Ajker Patrika

শব্দের আড়ালে গল্প: হালখাতা

রাজীব কুমার সাহা
শব্দের আড়ালে গল্প: হালখাতা

বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ‘হালখাতা’। বাঙালির নববর্ষ উদ্‌যাপনে শাশ্বত ঐতিহ্য হলো হালখাতা। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির এই সময়ে বিভিন্ন অ্যাপ ও অনলাইন শপিংয়ের কারণে হালখাতার সেই আগেকার দিনের জৌলুশ কমে এসেছে বটে, তবুও বাঙালি সংস্কৃতিতে নববর্ষের প্রথম দিনে হালখাতার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু হালখাতা কী? এটি কি বিশেষ ধরনের কোনো খাতা? কী করা হয় এ খাতায়? কবে থেকে প্রচলন হলো এই ঐতিহ্যবাহী প্রথার? তবে চলুন, আজ জানব হালখাতার হাল-হকিকত।

‘হাল’ এবং ‘খাতা’ শব্দসহযোগে গঠিত হয়েছে ‘হালখাতা’ শব্দটি। দুটোই আরবি শব্দ। হালখাতা বিশেষ্য পদ। হাল শব্দের অর্থ হলো নতুন। সাধারণভাবে হালখাতা হলো নববর্ষে নতুন হিসাব লেখার খাতা। নতুন খাতাটি সাধারণত লাল শালুতে মোড়ানো থাকে। হালখাতা হলো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচলিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। এ দিনটিতে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পুরোনো হিসাব হালনাগাদ করে নতুন হিসাব শুরু করেন। এ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান। হালখাতা মূলত একটি বাণিজ্যিক প্রথা হলেও কালের পরিক্রমায় এটি একটি সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ দিনটিতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার একটি সুযোগ তৈরি হয়।

বর্তমান সময়ে খাতায় হিসাব লেখার প্রবণতা কমে গেলেও ব্যবসায়ীরা কম্পিউটারের পাশে প্রতিবছর ঐতিহ্যের হালখাতাটি সংরক্ষণ করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নববর্ষের সকালে দোকানে দোকানে লক্ষ্মী-গণেশের পূজা করেন। পুজোয় সামনে রাখা হয় স্বস্তিক চিহ্নখচিত হালখাতা। সনাতন ধর্মে স্বস্তিক চিহ্ন বিশেষ মঙ্গলবার্তা বহন করে। তাই যেকোনো পুজো বা শুভ অনুষ্ঠানে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়। ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার পায়ে ঠেকিয়ে নতুন বছরের হিসাবের খাতা খোলা হয়।

কখনো কখনো পয়লা বৈশাখে নতুন খাতাটি নিয়ে মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়ে আসেন। পূজারিরা সিঁদুরের মধ্যে কাঁচা পয়সা ডুবিয়ে সেই পয়সা সিলমোহরের মতো ব্যবহার করে নতুন খাতায় ছাপ মেরে তা উদ্বোধন করতেন। পাশাপাশি দিয়ে দেন চন্দনের ফোঁটা। পয়সাকে লক্ষ্মী হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবসায় লাভবান হওয়ার আশায় এই আচার পালন করতেন তাঁরা। এর পাশাপাশি কোনো কোনো ব্যবসায়ী বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেও হালখাতা পালন করে থাকেন।

ইতিহাসের সূত্র ধরে জানা যায়, ১৫৫৬ সালে মোগল সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণের পর ভারতের বিভিন্ন সুবা বা প্রদেশের খাজনা আদায়ের দিন-তারিখের একটি অভিন্ন সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। তিনি লক্ষ করলেন চান্দ্র বছরের গণনানুযায়ী, সৌর বছরের সঙ্গে দিনের পার্থক্য অনেক। ফলে চান্দ্র বছরের রীতি অনুযায়ী বছরের রাজস্ব আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা সম্ভব ছিল না।

সেকালে ফসলে রাজস্ব আদায় করা হতো। কোনো কোনো বছর ফসল তোলার আগেই খাজনা দেওয়ার দিনটি এসে যেত। এতে করে প্রজারা খাজনা দিতে অসুবিধার সম্মুখীন হতো। সম্রাট আকবর প্রজা সাধারণের এই অসুবিধা দূর করার জন্য নতুন সন প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের সময় হিজরি সন ছিল ৯৬৩। তখন এ দেশে হিজরি সন প্রচলিত ছিল। আর এ বছর থেকেই তিনি হিজরি সনকেই সৌর সনে পরিবর্তিত করে বাংলা সন চালু করেন।

প্রথমে এই সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রান্তি) জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। এ সময় প্রতি চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এটিই কালের পরিক্রমায় ‘হালখাতা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

বাংলা নববর্ষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাসী এই হালখাতা অনুষ্ঠান। বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই হালখাতা। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালনে আড়ম্বরতায় ভাটা পড়লেও তা আপন ঐতিহ্যে টিকে থাকবে স্বমহিমায়। কেননা হালখাতা যে বাঙালি বনেদি ব্যবসায়ীদের শিকড়ের সঙ্গে গাঁথা।

লেখক: আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত