Ajker Patrika

‘পেয়ারার সুবাস’ শুধু নয় লুপ্ত ব্রিজটির আরও কিছু

ইমন শিকদার
‘পেয়ারার সুবাস’ শুধু নয়  লুপ্ত ব্রিজটির আরও কিছু

লোকটি প্রতিবন্ধী ছিলেন। তাঁর নাম রহমান। স্থানীয়রা তাঁকে রহমান পাগল বলত। একাত্তরের ২৮ মার্চ মিরপুর বড় বাজারসংলগ্ন লোহার ব্রিজে এই রহমান পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ঘটনাটা দুপুরের দিকে ঘটে। এর দুই রাত আগে ঢাকায় ২৫ মার্চের রাতে বাঙালিদের ওপর শুরু হয়েছিল নারকীয় এক গণহত্যা। ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে শহরের এই প্রান্তে এসে পড়ে ঘাতক পাকিস্তানিরা। ২৮ মার্চ আমিনবাজার অভিমুখে মিরপুর লোহার ব্রিজের দিকে তারা পৌঁছে যায়। ব্রিজে ওই সময় প্রতিবন্ধী রহমান পা ছড়িয়ে বসে ছিলেন। সৈন্যদের ব্রিজে উঠতে দেখে হিজলার এপার থেকে পরিচিতরা রহমানকে বারবার নামতে ইশারা করে ব্যর্থ হন।

প্রতিবন্ধী রহমান ইশারার অর্থ না বোঝায় পাকিস্তানি সেনার লক্ষ্যভেদী গুলির শিকারে পরিণত হয়ে তুরাগের জলে লুটিয়ে পড়েন। কথাগুলো বলতে বলতে শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন হিজলা গ্রামের মো. আখিলউদ্দিন। তিনি জানান, রহমান ছিলেন তাঁদের হিজলা গ্রামের। অনাথ ছিলেন। সে জন্য গ্রামের সবাই তাঁকে আগলে রাখতেন। সেদিন তাঁদের বাড়িতে এসে রহমান তাঁর মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর মা একটু অপেক্ষা করতে বলায় তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লোহার ব্রিজের ওপরে উঠে যান। পাকিস্তানি সেনারা এ সময় ব্রিজে আক্রমণ শুরু করলে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা।

একাত্তরের মার্চ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাছবিচার করে গণহত্যা শুরু করেনি। অপারেশন সার্চলাইট-পরবর্তী সময়েও যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে, তাকে সেখানেই হত্যা করেছে। ২৮ মার্চ মিরপুর লোহার ব্রিজসংলগ্ন হিজলা গ্রামের প্রতিবন্ধী রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মিরপুর লোহার ব্রিজে গণহত্যার সূচনা করে এবং ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

এরপর পুরো মাসজুড়ে এই ব্রিজে সিরিজ গণহত্যা চলতে থাকে। বলা চলে, এই ব্রিজের প্রতি ইঞ্চিতে শহীদের রক্ত লেগে আছে। লাল ইট দিয়ে বানানো নয় স্তম্ভের এ ব্রিজটি ছিল একাত্তরে অসংখ্য বাঙালির মৃত্যুমঞ্চ। খরস্রোতা তুরাগ নদের ওপর স্থাপিত ব্রিজটি ছিল ঢাকার পশ্চিম প্রান্তের একমাত্র প্রবেশপথ। চার-পাঁচটি সামরিক ট্রাকে করে এই ব্রিজে চোখ-হাত বাঁধা বাঙালিদের ধরে আনা হতো প্রতি রাতে হত্যার উদ্দেশ্যে। রাত ১২টার পর থেকে এই ট্রাকগুলো শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করত মিরপুর ব্রিজের দিকে।

ব্রিজের দোরগোড়ায় থাকা পাকিস্তানি সেনারা ট্রাক এলেই তৎপর হয়ে উঠত। ট্রাক এলে তারা ব্রিজের ওপরে থাকা সার্চলাইট নিভিয়ে দিয়ে বন্দীদের ব্রিজের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে তাঁদের হত্যা করত। হত্যা সম্পন্ন করত গুলি করে অথবা বেয়নেট চার্জ করে। হত্যা শেষে দেহগুলো ব্রিজ থেকে নিচে তুরাগ নদে ফেলা হতো। প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, এখানে প্রায় প্রতি রাতে গড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা একনাগাড়ে হত্যা সংঘটিত হতো। ব্রিজে জমে যাওয়া পুরু কয়েক ইঞ্চি রক্তের স্তর পরদিন বাঙালিদের দিয়ে পরিষ্কার করানো হতো।

গণহত্যার স্মারক ‘মিরপুর লোহার ব্রিজ’ দীর্ঘদিন অবহেলা আর অযত্নে দৃষ্টির আড়ালে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর মিরপুর লোহার ব্রিজের সমান্তরালে এখানে ‘আমিনবাজার সেতু’ নামে দ্বিতীয় সেতু নির্মিত হয়। ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল জরাজীর্ণ মিরপুর লোহার ব্রিজটি ভেঙে ফেলে সেই স্থানে আট লেনবিশিষ্ট নতুন সেতু নির্মাণ শুরু হয়। এভাবে গণহত্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণের পরিবর্তে ভেঙে ফেলা হয়। কালের অতলে হারিয়ে যায় গণহত্যার সাক্ষী ব্রিজটি।

২০১৯ সালে গবেষণার প্রয়োজনে মিরপুর লোহার ব্রিজ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের ব্রিজের ওপর এনে একত্র করেছিলাম তাঁদের সাক্ষাৎকার ধারণের জন্য। ভিডিও ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা সংঘটিত গণহত্যার কথা অকপটে বলেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার ধারণের পাশাপাশি মিরপুর লোহার ব্রিজের অসংখ্য ছবি ধারণ করা হয়েছিল ডিএসএলআর ক্যামেরায়। ডিএসএলআর ক্যামেরায় ধারণ করা সেই সব ছবি আজ মিরপুর ব্রিজের অস্তিত্বকে ধরে রেখেছে। মনে পড়ে, সাঁতার না জেনেও খরস্রোতা এই ব্রিজের নিচ দিয়ে ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে তুরাগ নদ অনায়াসে পার হয়েছি এর অস্তিত্বকে অনুভব করার জন্য। অথচ সংরক্ষণের অভাবে আজ মিরপুর লোহার ব্রিজ অবয়বহীন ইতিহাসের নীরব অংশ হয়ে গেছে।

বিষয়টি সম্ভবত কাকতালীয়। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পেয়ারার সুবাস’ চলচ্চিত্রে মিরপুর লোহার ব্রিজের কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে।চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় তুরাগের পাড়ে নৌযান থেকে বালু খালাসের দৃশ্য। নোঙর করা নৌযানসহ লোহার ব্রিজ ও আমিনবাজার ব্রিজের সমান্তরাল সহাবস্থান। এ ছাড়া ব্রিজটির একটি স্তম্ভ এবং এর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ক্লোজ শটে দেখানো হয়েছে। অভিনেতা (প্রয়াত) আহমেদ রুবেলকে মিরপুর লোহার ব্রিজের নিচের পানিতে উঁকি দিতে দেখা যায়। তিনি ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে দুই রেলিংয়ের মাঝের সীমানাবিহীন খালি জায়গায় দাঁড়াচ্ছেন। এ ছাড়া ব্রিজকেন্দ্রিক দুরন্ত কিশোরদের ব্রিজ থেকে পানিতে ঝাঁপ দেওয়া আর সেই পানিতে মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ ভেসে যেতেও দেখা যায়। পরিচালক নূরুল আলম আতিকের এ চলচ্চিত্রটি মেটাফোরের এক বারামখানা।

পরিচালক মিরপুর লোহার ব্রিজকে সচেতনভাবে চিত্রনাট্যে স্থান দিয়েছেন কি না, সেটা কেবল পরিচালকই বলতে পারবেন। তবে এই ব্রিজের সীমানাবিহীন খালি জায়গায় অভিনেতা আহমেদ রুবেলের অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট মেটাফোরের ব্যবহার একাত্তরের মিরপুর লোহার ব্রিজ গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মিরপুর লোহার ব্রিজসংলগ্ন যে প্রজন্ম ব্রিজে গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের কাছে সবকিছু ছাপিয়ে ‘পেয়ারার সুবাস’ চলচ্চিত্রটির জেনোসাইডের দুঃসহ স্মৃতি মূর্ত হয়ে ওঠে। ধন্যবাদ ছবির পরিচালককে সচেতনভাবে হোক বা অবচেতনভাবে হোক, অবহেলায়-অযত্নে হারিয়ে যাওয়া মিরপুর লোহার ব্রিজকে সেলুলয়েডে সংরক্ষণের জন্য। শহীদদের স্মৃতিকে জাগরূক রাখার জন্য। 

লেখক: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব করেন উপদেষ্টা— আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়রের অভিযোগ

চীনা যুদ্ধবিমান থেকে এলএস-৬ বোমা ফেলে কেন নিজ দেশে ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালাল পাকিস্তান

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

ভবদহের দুঃখ ঘোচাতে আসছে সেনাবাহিনী, খনন করবে ৫ নদ-নদীর ৮১.৫ কিমি

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত