Ajker Patrika

অনলাইন ক্লাসের নীতিমালা মানছেন না শিক্ষকেরা, ফল বিপর্যয়ের শঙ্কা শিক্ষার্থীদের

জবি প্রতিনিধি
অনলাইন ক্লাসের নীতিমালা মানছেন না শিক্ষকেরা, ফল বিপর্যয়ের শঙ্কা শিক্ষার্থীদের

করোনার কারণে অনলাইন ক্লাসের ভিডিও সরবরাহ, ক্যাম্পাস খোলার পর ন্যূনতম দুই সপ্তাহ সশরীরে ক্লাস, সশরীরে ব্যবহারিক ক্লাস এবং ক্লাসে উপস্থিতির পরিবর্তে ক্লাস পারফরম্যান্স অনুযায়ী নম্বর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই নিয়ম মানছেন না জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা। ফলে সার্বিক ফলাফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় আছেন অনেক শিক্ষার্থী।

গত বছরের ৩ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার কথা জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনলাইন ক্লাসের ভিডিও ইউটিউব ও ফেসবুকে আপলোড করতে হবে যেন শিক্ষার্থী যেকোনো সময় তা দেখতে পারে। মিডটার্ম বা কোনও পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া যাবে না। তবে অ্যাসাইনমেন্ট অনলাইনে নেওয়া যাবে। 

ব্যবহারিক ক্লাসের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হলে তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া হবে, সে সময় ব্যবহারিক ক্লাস হবে। এরপর একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে দুটি সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের থিসিস জমা ও ইন্টার্নশিপের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানানো হয়। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান শিক্ষার্থীদের ক্লাসের উপস্থিতির পরিবর্তে ক্লাস পারফরম্যান্স অনুযায়ী নম্বর দেওয়ার কথা বলেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, সেমিস্টারের প্রতিটি ১০০ নম্বর কোর্সের ৩০ নম্বর সংশ্লিষ্ট কোর্স শিক্ষক সরাসরি মূল্যায়ন করেন। কোর্স শিক্ষক শিক্ষার্থীর মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ক্লাসে উপস্থিতি ইত্যাদি যাচাই করে তার ওপর এ নম্বর দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে বিভাগ ভেদে ৫ বা ১০ নম্বর বরাদ্দ থাকে ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির ওপর। কিন্তু সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস উপস্থিতির ওপর নম্বর বাতিল করে অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, মিডটার্ম পরীক্ষা নিয়ে সেই নম্বর দেওয়ার কথা জানানো হয়। 

যেখানে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির জরিপ অনুযায়ী, ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে ছিলেন। 

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ নিয়ম অমান্য করে মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতির ওপর নম্বর দিচ্ছে। এ নম্বর পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে যোগ হওয়ায় চূড়ান্ত ফলাফলে প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষক নিজেদের অনলাইন ক্লাসের কোনো ভিডিও শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করছেন না। রসায়ন বিভাগ সশরীরে ক্লাস ও ল্যাব না নিয়েই সেমিস্টার পরীক্ষা নিচ্ছে। এতে করে নির্ধারিত কোর্স সর্ম্পকে ন্যূনতম ধারণা ছাড়াই সেমিস্টার শেষ করছেন শিক্ষার্থীরা। 

বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, অনলাইনে ক্লাস করার মতো শক্তিশালী নেটওয়ার্ক অনেকের বাড়িতে ছিল না। মাঝে মধ্যে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে অনেকে ক্লাস করেছে। ক্যাম্পাস খোলা থাকাকালীন যারা উপস্থিতির ওপর প্রায়ই পুরো নম্বর পেতো তারা এখন অনলাইনে ক্লাস না করতে পারায় নম্বর কম পাচ্ছে। অনেকে এক, দুই করেও পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্তান। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী এসব শিক্ষার্থীর পক্ষে উচ্চমূল্যে ইন্টারনেট কিনে ক্লাস করা সম্ভব হয় না। সেখানে অনলাইন ক্লাসের ওপর মার্কিং করে তাঁদের বঞ্চিত করা হবে। অনলাইন ক্লাসের শুরুতে তাঁরা জেনেছেলন, ক্লাস উপস্থিতির ওপর কোনো নম্বর থাকবে না। এখন তা করা হচ্ছে। রেজাল্টে এটি প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

রসায়ন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, তাঁদের কোনো ব্যাচেরই সশরীরে ক্লাস নেওয়া হয়নি। প্রথম সেমিস্টারের ল্যাব হয়েছে, দ্বিতীয় সেমিস্টারের বাকি আছে। এমনিতেই বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় সশরীরে ক্লাস-ল্যাব না হলে তাঁরা সেভাবে কিছুই বুঝতে পারেন না। সশরীরে ক্লাস নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা বারবার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি কর্ণপাত করছেন না। 

অনলাইন ক্লাসের ভিডিও সরবরাহ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী কাওসার আহমেদ বলেন, ‘একজন শিক্ষক তো রাগ করে ভিডিও দেনই-নি। আরেকজনের ভিডিও অনেক বড় হয়ে গেছে বলে দেয় নাই। অনেকের কাছে পেনড্রাইভে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ভিডিও আপলোড করলে নাকি সেটাতে শিক্ষকদের প্রাইভেসি নষ্ট হয়। এজন্য আমরা ক্লাসের ভিডিও পাইনি। কিছু শিক্ষক তো ঠিকমতো ক্লাসই নেননি। কোর্স সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। ক্লাস নিতে বললে রাগ দেখায়, ভয়ে পরে ক্লসের কথাই বলি না। শিক্ষকদের বিরাগভাজন হলে দেখা যাবে পুরো ব্যাচের নম্বর কমিয়ে দিয়েছে। এভাবে আমাদের ক্যারিয়ার তো নষ্ট করতে পারবো না!’

তবে পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেখ গিয়াস উদ্দীন শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত সমস্যার কথা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই যে, কেউ যদি ক্লাসে উপস্থিত না থাকতে পারে তাহলে তাঁকে নম্বর কীভাবে দিব?’ শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত সমস্যার কথা বললে তিনি বলেন, ‘ক্লাসের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ থাকলে সে কারো থেকে শেয়ার করতে পারতো। কিন্তু কেউ যদি তা না করে সে নম্বর পাবে না, এটাই স্বাভাবিক।’

রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামছুন নাহার বলেন, আমরা চাচ্ছি শিক্ষার্থীরা করোনার কারণে যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে তা যেন দ্রুত পুষিয়ে উঠতে পারে। ল্যাব ক্লাসগুলো সশরীরে নেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বলেছি থিওরী ক্লাস নিয়ে কোনো সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ট কোর্সের শিক্ষকের সাথে কথা বলতে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামত ক্লাসের পন্থা ঠিক করবে। তিনি আরও বলেন, সশরীরে ক্লাস নেয়ার বিষয়ে শুরুতেই নীতিমালা ছিল। এখন তার অনেক কিছুই মানা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সশরীরে ক্লাসের বিষেয়ে উপাচার্য আমাদের মৌখিক অনুমোদন দিয়েছেন। করোনা এখনো শেষ হয়নি, তাই শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই আমাদের সব সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। 

অনেক শিক্ষকের অনলাইন ক্লাসের নীতিমালা মানতে অনীহার কথা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘অনলাইন ক্লাস শুরুর সময়ে একটি নীতিমালা হয়েছিল, সেটা অনেকেই এখন মানছেন না। তবে যেসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে গেলেই সেটা সমাধান হওয়ার কথা। এরপরও যদি কোনো সমস্যার সমাধান না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আছেন। ওনার নজরে আনলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।’ 

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. ইমদাদুল হকের কাছে জানাতে চাওয়া হলে, তিনি পরে কথা বলবেন বলে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...