Ajker Patrika

বাউল গান ও মুসলিম মনে দ্বিধা

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
বাউল গান ও মুসলিম মনে দ্বিধা

সমাজে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, আবার মিলনের আকাঙ্ক্ষাও ছিল। তারই প্রকাশ দেখা গিয়েছিল বাউলগানে। বাউলগানে আমরা একটু থামব এই কারণে যে মানুষকে সম্মান করার ভিত্তিভূমি সেখানে পাওয়া যায়। যেকোনো ধর্মের মানুষই যে সম্মান পাওয়ার যোগ্য, সে কথা ছড়িয়ে আছে বাউল গানে, বাউল শরীরে, বাউল অন্তরে।

মন্দির আর মসজিদ পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করলে তা স্পর্শকাতর মানুষকে মর্মাহত করেছিল। কিন্তু সে সংঘাত চলমান থেকেছে এবং আজও তা আমাদের সমাজের শরীরে বিষফোড়া হিসেবে অবস্থান করছে। বাউলরা সেই ভেদাভেদ ভুলে যেতে বলে যাচ্ছেন কত দিন ধরে। বাউল কবি বলছেন, ‘তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে-মসজিদে/তোমার ডাক শুনি সাঁই চলতে না পাই/রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশেদে।’ ‘মনের মানুষ’ মানে পরমাত্মা, সে তো বাস করে মানুষেরই অন্তরে। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলনের পথটি তাই সহজ মানুষ খুঁজে পায়।

লালনের জানা গানগুলোর কয়েক চরণ উদ্ধৃত করলেই তা বোঝা যাবে: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারেতে?/লালন বলে, জাতের কি রূপ দেখলাম না দু চোখেতে।’ কিংবা ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী/কমনে আসে যায়/ধরতে পারলে মন বেড়িখান/দিতাম তাহার পায়।’

বাউল গান নিয়ে কথা বলতে গেলে স্মরণ নিতে হয় রবীন্দ্রনাথের। তিনি লিখলেন, ‘আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন।…বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনায় দেখি—এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েই, একত্র হয়েছে, অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।…এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান-পুরানে ঝগড়া বাধেনি।’ কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের বাউল গানের সংগ্রহ ‘হারামনি’র প্রথমভাগের ভূমিকায়।

দুই ধর্মের মিলনের এই চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। আজও আমাদের দেশে বাউল বিরোধিতা রয়েছে। আমাদের শিকড়ের সন্ধান করে না বলেই ধর্মান্ধরা বাউলদের অত্যাচার করে।

বাঙালি মুসলমান মধ্যযুগে বাংলাতেই লেখা শুরু করেছিল পুঁথি। সরল বাংলা আয়ত্ত করেছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু শুরুতে বাংলা ভাষা নিয়ে যে দ্বিধা-সংশয় ছিল তাদের মনে, সে কথাও এই আলোচনায় আসা দরকার। মনে করিয়ে দিই, আমরা যখন ভাষা আন্দোলনের ঘটনাগুলো বলব, তখন এই তথ্যগুলো আমাদের জানিয়ে দেবে, কেন মুসলমানের মনে বাংলা ভাষা নিয়ে দ্বিধা ছিল এবং কোন শক্তিতে সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠল তারা। জানিয়ে দেবে, বাঙালি মুসলমানদের অভিজাত শ্রেণির কাছে বাংলা কেন সমাদর পায়নি, কেন উর্দুর প্রতি ছিল তাদের ভালোবাসা।

সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা বাংলা নিয়ে বাঙালি মুসলমানের মনের সে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বলব। মুসলমান হিসেবে আরব-পারস্যের সঙ্গে একটি আন্তরিক যোগ অনুভব করেছে বাংলার বাঙালিরা। আবার এ দেশের অন্নে তারা লালিত হয়েছে। এই দুই ধারার দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ আরবি-ফারসি জানত না। তাদের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। ফলে বাংলার কবিরা বাংলায় লেখালেখি করার সময় কৈফিয়ত দিতে শুরু করলেন। কবি সৈয়দ সুলতান ‘ওফাতে রসুল’ বইয়ে লিখলেন, ‘বঙ্গদেশী সকলেরে কিরূপে বুঝাইব/বাখানি আরব ভাষা এ বুঝাইতে নারিব।/যারা যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন/সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।’

চট্টগ্রামের কবি বদিউদ্দিন ‘ছিফতে ঈমান’ নামের বইয়ে লিখলেন, ‘দিন ইসলামের কথা শুন দিয়া মন/দেশী ভাষে রচিলে বুঝিব সর্বজন।’

শাহ মুহাম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৪১০) লিখছেন: ‘নানা কাব্য-কথা-রসে মজে নরগণ/যার সেই শ্রদ্ধাএ সন্তোষ করে মন।/না লেখে কিতাব কথা মনে ভয় পায়/দুষিব সকল তাক ইহ না জুয়ায়।/গুনিয়া দেখিলুঁ আহ্মি ইহ ভয় মিছা/না হয় ভাষায় কিছু হএ কথা সাচা।’

এ থেকে বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষায় লেখালেখির ব্যাপারে মনের দ্বন্দ্বটা পরিষ্কার বোঝা যায়। এরপর ব্রিটিশ যুগে মুসলমান মন নিয়ে কিছু কথা বলে আমরা ঢুকে পড়ব দেশভাগের সময়টায়। তাহলেই বাংলা-উর্দুর সংঘাতটি উপলব্ধি করা যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত