Ajker Patrika

কাজ না পারলে প্লায়ার্স দিয়ে পায়ের নখ উঠায়ে দিত: শিশু গৃহকর্মীর মুখে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা

যশোর প্রতিনিধি
কাজ না পারলে প্লায়ার্স দিয়ে পায়ের নখ উঠায়ে দিত: শিশু গৃহকর্মীর মুখে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা

‘আমাকে সব কাজ সময় বেঁধে দিত। সেই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে রুটির বেলুন, খুস্তি আর রেঞ্জ দিয়ে মারত। অনেক সময় রেঞ্জ বা প্লায়ার্স দিয়ে পায়ের নখ উঠায়ে দিত। এভাবেই আমাকে আট মাস ধরে নির্যাতন করা হয়েছে।’ 

হাসপাতালের বেডে শুয়ে নির্যাতনের শিকার ১৩ বছর বয়সী শিশু গৃহকর্মী ফিহা মনি এভাবেই নিজের নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। 

ফিহা মনি দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার মাঝপাড়া এলাকার মৃত আবুল হোসেনের মেয়ে। সে গত নয় মাস ধরে যশোর শহরের ঘোপস্থ এলাকায় সরকার শামীম আহমেদ অংকুর নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করত। 

গতকাল বুধবার পুলিশ মধ্য রাতে জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ অভিযোগ পেয়ে শহরের ওই বাসা থেকে নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। 

যশোরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গভীর রাতে ৯৯৯ আমাদের কাছে ফোন আসে একটি বাড়ির গৃহকর্ত্রী গৃহকর্মী শিশুকে নির্যাতন করছে। কল পাওয়া পরেই ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পায় পুলিশ। পরে শিশুটিকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করি আর অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তাকে আটক করেছি।’ এই ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন এবং বাড়িতে নির্যাতনে ব্যবহার করা বেলুন ও কিছু তার উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা। 

কয়েক বছর আগে শিশু ফিহা মনির বাবা মারা গেলে তার মা আবার বিয়ে করেন। তখন থেকে ফিহা মনি গ্রামে তার নানি বাড়িতে থাকত। পরে তার মায়ের পরিচিত এক বাড়িতে গৃহ পরিচালিকার কাজ পাইয়ে দেন। নয় মাস আগে ফিহা মনিকে ওই বাড়ির গৃহকর্তা সরকার শামীম আহমেদের যশোরে ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসেন। এক মাস তারা ফিহার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও পরের আট মাস অমানুষিক নির্যাতন করত বলে ভুক্তভোগীর ভাষ্য। 

আজ বৃহস্পতিবার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, একটি ছেঁড়া রং চোটা ফ্রক পরে হাসপাতালের বেডে ভাত খাচ্ছে শিশু ফিহা মনি। শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত। পায়ে আঘাত করার কারণে দুই পা ভাঁজ করতে পারছে না। দুই পা ছেড়েই ভাত খেতে দেখা যায় অবুঝ শিশুটিকে। 

পাশের বেডেই এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘এই শিশুটির নির্যাতনের ক্ষত দেখে শিউরে উঠি। সকালে কিছু খায়নি। এর সঙ্গে কোন স্বজনরা না থাকায় আমাদের বাড়ি থেকে আনা খাবার দিয়েছি; সেগুলোই খাচ্ছে।’ 

খাওয়া শেষে ফিহা মনি আজকের পত্রিকাকে বলে, ‘আমাকে সময় বেঁধে গৃহস্থালির সব কাজ করত হতো। কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, থালা বাসন পরিষ্কার, মসলা বাটাসহ সব কাজ করতে হতো। কোনো কাজে একটু বেশি সময় লাগলে রুটি বানানোর বেলুন, ডিশের মোটা তার ও সেলাই রেঞ্জ নিয়ে মারত গৃহকর্ত্রী জান্নাত জুঁই ও তার স্বামী। গতকাল সন্ধ্যায় ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনতে একটু দেরি হওয়ায় বেলুন দিয়ে পিটুনি দেয়। চোখে রক্ত জমে যায়। সেলাই রেঞ্জ দিয়ে পায়ের নক থেঁতলে দেয়। চিৎকার করলে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারি না। রাতে দরজা খোলার সময় পাশে বাড়ির একজন আমাকে দেখে ঘটনা জানতে চাইলে, আমি বলে দিই আমাকে মেরেছে। পরে রাতে পুলিশ এসে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে।’ 

যশোর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিশুটিকে রাত ১টা ১০ মিনিটে ভর্তি করা হয়েছে। শিশুটির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। চোখে, মাথা ও পায়ের তলাতে আঘাত পেয়েছে। প্রথমে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হলেও এখন শঙ্কামুক্ত।’ 

এ বিষয়ে গৃহকর্তা সরকার শামীম আহমেদ ও গৃহকর্ত্রী জান্নাত জুঁইয়ের বক্তব্য জানা যায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত