Ajker Patrika

অবরোধে বিপন্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী

সঙ্গীতা ইমাম
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৮: ০৩
অবরোধে বিপন্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী

বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বড্ড বিপন্ন বোধ করছি। মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষক হয়ে বছরের প্রথম থেকে শুনেছি নির্বাচনের বছর হওয়ায় সিলেবাস ও পরীক্ষা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি বারবার সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সিলেবাস শেষ করতে হবে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার রুটিনও দেওয়া হয়েছে।

নতুন কারিকুলামে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির মূল্যায়নের নির্দেশাবলি চলে এসেছে মাউশি থেকে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রস্তুতিমূলক ও চূড়ান্ত মূল্যায়নের সময়সূচি দিয়েছে। সেই অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে বেশ আগে থেকেই। নতুন কারিকুলামটি অত্যন্ত সুন্দর, সময়োপযোগী শিক্ষার্থীবান্ধব, আনন্দময়, সৃষ্টিশীল শিক্ষাক্রম হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার কাছেই এটি এক নতুন অভিজ্ঞতা। সে কারণে খুব গুছিয়ে সময় নিয়ে বুঝে ও বুঝিয়ে মূল্যায়ন করা বাঞ্ছনীয়। নয়তো আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার করা হবে। এই শিক্ষাক্রমে শ্রেণি মূল্যায়ন রয়েছে। শিক্ষকেরা সারা বছর ধরে বই ও খাতায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক নানা কাজের ছক পূরণ, পোস্টার ও প্রেজেন্টেশন তৈরি, নানা ধরনের মেলা ও খেলাধুলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবহারিক কাজ করিয়ে মূল্যায়ন করেন। বাকি আছে সামষ্টিক মূল্যায়নের দুটি পর্ব—একটি প্রস্তুতিমূলক, আরেকটি চূড়ান্ত মূল্যায়ন।

প্রতি বিষয়ে দুদিন করে প্রস্তুতিমূলক মূল্যায়ন করানো হবে, যার প্রতি সেশনের সময় ৯০ মিনিট এবং চূড়ান্ত মূল্যায়ন প্রতি বিষয়ে একটি ৪ ঘণ্টার সেশন হবে। এই দুই মূল্যায়নে যা এবং যেভাবে কাজ করতে হবে তার সম্পূর্ণ নির্দেশনা ৬ নভেম্বর আমরা পেয়েছি। এখন বাকি আছে নির্দেশনার মধ্যে শিক্ষার্থীদের যে অংশটুকু, সেটুকু বুঝিয়ে দেওয়া।

২. বিএনপিসহ শরিক দলগুলোর টানা অবরোধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা তো শুরুই করা যাচ্ছে না অবরোধের কারণে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত। এ অবস্থায় অক্টোবর মাসের শেষ থেকে আন্দোলনের নামে হরতাল, অবরোধ, নাশকতা শুরু হলো দেশজুড়ে। এই অরাজক অবস্থায় মা-বাবারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন, বাজার-হাট সবই করছেন; কিন্তু সন্তানের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ যেভাবে গণপরিবহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে, তাতে কোনো অভিভাবকই সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সাহস পাবেন না। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষকেরা চাকরির দায়ে বিপদ মাথায় নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হচ্ছেন ঠিকই; কিন্তু পরীক্ষা নেওয়া তো দূরের কথা, সুন্দরভাবে মূল্যায়ন কার্যক্রমটি শ্রেণিকক্ষে বুঝিয়ে দেওয়ার সুযোগটি পাওয়া যাচ্ছে না।
চলমান অবরোধে কোনো অফিস-আদালত, কলকারখানা, বিয়ে, অনুষ্ঠান, বিদেশভ্রমণ, খাওয়া-দাওয়া, বাজার-হাট, কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধন, মেট্রোরেলের স্টেশন উদ্বোধন কিছুই বন্ধ করতে পারছেন না অবরোধ-হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলগুলো। তাহলে তাদের লক্ষ্য কী? কেবলই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন? করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে সদ্য স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। এখন এই অবরোধ তাদের আবারও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে ফেলতে যাচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর কোন রাজনৈতিক ফায়দা অর্জিত হচ্ছে, বুঝি না। আজকের শিক্ষার্থীরাই আমাদের আগামী, তাদের অন্ধকারে অনিশ্চয়তায় ফেলে কী করে সুন্দর সুখী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন এই সব রাজনীতিবিদ? নাকি তাঁরা বোঝেন শুধু নিজ স্বার্থ আর ক্ষমতা?

৩. গাজায় যেমন একটি প্রজন্মকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, আমরাও একটি প্রজন্মকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে হত্যাই তো করছি। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন আমাদের জীবন থেকে বহু সময় কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন। আমাদের এই সময়গুলো এখনো ‘এরশাদের ছুটি’ নামে কালো অধ্যায় হিসেবে অন্ধকার আর কষ্টে খোদাই করা আছে। জীবনের এই সময় হারিয়ে অনেকেই সরকারি চাকরির বয়স হারিয়েছেন। পিছিয়ে পড়েছেন নানাভাবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা কি আজকের হরতাল, অবরোধকারীদের সেভাবেই ধিক্কার দেবেন আজীবন? যে শিশুটি একটি বাসকে দাউ দাউ পুড়তে দেখছে, তার যে ট্রমা হচ্ছে, সে কী করে এ দৃশ্য মন থেকে মুছবে? শিশু মনোবিজ্ঞানীরা শিশুর সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলতে নিষেধ করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাসন নিষেধ, পারিবারিক সহিংসতা থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু আজ যে তারা পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করার দৃশ্য দেখছে! দাউ দাউ করে পুড়তে দেখছে যানবাহন, তখন কোথায় থাকছে শিশুর কোমল মনের প্রতি আমাদের যত্ন?

রাজনীতির কি কোনো সুস্থ ধারা আমরা কোনো দিনই প্রতিষ্ঠা করতে পারব না? রাজনীতি আপনারা করেন, সংবিধান মেনে ক্ষমতায় বসেন—কোনো সমস্যা নেই। 
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হরতাল, অবরোধ সহিংসতার বাইরে রাখেন। শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমনাগমন নিরাপদ করেন। শিক্ষার্থী যাতে তার প্রতিবছরের পাঠ সুচারুভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে, তা ক্ষমতাসীনসহ সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হোক। প্রজন্ম তৈরির কর্তব্যে আমরা সবাই আরেকটু সচেতন, দায়িত্বশীল ও মনোযোগী হব—এই প্রত্যাশা সবার কাছে।

লেখক: শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শিক্ষার্থীদের ‘কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে’ সপরিবার পালিয়েছেন বিএসবির বাশার

পাবনায় বজ্রপাতে ফেটে চিরে গেল মেহগনিগাছ

ঈদুল আজহার ছুটি ১০ দিন

এনসিপি নেতা সারওয়ার তুষারের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি: শহিদুল আলম

পাকিস্তানে হামলায় ‘লোইটারিং মিউনিশনস’ ব্যবহারের দাবি ভারতের, এটি কীভাবে কাজ করে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত