Ajker Patrika

দূষণে মারা পড়ছে পাখি মাছ

রুদ্র রুহান, বরগুনা
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪: ৩২
দূষণে মারা পড়ছে পাখি মাছ

গত এক মাসে বঙ্গোপসাগরে জেলেদের জালে আটকে মারা পড়ছে বিলুপ্তপ্রায় ‘সেইলফিশ’। শুধুমাত্র আগস্ট মাসেই বঙ্গোপসাগরের মোহনা ও নদ-নদীতে দেড় হাজারেরও বেশি সেইলফিশ ধরা পড়ে। বঙ্গোপসাগরের গভীরে বসবাসকারী সেইলফিশের (পাখি মাছ) হঠাৎ মোহনায় বিচরণের প্রবণতাকে অস্বাভাবিক মনে করে বিষয়টি নিয়ে গবেষণারও তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ধারণা, দূষণের কারণে, খাদ্যসংকট ও বাস অনুপযোগী হওয়ায় এসব প্রাণী স্থানান্তর হতে বাধ্য হচ্ছে।

গত ২৫ জুলাই লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে মেঘনা নদীতে সাত ফুট লম্বা ও ২২ কেজি ওজনের একটি সেইলফিশ ধরা পড়ে। এরপর ২৯ জুলাই বরগুনার পাথরঘাটার জেলেদের জালে ধরা পড়ে আরও একটি সেইলফিশ। ১০ আগস্ট বরগুনার পাথরঘাটার আ. মন্নানের মালিকানাধীন এফবি মা-মণি ট্রলাররে জালে ধরা পড়ে বিরল প্রজাতির একটি সেইলফিশ। ১০ ফুট লম্বা ও দুই মণ ওজনরে মাছটি ৪ হাজার ২০০ টাকা মণ হিসেবে ৮ হাজার ৪০০ টাকায় কেনেন স্থানীয় পাইকার জাকির হোসেন। এরপর পুরো আগস্ট মাসের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ১৫টি করে সেইলফিশ আসে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে।

দেশ ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরি জানান, পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এ পর্যন্ত সাগরে ধরা পড়া তিন শতাধিক সেইলফিশ বিক্রি হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট পটুয়াখালীর মহিপুরের নুরুন্নবী নামে এক জেলের জালে ধরা পড়ে ৮টি সেইলফিশ। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মহিপুর মৎস্য বন্দরে ১৫টি সেইলফিশ নিয়ে আসে জেলেরা।

পটুয়াখালীর মহিপুর আলিপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দীন মোল্লা জানান, আগস্টের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি সেইলফিশ শিকার করে আলীপুর বন্দরে নিয়ে এসেছেন জেলেরা।

কক্সবাজার ফিশারিঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী জানান, আগস্টের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজার বিএফডিসি ঘাটে প্রায় ৬ শতাধিক সেইলফিশ বিক্রি হয়েছে। ভোলার খাল মৎস্য ঘাটের আড়তদার জাকির হোসেন জানান, গত ৩০ আগস্ট সাগরের মোহনায় জেলেদের জালে ১০টি মাছ ধরা পড়ে। পরে সেগুলো ঘাটে নিয়ে আসলে ২৫ হাজার টাকায় ডাকে বিক্রি হয়। এ ছাড়া পদ্মা-মেঘনাসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে বিচ্ছিন্নভাবে আরও বেশ কিছু সেইলফিশ ধরা পড়ার খবর জানান জেলেরা।

জেলেরা জানান, মৌসুমের শুরুতে ইলিশের দেখা না পেয়ে জেলেরা যখন হতাশ, তখনই এই সেইলফিশ তাদের জালে ধরা পড়ে। পরে এসব মাছ বন্দরে নিয়ে এসে মণ হিসেবে বিক্রি করে দেন। গোটা জীবন সাগরে মাছ শিকার করে কাটিয়েছেন বরগুনার পাথরঘাটা কালমেঘা এলাকার জেলে দুলাল। তিনি জানান, এই মাছ কালেভদ্রে গভীর সমুদ্রে আগে দুই-একটি জালে আটকে যেত। কিন্তু এবার সাগরের মোহনা থেকে শুরু করে নদীতেও এসব মাছ বিচরণ করতে এসে জেলেদের জালে ধরা পড়েছে। দুলাল বলেন, ‘যহন সাগরের গভীরে যাইতাম তহন মোগো জালে ভুল কইরা দুই একটা পাখি মাছ আটকাইয়া যাইত, এই বচ্ছর সাগরের মোহনায় অনেকে পাখিমাছ পাইছে।’

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রমহান জানান, সেইলফিশ এ দেশে ‘পাখি মাছ’ নামে বেশি পরিচিত। মাছটির পেছনে থাকা বিশালাকার পাখনাই স্থানীয়দের ‘পাখি মাছ’ নামকরণে উৎসাহিত করেছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই ধরনের মাছ পাওয়া যায়। নৌকার পালের মতো পৃষ্ঠীয় পাখনাটি দেখতে হয় বলে একে সেইল (পাল) ফিশ বলা হয়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০০০ সালে সেইলফিশকে লাল তালিকাভুক্ত করে। মূলত তীর থেকে সমুদ্রের ৫০ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যেই এদের বাস। এরা খুব গভীর জলের মাছ না হলেও ৯১৫ মিটার পানির নিচ পর্যন্ত চলাচল করে। মাঝে মাঝে তীরের কাছাকাছি এলেও কখনো এরা নদীতে প্রবেশ করে না।

গবেষকদের মতে, বসবাস ও বিচরণস্থলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণেই সেইলফিশ অন্যত্র ছুটতে শুরু করেছে। বিরল প্রজাতির এই মাঠ যে হারে জেলেদের জালে আটকে মারা পড়তে শুরু করেছে। এ কারণে শিগগিরই অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।

সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অবস্থা নিয়ে গবেষণা ও মৎস্য সম্পদ জরিপের সঙ্গে যুক্ত সমুদ্রবিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘সেইলফিশ যে পরিমাণে ধরা পড়তে শুরু করেছে, এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের। গালফ অব থাইল্যান্ড যেমন অনেকটা মৎস্যশূন্য হয়ে গেছে, তেমন আমাদের বে অব বেঙ্গল (বঙ্গোপসাগর) মৎস্যশূন্য হয়ে যাক তা আমরা চাই না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত