Ajker Patrika

পাবনায় নির্বাচন উৎসব নয়, আতঙ্ক

শাহীন রহমান, পাবনা 
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯: ২৯
পাবনায় নির্বাচন উৎসব নয়, আতঙ্ক

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন কেন্দ্র করে সংঘাত বেড়ে গেছে উত্তরের জেলা পাবনায়। নির্বাচনী সংঘাতে এরই মধ্যে চারজন নিহত হয়েছেন সেখানে। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় একজন ও চতুর্থ দফায় তিনজন মারা গেছেন। এ ছাড়া কমপক্ষে ১৫টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।

রাজনৈতিক আর আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে ইউপি নির্বাচনে সংঘাতের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন পাবনার আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, গণতন্ত্রের চর্চা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকার পাশাপাশি নৌকা প্রতীক আর মনোনয়ন বাণিজ্য সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়েছে নির্বাচনকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন তাঁরা। তবে পুলিশের দাবি, তারা সর্বোচ্চ নজরদারির সঙ্গে কাজ করছে। এর মধ্যেও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন কেন্দ্র করে পাবনার সুজানগর উপজেলার ভায়না ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গত ৯ নভেম্বর সবুজ হোসেন নামে একজন নিহত হন। নিহত সবুজ চলনা গ্রামের হাচেন আলীর ছেলে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুকের সমর্থক ছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে সংঘর্ষে ও হামলায় পাবনা সদর উপজেলায় দুজন এবং আটঘরিয়া উপজেলায় একজন মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে গত ১১ ডিসেম্বর সকালে পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আবু সাইদ খান ও তাঁর সমর্থকদের সংঘর্ষে মারা যান ওই ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামের মোজাম্মেল হক খানের ছেলে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াসিন আলম (৩৫)। গত ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একই উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের ভিডিও করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় ওই ইউনিয়নের আটঘরিয়াপাড়া গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে কলেজছাত্র নাছিম আহমেদ (১৭)। আর সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গণসংযোগে নৌকার সমর্থকদের মারপিটে সেলিম হোসেন (৩৫) নামে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। যদিও তাঁর মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।

ইউপি নির্বাচনে সংঘাত বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য প্রচার অভিযানের (সুপ্র) পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বলেন, ‘গণতন্ত্রের চর্চা নেই। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির চরম অভাব রয়েছে সর্বক্ষেত্রে। নির্বাচনে সব দলের সমান অধিকার নেই। যে কারণে অনেক রাজনৈতিক দলও ইউপি নির্বাচনে আসেনি। একই দলের মধ্যে ক্ষমতা দখলে নিতে তৃণমূলের রাজনীতিতে সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের ক্ষমতার রাজনীতির বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষও। এ থেকে পরিত্রাণ শিগগিরই হবে বলে মনে হয় না। কারণ, জেলার শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।’

নৌকা প্রতীক দেওয়া আর মনোনয়ন বাণিজ্যও সংঘাতের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পাবনা জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মতীন খান। তিনি বলেন, ‘যাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের। এঁদের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতার গোপন আঁতাত থাকে। নৌকা পেলে প্রকাশ্যে তাঁর পক্ষে কাজ করেন। বিদ্রোহী হলে গোপনে করেন। নৌকা প্রতীক দেওয়া আর মনোনয়ন বাণিজ্যও সংঘাতের অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। আর এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না। পুলিশের আরও তৎপর হওয়া উচিত।’

তবে সংঘাতের ঘটনায় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো গাফিলতি নেই বলে দাবি করেছেন পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মাসুদ আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা তো চাই না নির্বাচনী সহিংসতায় কারও মৃত্যু হোক। আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নজরদারির সঙ্গে কাজ করছি। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে আলাদা টিম করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সেই ইউনিয়নে ভোটের আগে থেকেই কাজ করছেন। এখন এর মাঝে কোনো জায়গায় হঠাৎ করেই সংঘর্ষ বা হত্যার ঘটনা ঘটলে সেটা কীভাবে প্রতিহত করা যাবে বলেন? আগে থেকেই তো আর সবকিছু জানা যায় না।’

স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে পাবনায় ইতিমধ্যে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটছে, এগুলো রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঘটনাগুলোই রাজনৈতিক রং দিয়ে একটি শ্রেণি ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। আমরা রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সোচ্চার ও সতর্ক রয়েছি।’

দলের কেউ যদি কথা না শুনে সংঘাতে জড়ায়, তাহলে নেতাদের কী করার আছে—এমন পাল্টা প্রশ্ন রেখে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল রহিম লাল বলেন, ‘আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কারণে ইউপি নির্বাচনে সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে। জেলার নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের কোনো অভাব নেই। আমরা বারবার সভা করেছি, চিঠি দিয়েছি। বিদ্রোহী হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা বিদ্রোহী হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় ও সাংগঠনিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত