Ajker Patrika

ইরানের চাবাহার বন্দরের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ছাড় প্রত্যাহার, নতুন সংকটে ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইরানের চাবাহার বন্দর। ছবি: এএফপি
ইরানের চাবাহার বন্দর। ছবি: এএফপি

ইরানের চাবাহার বন্দরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ছাড় প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এটি কার্যকর হবে। এর ফলে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য এ বন্দর আর ব্যবহার করতে পারবে না ভারত। সাত বছর ধরে এ বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারত যে সুবিধা পেয়ে আসছিল, তার অবসান ঘটছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ওই বিবৃতিতে ইরানের আর্থিক নেটওয়ার্কের ওপরও কিছু নতুন পদক্ষেপের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ২০১৮ সালে ইরানের স্বাধীনতা ও কাউন্টার-প্রলিফারেশন অ্যাক্টের (আইএফসিএ) অধীনে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ছাড়টি প্রত্যাহার করেছেন।

২০১৮ সালের ওই ছাড় চাবাহার বন্দর ব্যবহারে ভারতকে একটি আইনি সুরক্ষা দিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জানান, এই ছাড় প্রত্যাহারের অর্থ হলো—যে ব্যক্তি বা দেশ চাবাহার বন্দর পরিচালনা করবে বা আইএফসিএতে বর্ণিত অন্যান্য কার্যকলাপে জড়িত হবে, তারা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এদিকে মার্কিন ঘোষণার বিষয়ে ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই একটি প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডামের মাধ্যমে ওয়াশিংটন এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। এ প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডামে ইরানকে যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক বা আর্থিক সুবিধা দেওয়া ছাড়গুলো বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়, বিশেষত চাবাহার প্রকল্পের ছাড়গুলো।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের আগে ভারত চাবাহার বন্দরের প্রতি তাদের মনোযোগ আরও গভীর করে। ২০২৪ সালের মে মাসে বাইডেন প্রশাসনের মেয়াদের সময় ভারত সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড (আইপিজিএল) ১০ বছরের জন্য বন্দরটি পরিচালনা করার দায়িত্ব নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

ভারতের নৌপরিবহনমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এবং ইরানের সড়ক ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী মেহেরদাদ বাজরপাশ তেহরানে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। উভয় পক্ষই এটিকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করে। চুক্তিতে প্রাথমিক মেয়াদের পরে এর মেয়াদ বাড়ানোরও একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চুক্তি অনুসারে, আইপিজিএল বন্দর সরঞ্জামে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং ‘চাবাহার-সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নত করার লক্ষ্যে পারস্পরিকভাবে চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর’ জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন অফার করেছিল। ইরানের সড়ক ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী বাজরপাশ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা আশা করছেন—চাবাহার-জাহেদান রেলপথ বন্দরটিকে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের পাশাপাশি তুর্কমেনিস্তানের সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত করবে এবং শিগগির এর কাজ সম্পন্ন হবে।

এ চুক্তির সময় ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সাল থেকে চাবাহার বন্দর ৯০ হাজারেরও বেশি ২০ ফুট কনটেইনার এবং ৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন টনের বেশি বাল্ক ও সাধারণ কার্গো পরিচালনা করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই লিজ চুক্তিটি আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মাধ্যমেই চাবাহার বন্দর ব্যবহারে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা পাকিস্তানের স্থলপথের একটি বিকল্প ছিল। প্রকল্পটিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে ১৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের একটি কৌশলগত প্রতিপক্ষ হিসেবেও দেখা হতো।

চাবাহার বন্দরকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত রাখার ছাড়টি ২০১৮ সালের নভেম্বরে দেওয়া হয়েছিল। ওই বছর ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসে এবং এরপরই তেহরানের জ্বালানি ও আর্থিক খাতকে লক্ষ্য করে পুনরায় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। সে সময় চাবাহারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তখন ভারত ও আফগানিস্তান ওয়াশিংটনকে প্রকল্পটিকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখার জন্য চাপ দিয়েছিল।

তবে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় ফিরেই ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডামের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেয়, চাবাহার বন্দরের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়গুলো বাতিল করা হবে।

এদিকে এ পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় আমদানি করা পণ্যের ওপর বিশ্বের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে—যার অর্ধেক পারস্পরিক শুল্ক এবং বাকি অর্ধেক রাশিয়ার তেল কেনার জন্য জরিমানা হিসেবে।

এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান, তখন ভারত হতবাক হয়ে যায়। একজন পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের জন্য হোয়াইট হাউসে এটিই ছিল প্রথম আমন্ত্রণ। এ পদক্ষেপের পর দিল্লিতে এমন ধারণা তৈরি হয় যে, ইসলামাবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

তবে সেপ্টেম্বরের শুরুতে সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হওয়ার ইঙ্গিত মেলে। ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদিকে ‘বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ভারত–মার্কিন সম্পর্ক ‘বিশেষ’। জবাবে মোদি এক্সে লেখেন, এই অংশীদারত্ব ‘খুবই ইতিবাচক ও অগ্রগামী।’ এর ঠিক চার দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কয়েক মাস পর এটাই তাঁর প্রথম প্রকাশ্য স্বীকৃতি যে আলোচনাগুলো অব্যাহত রয়েছে। এর জবাবে মোদি লেখেন, তিনি শিগগির ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায় রয়েছেন এবং বিশ্বাস করেন, বাণিজ্য আলোচনা দুই দেশের অংশীদারত্বের ‘অসীম সম্ভাবনা উন্মোচনে পথ প্রশস্ত করবে’।

অবশেষে গত মঙ্গলবার মোদির ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে মধ্যরাতে দুই নেতা ফোনে কথা বলেন, যা জুনের পর তাঁদের প্রথম ফোনালাপ। তবে এই ফোনালাপে কেবল জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। আর সেদিনই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, চাবাহার বন্দরের নিষেধাজ্ঞা ছাড় প্রত্যাহার করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত