Ajker Patrika

রংপুরের আলু খেতে কাজ করা নারীরা পান পুরুষদের এক-তৃতীয়াংশ মজুরি

শিপুল ইসলাম, রংপুর
তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী মাঠে আলু খেতে কাজ করছেন নারীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী মাঠে আলু খেতে কাজ করছেন নারীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘এক সের আলু ৭০ টাকা, এক সের চাল ৫০ টাকা। তেল-মসল্লা, সাবান-কাপড় তো আছে। সারা দিনে কাজ করি মজুরি পাই ২০০ টাকা। এই যুগোত কি ২০০ টাকা মজুরি দিয়া জীবন বাঁচা যায় কন?’

আজ রোববার রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী মাঠে আলু লাগানোর সময় আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন নারী শ্রমিক হাসিনা বেগম। হাসিনা বেগমের বাড়ি জুম্মাপাড়া গ্রামে। ১৫ বছর আগে দিনমজুর স্বামী মারা গেলে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। ৫০ টাকায় দিনমজুরি শুরু করেন তিনি। দেড় দশকে সেই মজুরি ২০০ টাকা হলেও চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

হাসিনা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘সকাল ৮টায় মাঠে আসি, বিকেল ৫টায় কাজ শেষ করি বাড়ি যাই। পুরুষেরাও একই সঙ্গে কাজ শেষ করি ঘরে ফেরেন। কিন্তু পুরুষেরা ৬০০ টাকা মজুরি পায়, আমরা পাই মাত্র ২০০ টাকা। যে ভাবে তরি-তরকারি, চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়ছে, এই টাকায় একবেলার খাবার হয় না। আমাদের মতো নারীরা যেন ন্যায্য মজুরি পায় সবার কাছে আকুল আবেদন আমার।’

হাসিনা বেগমের পাশে কাজ করা প্রামাণিকপাড়া গ্রামের বুলবুলি বেগম বলেন, ‘আলু লাগানো থেকে তোলা পর্যন্ত নারী শ্রমিকের কোনো বিকল্প নেই। রোদে পুড়ে দিনভর কাজ করেও আমরা ন্যায্য দাম পাই না। আমাদের দাবি ৪০০ টাকা মজুরি করা হোক। তাহলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারব।’

শুধু হাসিনা ও বুলবুলি নয়, মজুরি নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে রংপুরের হাজারো নারী শ্রমিকের। শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয় দিনমজুরি করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে (রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা) আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ এক হাজার ৫৭৬ হেক্টরে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত আলু রোপণ করা হয়েছে ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে।

আলু চাষি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করতে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকের প্রয়োজন হয় ৩০ জনের। সে হিসেবে রংপুর অঞ্চলে এবারে আলু রোপণে নারী শ্রমিকের প্রয়োজন ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ২৮০ জন। একজন পুরুষ মজুরি পাচ্ছে ৬০০ টাকা, আর নারী শ্রমিকেরা দেওয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। সে হিসেবে পুরুষের সমান নারীদের মজুরি হিসেব করলে শুধু আলু রোপণে দৈনিক ১২১ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার টাকা বঞ্চিত হচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা।

রংপুরের আলু খেতে কাজ করা নারীরা মজুরি পান নারীদের তিন ভাগের এক ভাগ। ছবি: আজকের পত্রিকা
রংপুরের আলু খেতে কাজ করা নারীরা মজুরি পান নারীদের তিন ভাগের এক ভাগ। ছবি: আজকের পত্রিকা

রংপুর অঞ্চলে এখন চলছে আলু রোপণের মৌসুম। তিন ফসল রোপণ ও উত্তোলনে নারী শ্রমিকই একমাত্র ভরসা। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। একজন পুরুষে সঙ্গে আলু রোপণ, মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া, লাঙল টানার কাজ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত করলেও পুরুষ শ্রমিকের তিন ভাগের এক ভাগ মজুরি পান নারী শ্রমিকেরা।

সকাল ৯টায় তারাগঞ্জে দোলাপাড়া মাঠে গিয়ে দেখা যায় কয়েক হেক্টর জমিতে আলু লাগাচ্ছেন প্রামাণিক পাড়ার, জিয়াউর রহমান, আজহারুল ইসলাম, জিকরুল প্রামাণিকসহ কয়েকজন কৃষক। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি আলু রোপণে কাজ করছেন শতাধিক নারীর কয়েকটি দল। সেই নারীদের কেউ ফালি টানছেন, কেউ আলুর ফালি বসাচ্ছেন, কেউ আবার সেগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন।

সেখানে কথা হয় মেনানগর গ্রামের স্বামীহারা নারী মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। চার সদস্যের সংসার তাঁর একার আয়ে চলে। মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘গেল বার ১৮০ টাকা কাম করছি, এবার ২০০ টাকা। খালি ২০ টাকা মজুরি বাড়ছে। কিন্তু বাজারোত এই এক বছরে চাল, তেল, সবজির দাম কেজিতে ২০ থাকি ৩০ টাকা বাড়ছে। ২০০ টাকা দিয়া চাল কিনি না, সবজি কিনি বাজারোত গেইলে সেই চিন্তায় মাথা ঘোরে। নারী জন্যে কি হামরা সগটে অবহেলার পাত্র।’

দিনমজুর স্বামী অসুস্থ হওয়ায় এখন সংসারে খরচ জোগাতে কাজ করেন এসমোতারা বেগম। আগে স্বামী মজুরি দিয়ে ৫০০ টাকা পেলেও তিনি এখন পাচ্ছেন ২০০ টাকায়। আক্ষেপ করে এসমোতারা বেগম বলেন, ‘স্বামী যখন ৫০০ টাকা কামাই করছিল তখনো টানাটানি ছিল সংসারে। আর এখন ২০০ টাকা দিয়া কেমনে চলি বুঝেন। দাম বাড়ার কথা কইলে গৃহস্থরা বলেন আমরা মহিলা, তাই দাম কম। উপায় না পেয়ে কম দামেই বাধ্য হয়ে কাজ করছি।’

সকাল আটটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে মাঠে কাজ করছেন নারীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
সকাল আটটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে মাঠে কাজ করছেন নারীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মজুরি বৃদ্ধির দাবি করেন মাঠে কাজ করা, আমেনা, লিপি, শরিফা, মজিদা, শেফালি, কৌশানী রায়, মৃনালী রানী, খাদিজা আক্তারসহ অন্যান্য নারী শ্রমিকেরা।

নারীদের মজুরি কম দেওয়ার বিষয়ে কথা হয় কৃষক জিকরুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নারীরা ছাড়া আলু রোপণ ও উত্তোলন প্রায় অসম্ভব। এটাও ঠিক যে তাঁরা সকাল ৮ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু হুট করে আমি তো মজুরি বাড়াতে পারি না। সবাই যা দেয় আমিও তাই দেই। তবু গত বছরের চেয়ে এবার ২০ টাকা বেশি দেওয়া হচ্ছে।’

মানব কল্যাণ ঘর সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জেমিন শেখ বলেন, যে নারীরা মাঠে কাজ করছেন তার অধিকাংশরই পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। কেউ স্বামীহারা, কারও স্বামী কাজ করতে অক্ষম। তাই অভাবের তাড়নায় পরিবারের মুখে দুমুঠো ভাতের জোগান দিতে তাঁরা নিয়মিত মাঠে বিভিন্ন কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। ঘরে-বাইরে নারীরা যে বৈষম্যের শিকার তা এটা দূর হওয়া দরকার।

তারাগঞ্জের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নুরেশ কাওসার জাহান বলেন, ‘সরকারি কাজ যেমন টিআর, কাবিখা, কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজে নারী-পুরুষ সবাইকে সমান মজুরি দেওয়া হয়। সবারই উচিত নারীদের পুরুষের মতো সমান মজুরি দেওয়া। জনপ্রতিনিধি মাধ্যমে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত