Ajker Patrika

পুঁজিবাজারে অদূরদর্শী বিনিয়োগ

৩১ ব্যাংকের লোকসান ৩৬২৯ কোটি

  • লোকসানের শীর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ও সোনালী ব্যাংক।
  • তিনটি ব্যাংক মুনাফা করেছে ২৩ কোটি টাকা।
  • লোকসানের কারণ অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, ফ্লোর প্রাইস ও জাঙ্ক শেয়ার কেনা।
আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা 
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের পুঁজিবাজারের জন্য মন্দার বছর ছিল ২০২৪ সাল। বছরটিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতোই ব্যাংকগুলোও মুনাফা করতে পারেনি। উল্টো বড় অঙ্কের লোকসান গুনেছে অনেক ব্যাংক। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়, এমন ৩৪ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ২০২৪ সালে ৩১টি ব্যাংকই লোকসান করছে; যার পরিমাণ সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু তিনটি ব্যাংক মুনাফা করেছে ২৩ কোটি টাকা। দেশের সব ব্যাংকের তথ্য প্রকাশ করলে এর পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিশ্লেষক ও পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্দার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালনাকারীদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, তহবিলের সঠিক ব্যবহার করতে না পারা, ফ্লোর প্রাইসের কারণে সময়মতো শেয়ার বিক্রি করতে না পারা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো জাঙ্ক বা খারাপ শেয়ারে বিনিয়োগের কারণেই ব্যাংকগুলোর এই লোকসান হয়েছে।

পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক আল-আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত বছরগুলোতে কোনো ক্ষেত্রেই সুশাসন ছিল না। অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই দেখবেন অনেক ব্রোকারেজ হাউস ও ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনিয়ম ছিল। আইসিবির মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও অনিয়মে জড়িত ছিলেন, যার কারণে ফরচুনের শেয়ার কিনে আইসিবি লোকসান করেছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যেও এ ধরনের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ওই সময় কোনো ক্ষেত্রেই গুড গভর্ন্যান্স পাবেন না। এগুলোর বিরুদ্ধে কতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটাতে ফোকাস করা দরকার।

প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩১টির মোট লোকসানের পরিমাণ ৩ হাজার ৬২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। লোকসান করা ৩১ ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা। ৩৯৮ কোটি টাকা লোকসান করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়াও শীর্ষ পাঁচের মধ্যে থাকা অপর তিন ব্যাংক হলো—ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), সাউথইস্ট ও এবি ব্যাংক। ব্যাংক তিনটির লোকসানের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫৩ কোটি, ৩২৬ কোটি ও ২৬১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

পুঁজিবাজারে বাকি ২৬ ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ৮৯১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ২২৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক (এনবিএল) ২১৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ২১৬ কোটি, উত্তরা ব্যাংক ১৭২ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ১৬৫ কোটি, রূপালী ব্যাংক ১৫৩ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৩৩ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১০৭ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক ৮৩ কোটি, এসবিএসি ব্যাংক ৬৪ কোটি, এনআরবি ব্যাংক ৫৫ কোটি, পূবালী ব্যাংক ৪৮ কোটি, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ৪৬ কোটি, ইউসিবি ৩৩ কোটি, বেসিক ব্যাংক ৩১ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩০ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ২৩ কোটি, সিটি ব্যাংক ১৯ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ১৪ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ১৩ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ১৩ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ১০ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ৯ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৭ কোটি, যমুনা ব্যাংক ১ কোটি ৫০ লাখ এবং ঢাকা ব্যাংক ১ কোটি টাকা লোকসান করেছে।

বিপরীতে মার্কেটাইল, ব্র্যাক এবং প্রাইম ব্যাংক মুনাফা করেছে যথাক্রমে ১২ কোটি, ৭ কোটি এবং ৪ কোটি মিলিয়ে মোট ২৩ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে জনতা, সোনালী, ইবিএল, সাউথইস্ট, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, পূবালীসহ বেশ কিছু ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

তবে সাউথইস্ট ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মামুনুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, পুঁজিবাজার খারাপ ছিল, যার কারণে আমাদের শেয়ারের দাম কমে গেছে। মার্কেট ভালো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু ব্যাংক নয়, যেকোনো বিনিয়োগকারীর জন্য একই কথা।

ইবিএলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে সময়মতো শেয়ার বিক্রি করা যায়নি, সেটা ডিলার অ্যাকাউন্ট, কাস্টমার অ্যাকাউন্ট—উভয় ক্ষেত্রেই। মার্জিন ঋণও সমন্বয় করা যায়নি। আমার ৪০০ কোটি টাকার লোন আছে, সেটা তো ব্লক, সেটার সুদ কত, তার সঙ্গে ম্যানেজমেন্ট কস্ট আছে। কারণ, ওই সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাননি পুঁজিবাজারে পতন হোক। তারা ফোন করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা চেয়েছিলাম কমপ্লায়েন্সের মধ্যে থেকে সব করতে। তা ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ—এই বিষয়গুলো একের পর এক এসেছে।

বাজার বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, ব্যাংকগুলোর লোকসানের বড় কারণ জাঙ্ক বা পচা শেয়ারে বড় আকারে বিনিয়োগ। বেশ কয়েকটি ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছিল। ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার এবং কারাগারে থাকায় গত বছর এর দর প্রায় অর্ধেক কমে ৪০ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং পিপলস লিজিংয়ের মতো সমস্যায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বিনিয়োগ করেছিল কিছু ব্যাংক।

বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের (বিএএসএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, যে যেভাবেই তহবিল পরিচালনা করুক না কেন, একটি ব্যাংক কীভাবে জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগ করে? কারণ, এই ধরনের বিনিয়োগের রিটার্ন অনিশ্চিত। অথচ ব্যাংকগুলোকে আমানতের মতো স্থায়ী দায় সামলাতে হয়।

ব্যাংকগুলোর ক্ষতির পেছনে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলে জানান এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও আলী ইমাম। তিনি বলেন, এই দুর্বল পারফরম্যান্স থেকে বোঝা যায় যে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ পোর্টফোলিও পরিচালনার পদ্ধতিতে বড় ধরনের সমস্যা আছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে সুশাসন থাকার পরেও বিশাল ক্ষতি হয়েছে, যার প্রধান কারণ দক্ষতার ঘাটতি।

আলী ইমাম যোগ করেন, ব্যাংকের কর্মকর্তারা জামানতভিত্তিক ঋণ পরিচালনা করার জন্য অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হন। কিন্তু ইকুইটি মার্কেটের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। ওই কর্মকর্তারাই যখন ইকুইটি (শেয়ারে) বিনিয়োগ পরিচালনা করেন, তখন ভালো করতে পারেন না বা রিটার্ন আসে না।

২০২৪ সালজুড়ে বাজার নিম্নমুখী ছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গত বছর ১ হাজার ২৬ পয়েন্ট বা ১৬ শতাংশ কমেছিল। তবে আলী ইমাম বলেন, এটিই ব্যাংকগুলোর ক্ষতির প্রধান কারণ নয়। পোর্টফোলিও ম্যানেজাররা মন্দা পুঁজিবাজারেও ভালো দক্ষতা দেখাতে পারেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন, যা ব্যাংকিং থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত