Ajker Patrika

কৃষকের ঋণপ্রাপ্তি আরও সহজ হোক

শাইখ সিরাজ
কৃষকের ঋণপ্রাপ্তি আরও সহজ হোক

২০০৬ সাল থেকে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে প্রতিবছরই কৃষিঋণ নিয়ে কৃষকের দাবি উঠে আসছে। কৃষক সহজ শর্তে সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে চান। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তাঁকে সুদ দিতে হবে শতকরা ৪ থেকে ৮ টাকা। আর এনজিও থেকে ঋণ নিলে এর সুদের পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে শতকরা ২০ থেকে ২৫ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। আর মহাজনি ঋণের সুদ তো বিদ্যুতের গতিতে বাড়ে।

আমাদের কৃষকদের জন্য ঋণ পাওয়াটা একটা জটিল বিষয়। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা রয়েছে। সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের কৃষকেরা সাধারণত এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নেন। আর এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষি ব্যাংক থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়, তার সুদের হার ৯ শতাংশ (এখন আরও কম)। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে। ইফপ্রির সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে মোট ঋণের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ নেওয়া হয় এনজিও থেকে। যেখানে কৃষককে ঋণের বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের ওপর সুদ দিতে হয়।

ইফপ্রির মতে, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নেন ১৯ শতাংশ কৃষক। জমির মালিকের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ। মহাজন বা দাদন থেকে ১১ দশমিক ৪ এবং বিভিন্ন সমিতি থেকে আসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ। সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকে আসা ৬ শতাংশ ঋণের সবচেয়ে বেশি অংশ পান বড় চাষিরা, প্রায় ১৫ শতাংশ। বড়, মাঝারি ও ছোট চাষি মিলে মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ পান। আর প্রান্তিক চাষি পান ৫ শতাংশের মতো। বর্গাচাষি, অর্থাৎ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষ করেন—এমন কৃষকেরা এই ঋণ পান না। ফলে তাঁদের এনজিওসহ অন্য উৎসের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়।

অথচ প্রকৃত কৃষক কখনো ঋণখেলাপি হন না—এর প্রমাণ আমরা সব সময়ই পেয়ে এসেছি; বিশেষ করে করোনার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিসংখ্যান তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর—এই ছয় মাসে ব্যাংকগুলো কৃষকদের ঋণ দিয়েছে ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। বিপরীতে একই সময়ে কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করেছে ১৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ছয় মাসে ব্যাংকগুলো বিতরণের তুলনায় ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি কৃষিঋণ আদায় করেছে; অর্থাৎ বলা যায়, মহামারিতে আমাদের কৃষকেরাই অর্থনীতির হাল ধরেছিলেন।

পাশাপাশি তাঁরা অন্যদের তুলনায় ব্যাংকের অর্থও বেশি পরিশোধ করেছেন। যদিও করোনার মাঝে কৃষকের ঋণের কিস্তি দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ শিথিলতা ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে ঋণের কিস্তি আদায়ে কৃষককে বাধ্য করার ব্যাপারটিতে ছিল নিষেধাজ্ঞা, তারপরও বেশির ভাগ কৃষক ব্যাংকের ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেছেন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৪ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। মহামারির মধ্যেও সে বছর কৃষি ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায় হয়েছে।

দেশের বহু ঋণদান প্রতিষ্ঠান ফুলেফেঁপে বড় হয়েছে। অথচ কৃষকের সে রকম কোনো পরিবর্তন হয় না। কৃষক ঋণের জালে আটকে যান। কখনো এনজিও, কখনো মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দীর্ঘ ঋণের বোঝা টানতে থাকেন। আমার ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের এক আসরে নাটোরে কৃষক রফিকুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কখনো কোনো রাজনীতিবিদকে তো দেখি 
নাই রাজনীতি করে নিঃস্ব হয়ে যেতে, সেটা সরকারি দলের হোক আর অন্য দলেরই হোক, কৃষক কেন কৃষি খেতি করে নিঃস্ব হয়, তার খোঁজখবর তো কেউ নেয় না। আপনারা তিল থেকে তাল হইছেন, শিল্পপতি হইছেন। আর আমাদের পুঁজি নাই, আমাদের বাজার নিয়ে কেউ ভাবে না, আমাদের কথা কেউ বলে না।’ এই ক্ষোভ শুধু রফিকুল ইসলামের নয়, প্রতিটি কৃষকের। মহাজন কিংবা মহাজনদের মতো যাঁরা কৃষকের দুরবস্থা পুঁজি করে নিজেদের ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন, তাঁরা কখনোই চান না মহাজনি দুষ্টচক্র থেকে কৃষক বের হয়ে যাক।

ফসলনির্ভর কৃষকের ঋণের বোঝা বাড়ে সাধারণত দুই কারণে। কৃষক ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। মৌসুমে সেই ফসলের দাম পান না। কিন্তু ওই সময়টাতে তাঁর টাকা বেশি প্রয়োজন। কারণ, সার-ওষুধের দোকানের বাকি মেটাতে হবে, মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে হবে এবং পরবর্তী ফসলের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হবে। তাই ওই সময়ে ফসলের দাম কম থাকা সত্ত্বেও সেই ফসল বিক্রি করে দেন। কম দামে ফসল বিক্রি করে দেনা শোধ করে, নতুন ফসল চাষে যেতে যেতে দেখা যায় তাঁর ঋণের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।

সেদিন কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, মৌসুমের শুরুতেই এক মাসের মধ্যে উদ্বৃত্ত ধানের ৫২ শতাংশ বিক্রি করে দিতে হয় কৃষককে। এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বিক্রি করতে হয় ২৫ শতাংশ ধান, দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ১৮ শতাংশ এবং চার মাস বা এর বেশি সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে হচ্ছে ৫ শতাংশ ধান। অথচ যদি ঋণ পরিশোধের জন্য তিন থেকে চারটা মাস সময় কৃষকের হাতে থাকত আর ফসল সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা থাকত, তাহলে কৃষক অনেক লাভবান থাকতে পারতেন।

শস্য গুদামজাত রেখে বিনিময়ে ঋণের একটি দারুণ প্রকল্প ছিল শগঋপ (শস্য গুদাম ঋণ প্রকল্প)। প্রজেক্টের মডেল অনুযায়ী কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসল গুদামে মজুত রেখে, সেই মজুতকৃত ফসলের ওপর ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারতেন। ঋণের টাকায় পরবর্তী চাষ কার্যক্রম পরিচালনা ও জীবন নির্বাহ করার সুযোগ পেতেন কৃষক। শস্যের বাজার দাম বেশি হলে গুদাম থেকে শস্য ছাড়িয়ে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতেন। এ প্রজেক্টটি বেশ কার্যকর ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সফল এই কার্যক্রম হঠাৎ করেই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে।

ঋণের ব্যাপারে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ভূমিহীন কৃষক ও বর্গাচাষিদের ঋণ নিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩ কোটি ৫৫ লাখ কৃষির খানার ১৯ শতাংশই বর্গাচাষি। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্গাচাষি পরিবারের সংখ্যা ৬৫ লাখের বেশি।

আবার সারা দেশে প্রায় ২৩ লাখ ২৩ হাজার ২৭০টি ভূমিহীন কৃষক পরিবার আছে। এসব পরিবার সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত, অন্যের জমি ভাড়া বা লিজ নিয়ে তাঁদের চাষ-আবাদ। সরকারের বিদ্যমান কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সে জন্য তাঁদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাঁদের জমি নেই, তাঁরাও এ ঋণ পাবেন, তবে সে ক্ষেত্রে কৃষক যাঁর জমি ভাড়া বা লিজ নিয়ে চাষ করেন, সেই ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন রকম।

করোনার কারণে সরকার যখন কৃষকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করল, শতকরা ৪ টাকা হার সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলল বাংলাদেশ ব্যাংক, তখন অসংখ্য বর্গাচাষি আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন তাঁদের ঋণ না পাওয়ার সমস্যা নিয়ে। বলছিলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে তাঁদের জমির মালিকের সঙ্গে চুক্তিপত্র দেখাতে হবে। এখানেও একটি সমস্যা আছে। বর্গাচাষি জমি লিজ বা বর্গা নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কোনো চুক্তিপত্র নেই। সাধারণত জমির মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দিতে চান না। কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে জমির মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ফি সরকারকে দিতে হয়। সেটি দিতে চান না বলে বেশির ভাগ জমির মালিক চুক্তিতে জমি বর্গা দেন না। ফলে চুক্তিপত্র না থাকার কারণে অনেক বর্গাচাষি প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

আমি মনে করি, কোনো রকম শর্ত ছাড়াই প্রকৃত কৃষক ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়ার অধিকার রাখেন। বিভিন্ন এনজিও বা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের বেড়াজালে কৃষককে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। যেখানে শিল্পোদ্যোক্তারা ঋণ পান ৯-১৫ শতাংশ হার সুদে, সেখানে ক্ষুদ্র কৃষককে ঋণ নিতে হয় ২০ শতাংশ হারের চেয়েও বেশি সুদে। ব্যাংক খাতে যে পরিমাণে ঋণখেলাপি, রাইট অফ, দুর্নীতি, অনিয়ম হয়, সেটা বিবেচনায় নিলে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার তাবৎ কৃষিঋণ সরকার চাইলে বিনা সুদে দিতেই পারে।

আমাদের কৃষি সম্প্রসারিত হচ্ছে শিল্পের দিকে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে বিভিন্ন পেশার মানুষ যুক্ত হচ্ছে কৃষিতে। শিল্পপতিরা কৃষিতে বিনিয়োগ করছেন। এই সময়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে হবে। না হলে কৃষি থেকে কৃষকই ছিটকে পড়বেন। বাড়বে বেকারত্বের সংখ্যা। ছোট্ট ও ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে সফল হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এর জন্য কৃষিঋণ সহজ ও সহজলভ্য করতে হবে।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত