাবে নভেম্বরের আগেই ইসরায়েলি ধ্বংসে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমেও আরও ৫০০ জন গৃহহীন হয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, এসব বাড়ি অনুমতি ছাড়া নির্মিত, কিন্তু এসব এলাকায় ফিলিস্তিনিদের জন্য নির্মাণের অনুমতি পাওয়া কার্যত অসম্ভব।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার তদন্তের আহ্বান জানালেও পশ্চিম তীরে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য ইসরায়েল খুব কমই জবাবদিহির মুখোমুখি হয়েছে। শরণার্থীশিবিরে অভিযানে ইসরায়েলি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা তদন্তের দাবি জোরালো হচ্ছে।

ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বেত্সেলেমের নির্বাহী পরিচালক ইউলি নোভাক বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের জীবন এখন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত। গাজায় যা হচ্ছে, তা দেখেই বোঝা যায় ইসরায়েল আরও ভয়াবহ সহিংসতার সক্ষমতা রাখে। পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইসরায়েলকে থামানোর অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো ব্যবস্থা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

পশ্চিম তীর নিয়ে ইসরায়েলের লক্ষ্য কী

ইসরায়েল সরকারের বহু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির বক্তব্য অনুযায়ী, লক্ষ্য হলো পশ্চিম তীরকে দখল করে নেওয়া। গত অক্টোবরে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট একটি প্রাথমিক খসড়া বিল পাস করে, যাতে পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বের আওতায় আনার প্রস্তাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে এটিকে গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়।

ইসরায়েলের কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ, যিনি নিজেও একটি অবৈধ বসতিতে থাকেন, বহুবার বলেছেন, পশ্চিম তীরকে তিনি ‘ইসরায়েলের অংশ’ করতে চান। ধর্মীয় জায়োনিস্ট পার্টির এক বৈঠকে স্মতরিচ বলেন, ‘জুডিয়া ও সামারিয়াকে (পশ্চিম তীর) রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা মাটিতে বাস্তবতা তৈরি করছি।’ ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ জানায়, তিনি আরও বলেন, ‘আমার জীবনের লক্ষ্যই হলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকানো।’

বর্তমানে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ৭ লাখের বেশি ইসরায়েলি অবৈধ বসতিতে বসবাস করছে। চলতি বছরের আগস্টে স্মতরিচ নতুন ‘ই–১’ বসতি প্রকল্প ঘোষণা করেন, যাতে ৩ হাজার নতুন ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে পূর্ব জেরুজালেমকে পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। স্মোত্রিচের ভাষায়, এটি ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকেই কবর দেবে।’

ইসরায়েল কেন এত ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করছে

ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম তীরের এলাকাগুলোতে কর্তৃপক্ষ সাধারণত পরিকল্পনা আইন ভঙ্গের অভিযোগ তোলে, অথবা দাবি করে যে—ফিলিস্তিনিরা ‘সামরিক এলাকা’য় বাড়ি নির্মাণ করেছে। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (ওসিএইচএ) জানায়, এসব এলাকায় ফিলিস্তিনিদের জন্য নির্মাণের অনুমতি পাওয়া ‘প্রায় অসম্ভব।’

জেনিন, নুর শামস ও তুলকারেম শিবিরে ইসরায়েল বলছে যে ‘অপারেশন আয়রন ওয়াল’ নামে অভিযান চালিয়ে তারা প্রতিরোধ শক্তি দমন করছে। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও বহু বাসিন্দা এখনো ঘরে ফিরতে পারছে না। বুলডোজার দিয়ে ব্যাপক ধ্বংস চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, এসব ধ্বংস ছিল ‘কার্যগত প্রয়োজনীয়তা।’ বাসিন্দাদের আপিলের সুযোগ দেওয়া হলেও সব আবেদনই ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে, এমনকি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগও।

এদিকে, ফিলিস্তিনিদের ওপর অবৈধ বসতিতে থাকা ইসরায়েলি বাসিন্দাদের হামলা বাড়ছে দ্রুত। অনেকের ধারণা, রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে বসতি স্থাপনকারীদের প্রভাব থাকায় তারা আরও উৎসাহিত। গত অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ওসিএইচএ রেকর্ড করে, এক মাসে ২৬০ টির বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে আটটি। ২০০৬ সালে সংস্থা তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর এটিই সর্বোচ্চ।

জলপাই তোলার মৌসুমে এসব হামলা আরও বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ইসরায়েলি সেনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও কিছু করে না। প্যালেস্টাইন ফার্মার্স ইউনিয়ন জানায়, সাম্প্রতিক হামলাগুলো ‘বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের গ্রামীণ জীবন ধ্বংসের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।’ ফিলিস্তিনিদের দাবি, এ সহিংসতা তাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে এবং শেষ পর্যন্ত ভূমি থেকে বিতাড়িত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...