মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী
বাংলাদেশে এখন নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিলামে ওঠার বাতিক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাতে আদর্শের কোনো বালাই নেই। এককালের অনেক বাম বহু আগেই আদর্শ ত্যাগ করে বিএনপি, জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মন্ত্রী-এমপিও হয়েছিলেন।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টি একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন কমিশন এবং সরকার সম্পর্কে বেশ কিছু মন্তব্য করেছে, যা বিএনপি এবং বিএনপির মিত্রদলগুলোর বক্তব্যের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য নেই বলেই মনে হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের বলেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে প্রশাসন বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। তাই কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা আছে।’ মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সঙ্গে জি এম কাদেরের বক্তব্যের এখানে মিল খুঁজে পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জি এম কাদের আরও বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছে। ঔপনিবেশিক আমলে মানুষকে শোষণ করতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রশাসকদের জবাবদিহি থাকত শুধু সরকারের কাছে। কারণ, সাধারণ মানুষের কাছে প্রশাসকদের কোনো জবাবদিহি থাকে না। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সব ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, রাজনীতিবিদদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাই দেশের জনগণের কাছে কারও জবাবদিহি নেই।’ জি এম কাদের যেই পার্টির চেয়ারম্যান সেই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কি জাতীয় পার্টিকে ভিন্নধারার রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করেছিলেন? জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হয়ে তিনিও কি জাতীয় পার্টিকে সে ধরনের সংগঠনে রূপান্তরিত করার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? তেমন উদ্যোগ নিতে হলে তো দলের গঠনতন্ত্রেই পরিবর্তন আনতে হবে।
যে অর্থে জি এম কাদের বর্তমান সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার বলছেন, সে অর্থে সরকার তো জিয়াউর রহমানের শাসনকালে যেমন ছিল এরশাদের শাসনকালেও কম ছিল না। ১৯৮৬ ও ’৮৮ সালে এরশাদের অধীন নির্বাচন কেমন হয়েছিল, তা জি এম কাদেরের অজানা কিছু নয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে জাতীয় পার্টিকে কীভাবে পরিচালনা করেছিলেন, তা বিস্মৃত হওয়ার নয়। জাতীয় পার্টিও এরশাদের ব্যক্তিগত পার্টির অঙ্গন অতিক্রম করতে পারেনি। এই দলে একসময় বিএনপি, অতি ডান, অতি বাম এবং সুবিধাবাদী অনেকেই ক্ষমতার মধু উপভোগ করার জন্য জড়ো হয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানও বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগে আগ্রহীদের নিয়ে। তাতে স্বাধীনতাবিরোধী, অতি ডান, অতি বাম এবং সুবিধাবাদীরাই জড়ো হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের সঙ্গে ভেড়েন এবং জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করা হলে তাতে যোগ দেন। আদর্শগতভাবে জাতীয় পার্টি বিএনপির খুব বেশি দূরের নয়। বড় ভাই এবং ছোট ভাইয়ের মধ্যে যতটা মিল-অমিল থাকে, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যে আদর্শগত মিল ও অমিল হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। আদর্শগতভাবে উভয় দলই ডান চিন্তাধারার খুব কাছাকাছি। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিএনপিকে আদর্শগতভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ সামরিক ছাউনি থেকে এসে একই ধারায় ক্ষমতা দখল করেন, দলও একইভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দলের আদর্শে বিএনপির ছাপ স্পষ্ট। যদিও বিএনপি এরশাদ এবং তাঁর দলকে বিমাতাসুলভ দৃষ্টিতেই দেখেছে। এরশাদের দল এবং এরশাদের রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ তাদের মনেপ্রাণে কামনা হলেও বাস্তবে সেটি বেশ কঠিন ছিল।
১৯৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতন ঘটার পর বিএনপি ভেবেছিল সামরিক শাসক এরশাদের দল ও এরশাদের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না এবং সেই জায়গা তাদের কাছে চলে যাবে। কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনের ফল তাদেরও কিছুটা বিস্মিত করেছিল। অবশ্য বিএনপি তখন নির্বাচনে জয়লাভ করবে বা সরকার গঠন করবে—এটি তাদের কাছে অকল্পনীয় ছিল। ওই বিজয় তাদের সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল। বিএনপির গোপন আঁতাত ছিল জামায়াতের সঙ্গে। সেটির ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ায় বিএনপি এরশাদের প্রতি নির্দয় হয়ে উঠেছিল। এরশাদ তখন আওয়ামী লীগের সমর্থন কামনা করেছিলেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের জন্য বাম ছোট দলগুলোর সমর্থন পেয়েছিল। তারপরও জাতীয় পার্টি আগ বাড়িয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি উন্মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুবিধা পেয়েছিল, যা বিএনপির শাসনামলে এরশাদের ভাগ্যে জোটেনি। জাতীয় পার্টি ইনডেমনিটি বিল বাতিলে সমর্থন দিয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও গঙ্গা পানিচুক্তি স্বাক্ষরে বিরোধিতা করেনি এবং পক্ষেও জোরালোভাবে ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে এরশাদের সঙ্গে জামায়াত বিএনপির সখ্য বাড়তে থাকে। এই গোষ্ঠী এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে হাতে নিয়ে ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কুপোকাত করার পাশাপাশি দক্ষিণপন্থায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল।
১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে চারদলীয় জোট গঠনের মাধ্যমেই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। অবশ্য পরে এই জোট থেকে এরশাদ বের হয়ে আসতে বাধ্য হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে চরম ডানপন্থার দেশে পরিণত করে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকার দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার মিশন বাস্তবায়ন করতে থাকে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রাক্কালে রাজনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া ঘটে। তখন জাতীয় পার্টি এবং এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোটে যোগদান করেন। এরশাদ তখন বুঝতে পারেন বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই তিনি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের ভরাডুবি ঘটলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যজোটের সরকার গঠিত হয়। জি এম কাদের সেই সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় পার্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে নেপথ্যে সম্পর্ক রাখে। অথচ এই শক্তির উত্থানের পেছনে জামায়াত এবং বিএনপির সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা অঘোষিত ছিল না। জামায়াত-বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সমর্থন আদায় করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করে জামায়াত-বিএনপি এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্নিসংযোগসহ নির্বাচন বানচালে সব শক্তি প্রয়োগ করেছিল। জাতীয় পার্টি তখন বিরোধী দলের আসন লাভের পরিকল্পনা থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন লাভ করে সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও দলটি প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা এবং জি এম কাদের বিরোধীদলীয় উপনেতা হন। জি এম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টিতে এখন দুটি ধারা, কেউ কেউ বলেন তিনটি ধারা। তবে দলটি যে এখন নানা গৃহবিবাদে জড়িত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের জীবদ্দশাতেই দলে বিভাজনের অন্ত ছিল না। এরশাদের মৃত্যুর পর সেই বিবাদ এখন ভেতরে-ভেতরে বিসম্বাদে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় পার্টি এখন আর আগের পর্যায়ে নেই। এটি ছোট হতে হতে রংপুরেও এর ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়। এর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই দলের ভেতরে দুর্ভাবনার শেষ নেই। অনেকেই এত দিন পদ-পদবি, এমপি-মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেছেন। এরশাদের প্রথম জামানার নেতাদের তেমন কেউই এখন আর নেই। এখন জি এম কাদেরের জামানায় নতুন জেনারেশন। তাঁদের ভাবনাচিন্তা কতটা দলকেন্দ্রিক, কতটা এরশাদকেন্দ্রিক, কতটা রওশন এরশাদকেন্দ্রিক, কতটা জি এম কাদেরকেন্দ্রিক, তা বলা মুশকিল। সে কারণে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে তত দলের অভ্যন্তরে নেতাদের মধ্যে নানা রকম হিসাবনিকাশও বাড়ছে। রাজনীতির কোন মেরুতে গেলে নিজের সুবিধা ঠিক থাকবে, সেই হিসাবনিকাশ বাড়তে শুরু করেছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। মাঠে এখন রাজনৈতিক প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকার উৎখাতে মিত্র খুঁজছে। দু-একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাও চলছে।
প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যারা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবে, তারা ভবিষ্যতে জোট ক্ষমতায় গেলে সরকারের মন্ত্রী এবং পদ-পদবি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।
বাংলাদেশে এখন নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিলামে ওঠার বাতিক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাতে আদর্শের কোনো বালাই থাকে না। এককালের অনেক বাম নেতা বহু আগেই আদর্শ ত্যাগ করে বিএনপি, জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মন্ত্রী-এমপিও হয়েছিলেন। সাম্প্রতিককালের নির্বাচনগুলোতে নিলামে ওঠার জন্য অনেকেই মঞ্চ তৈরি করেছেন। জামায়াত-বিএনপির মঞ্চের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ আরও কেউ কেউ যোগ দিয়েছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে মঞ্চের সংখ্যা মনে হয় বাড়বে। কারণ, নিলামে ওঠার জন্য অনেকেরই আগ্রহ ভেতরে-ভেতরে বেড়েই চলছে। জি এম কাদের দর-কষাকষি নাকি দলের ভেতরের রেষারেষির হিসাবনিকাশ থেকে মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেটি বোঝা যাবে অল্প কিছুদিন পরেই।
মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
বাংলাদেশে এখন নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিলামে ওঠার বাতিক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাতে আদর্শের কোনো বালাই নেই। এককালের অনেক বাম বহু আগেই আদর্শ ত্যাগ করে বিএনপি, জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মন্ত্রী-এমপিও হয়েছিলেন।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টি একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন কমিশন এবং সরকার সম্পর্কে বেশ কিছু মন্তব্য করেছে, যা বিএনপি এবং বিএনপির মিত্রদলগুলোর বক্তব্যের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য নেই বলেই মনে হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের বলেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে প্রশাসন বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। তাই কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা আছে।’ মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সঙ্গে জি এম কাদেরের বক্তব্যের এখানে মিল খুঁজে পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জি এম কাদের আরও বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছে। ঔপনিবেশিক আমলে মানুষকে শোষণ করতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রশাসকদের জবাবদিহি থাকত শুধু সরকারের কাছে। কারণ, সাধারণ মানুষের কাছে প্রশাসকদের কোনো জবাবদিহি থাকে না। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সব ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, রাজনীতিবিদদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাই দেশের জনগণের কাছে কারও জবাবদিহি নেই।’ জি এম কাদের যেই পার্টির চেয়ারম্যান সেই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কি জাতীয় পার্টিকে ভিন্নধারার রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করেছিলেন? জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হয়ে তিনিও কি জাতীয় পার্টিকে সে ধরনের সংগঠনে রূপান্তরিত করার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? তেমন উদ্যোগ নিতে হলে তো দলের গঠনতন্ত্রেই পরিবর্তন আনতে হবে।
যে অর্থে জি এম কাদের বর্তমান সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার বলছেন, সে অর্থে সরকার তো জিয়াউর রহমানের শাসনকালে যেমন ছিল এরশাদের শাসনকালেও কম ছিল না। ১৯৮৬ ও ’৮৮ সালে এরশাদের অধীন নির্বাচন কেমন হয়েছিল, তা জি এম কাদেরের অজানা কিছু নয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে জাতীয় পার্টিকে কীভাবে পরিচালনা করেছিলেন, তা বিস্মৃত হওয়ার নয়। জাতীয় পার্টিও এরশাদের ব্যক্তিগত পার্টির অঙ্গন অতিক্রম করতে পারেনি। এই দলে একসময় বিএনপি, অতি ডান, অতি বাম এবং সুবিধাবাদী অনেকেই ক্ষমতার মধু উপভোগ করার জন্য জড়ো হয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানও বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগে আগ্রহীদের নিয়ে। তাতে স্বাধীনতাবিরোধী, অতি ডান, অতি বাম এবং সুবিধাবাদীরাই জড়ো হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের সঙ্গে ভেড়েন এবং জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করা হলে তাতে যোগ দেন। আদর্শগতভাবে জাতীয় পার্টি বিএনপির খুব বেশি দূরের নয়। বড় ভাই এবং ছোট ভাইয়ের মধ্যে যতটা মিল-অমিল থাকে, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যে আদর্শগত মিল ও অমিল হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। আদর্শগতভাবে উভয় দলই ডান চিন্তাধারার খুব কাছাকাছি। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিএনপিকে আদর্শগতভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ সামরিক ছাউনি থেকে এসে একই ধারায় ক্ষমতা দখল করেন, দলও একইভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দলের আদর্শে বিএনপির ছাপ স্পষ্ট। যদিও বিএনপি এরশাদ এবং তাঁর দলকে বিমাতাসুলভ দৃষ্টিতেই দেখেছে। এরশাদের দল এবং এরশাদের রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ তাদের মনেপ্রাণে কামনা হলেও বাস্তবে সেটি বেশ কঠিন ছিল।
১৯৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতন ঘটার পর বিএনপি ভেবেছিল সামরিক শাসক এরশাদের দল ও এরশাদের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না এবং সেই জায়গা তাদের কাছে চলে যাবে। কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনের ফল তাদেরও কিছুটা বিস্মিত করেছিল। অবশ্য বিএনপি তখন নির্বাচনে জয়লাভ করবে বা সরকার গঠন করবে—এটি তাদের কাছে অকল্পনীয় ছিল। ওই বিজয় তাদের সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল। বিএনপির গোপন আঁতাত ছিল জামায়াতের সঙ্গে। সেটির ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ায় বিএনপি এরশাদের প্রতি নির্দয় হয়ে উঠেছিল। এরশাদ তখন আওয়ামী লীগের সমর্থন কামনা করেছিলেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের জন্য বাম ছোট দলগুলোর সমর্থন পেয়েছিল। তারপরও জাতীয় পার্টি আগ বাড়িয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি উন্মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুবিধা পেয়েছিল, যা বিএনপির শাসনামলে এরশাদের ভাগ্যে জোটেনি। জাতীয় পার্টি ইনডেমনিটি বিল বাতিলে সমর্থন দিয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও গঙ্গা পানিচুক্তি স্বাক্ষরে বিরোধিতা করেনি এবং পক্ষেও জোরালোভাবে ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে এরশাদের সঙ্গে জামায়াত বিএনপির সখ্য বাড়তে থাকে। এই গোষ্ঠী এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে হাতে নিয়ে ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কুপোকাত করার পাশাপাশি দক্ষিণপন্থায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল।
১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে চারদলীয় জোট গঠনের মাধ্যমেই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। অবশ্য পরে এই জোট থেকে এরশাদ বের হয়ে আসতে বাধ্য হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে চরম ডানপন্থার দেশে পরিণত করে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকার দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার মিশন বাস্তবায়ন করতে থাকে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রাক্কালে রাজনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া ঘটে। তখন জাতীয় পার্টি এবং এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোটে যোগদান করেন। এরশাদ তখন বুঝতে পারেন বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই তিনি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের ভরাডুবি ঘটলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যজোটের সরকার গঠিত হয়। জি এম কাদের সেই সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় পার্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে নেপথ্যে সম্পর্ক রাখে। অথচ এই শক্তির উত্থানের পেছনে জামায়াত এবং বিএনপির সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা অঘোষিত ছিল না। জামায়াত-বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সমর্থন আদায় করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করে জামায়াত-বিএনপি এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্নিসংযোগসহ নির্বাচন বানচালে সব শক্তি প্রয়োগ করেছিল। জাতীয় পার্টি তখন বিরোধী দলের আসন লাভের পরিকল্পনা থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন লাভ করে সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও দলটি প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা এবং জি এম কাদের বিরোধীদলীয় উপনেতা হন। জি এম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টিতে এখন দুটি ধারা, কেউ কেউ বলেন তিনটি ধারা। তবে দলটি যে এখন নানা গৃহবিবাদে জড়িত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের জীবদ্দশাতেই দলে বিভাজনের অন্ত ছিল না। এরশাদের মৃত্যুর পর সেই বিবাদ এখন ভেতরে-ভেতরে বিসম্বাদে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় পার্টি এখন আর আগের পর্যায়ে নেই। এটি ছোট হতে হতে রংপুরেও এর ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়। এর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই দলের ভেতরে দুর্ভাবনার শেষ নেই। অনেকেই এত দিন পদ-পদবি, এমপি-মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেছেন। এরশাদের প্রথম জামানার নেতাদের তেমন কেউই এখন আর নেই। এখন জি এম কাদেরের জামানায় নতুন জেনারেশন। তাঁদের ভাবনাচিন্তা কতটা দলকেন্দ্রিক, কতটা এরশাদকেন্দ্রিক, কতটা রওশন এরশাদকেন্দ্রিক, কতটা জি এম কাদেরকেন্দ্রিক, তা বলা মুশকিল। সে কারণে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে তত দলের অভ্যন্তরে নেতাদের মধ্যে নানা রকম হিসাবনিকাশও বাড়ছে। রাজনীতির কোন মেরুতে গেলে নিজের সুবিধা ঠিক থাকবে, সেই হিসাবনিকাশ বাড়তে শুরু করেছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। মাঠে এখন রাজনৈতিক প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকার উৎখাতে মিত্র খুঁজছে। দু-একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাও চলছে।
প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যারা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবে, তারা ভবিষ্যতে জোট ক্ষমতায় গেলে সরকারের মন্ত্রী এবং পদ-পদবি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।
বাংলাদেশে এখন নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিলামে ওঠার বাতিক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাতে আদর্শের কোনো বালাই থাকে না। এককালের অনেক বাম নেতা বহু আগেই আদর্শ ত্যাগ করে বিএনপি, জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মন্ত্রী-এমপিও হয়েছিলেন। সাম্প্রতিককালের নির্বাচনগুলোতে নিলামে ওঠার জন্য অনেকেই মঞ্চ তৈরি করেছেন। জামায়াত-বিএনপির মঞ্চের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ আরও কেউ কেউ যোগ দিয়েছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে মঞ্চের সংখ্যা মনে হয় বাড়বে। কারণ, নিলামে ওঠার জন্য অনেকেরই আগ্রহ ভেতরে-ভেতরে বেড়েই চলছে। জি এম কাদের দর-কষাকষি নাকি দলের ভেতরের রেষারেষির হিসাবনিকাশ থেকে মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেটি বোঝা যাবে অল্প কিছুদিন পরেই।
মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫