Ajker Patrika

নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ কি সম্ভব

মৃত্যুঞ্জয় রায়
নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ কি সম্ভব

গত বছর ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। জলবায়ু গবেষকেরা বলেছেন, এ বছর উষ্ণতা আরও বেড়েছে। হয়তো আগামী বছর তা আরও বাড়বে। প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর তাপমাত্রা আর কত বাড়তে পারে? কতটুকু বাড়লে তা আমাদের সব সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাবে? উত্তরটা খুব সোজা। আমরা যতটা চাইব, পৃথিবীর তাপমাত্রা ততটাই বাড়বে। আসলে কি আমরা তা চাইছি? না চাইলেও আমরা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে চলেছি। আমরা যত বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছাড়ছি, তত বেশি পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। তাই সারা বিশ্বে এখন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন, অন্তত মুখে মুখে! কার্যত আমরা রোজ তা আমাদের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বাড়িয়েই চলেছি। জলবায়ু চিন্তকরা এ জন্য ভীষণ চিন্তিত হয়ে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাইছেন। কিন্তু আসলেই কি নিট-জিরো কার্বন নিঃসরণ সম্ভব?

বর্তমানে অনেক দেশেই নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এখন আর শুধু কার্বন নিঃসরণ কমালেই হবে না, তা নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে শূন্যের কোঠায়। না হলে খুব শিগগিরই আমরা ও আমাদের প্রিয় পৃথিবী এক মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। বিশ্বব্যাপী আজ আমরা আবহাওয়ার যেসব খামখেয়ালিপনা ও অস্বাভাবিক আচরণ দেখছি, তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। ধনী দেশগুলোও তাদের ধনসম্পদ দিয়ে সেসব বিপর্যয় ঠেকাতে পারছে না। ইউরোপের মতো দেশেও এখন বন্যা হচ্ছে। অনেক দেশই তাই এখন নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণের সংগ্রামে নেমেছে। নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ মানে এটা আসলে পরিবেশ থেকে যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন করছে, তারচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারণ করছে। এটা অনেকটা অঙ্কের হিসাবের মতো। কোনো দেশ যদি ১০ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করে, তবে সে দেশ এমন কিছু ব্যবস্থা নেবে যার ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে অন্তত ১০ মিলিয়ন টনের সমপরিমাণ কার্বন অপসারণ বা পরিশোষণ ঘটবে, কার্বনের হিসাবে যোগ-বিয়োগের ফলাফল থাকবে শূন্য। অর্থাৎ নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ হলো কোনো একটি স্থানের নির্দিষ্ট সময়ের এমন একটি অবস্থা যেখানে সে সময়ের মধ্যে সে স্থান থেকে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে নির্গত কার্বনের পরিমাণ ও সে স্থানে পরিশোষিত কার্বনের পরিমাণ হবে অন্তত সমান।

কীভাবে তা করা সম্ভব? পাহাড়ি ছোট্ট একটি দেশ ভুটান সেটি করে দেখিয়েছে। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ক্ষুদ্র সেই দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্বন নেতিবাচক হওয়ার প্রথম এবং একমাত্র দেশ হিসেবে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে খারাপ অবস্থায় থাকা চীন ও ভারতের মাঝখানে থেকেও ছোট্ট দেশটি এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার ফলে ওই দেশের নিট-কার্বন নিঃসরণ থাকছে শূন্য। আর এ পরিবর্তনের ফলে তারা দেশটির তাপমাত্রার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাবও লক্ষ করছে। সারা পৃথিবীতে জলবায়ু দুর্যোগ নেমে আসায় তার প্রভাব পড়ে ভুটানেও। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ায় হিমালয়ের চূড়ার বরফ গলে যায়। ফলে সে দেশে হিমবাহী নদীগুলোর তীর ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামগুলো। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের এরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ৭২ শতাংশ ভূমিকে বনভূমিতে রূপান্তর করেছে। সংবিধান সংশোধন করেছে যাতে সে দেশের বনাঞ্চল কখনোই ৬০ শতাংশের নিচে না আসে। এসব বনের গাছপালার কারণে দেশটি তাদের বায়ুমণ্ডল থেকে বছরে ৬ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিশোষণ করতে পারে, যা তাদের দেশের মোট নিঃসরিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি। তবে শুধু বনসৃজনই না, দেশটি কাঠ পোড়ানো নিরুৎসাহিত করতে চুলা জ্বালানোর জন্য বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, এলইডি লাইট ব্যবহার করে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোয় পরিবেশগত ভর্তুকি দেয়।

২০২৩ সালের নভেম্বরে পৃথিবীর ১৪৫টি দেশ নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে একমত হয় এবং ঘোষণা দেয় যে তারা তাদের দেশগুলোতে ২০৫০ সালের মধ্যে নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ নিশ্চিত করবে ও এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অন্তত তারা বিশ্বের ৯০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে সচেষ্ট থাকবে। ইতিমধ্যে ২৭টি দেশ এ বিষয়ে কিছু আইনি ও নীতিগত পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এতে সম্মত হয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, যারা কার্বন নিঃসরণ করছে সবচেয়ে বেশি। যোগ দিয়েছে ১ হাজার শহরের প্রায় ৯ হাজার কোম্পানি, ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৬০০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। জাতিসংঘ বলছে, যদি প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখতে হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।

যদি সত্যিই আমাদের নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ নিশ্চিত করতে হয়, তবে তার প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা। আমরা জানি, জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া এখন গাড়ি চলে না, কলকারখানার চাকা ঘোরে না, বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। তাই জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, কয়লা এমনকি কাঠ পোড়ানোর মতো ঘৃণ্য কাজগুলোকে কীভাবে আমরা সামলাব? এর বিকল্প কী? আমরা কি আমাদের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতে যেতে পারব? আমরা কি বর্জ্য থেকে মিথেন নিঃসরণ বন্ধ করতে পারব? আমরা কি গাড়ি চড়া বাদ দিয়ে সাইকেল চালাতে পারব অথবা বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করতে পারব? আমাদের ফসল উৎপাদনের খেতগুলো অথবা পাহাড়গুলোকে গাছ লাগিয়ে সবুজ করে দিতে পারব? যদি এসব করতে না পারি, তাহলে ২০১০-এর তুলনায় ২০৩০ সালে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ তথা কার্বন নিঃসরণ বাড়বে ৯ শতাংশ, শূন্যতে কী করে নামবে? এ জন্য আমাদের শুধু গালভরা বুলি, আলোচনা আর পরিকল্পনা করলেই চলবে না, নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণের জন্য দরকার একটি জুতসই বৈশ্বিক কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক।

ভুটান, কমোরোস, গ্যাবন, গায়ানা, মাদাগাস্কার, পানামা, সুরিনাম ইতিমধ্যে তাদের কার্বন নিঃসরণ নিট-শূন্যতে আনতে সক্ষম হয়েছে। তার পেছনে একটি কারণই প্রধান, তা হলো তারা তাদের বনাঞ্চল বৃদ্ধি করতে পেরেছে। আমরা দোষ না করলেও জলবায়ু-সাজা আমাদেরই বেশি পেতে হচ্ছে। তাই বৈশ্বিকভাবেই এর একটি সুরাহা হওয়া দরকার। দূষণ-দোষীদেরই এগিয়ে আসতে হবে আগে।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল চালুতে বাধা, রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে টানাপোড়েন

ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে এবি ব্যাংক

বৈপ্লবিক পরিবর্তন করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে

ব্যাংকের চাকরি যায় জাল সনদে, একই নথি দিয়ে বাগালেন স্কুল সভাপতির পদ

১ লাখ ৮২২ শিক্ষক নিয়োগ: যোগ্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা চলতি সপ্তাহে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত