Ajker Patrika

‘আমার পরিচয়, আমি গুম হওয়া বাবার সন্তান’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯: ১৬
‘আমার পরিচয়, আমি গুম হওয়া বাবার সন্তান’

কাজ থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঈসমাইল হোসেন। পেশায় এই কাঠ ব্যবসায়ী নিখোঁজের প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি। ঈসমাইলের সন্ধান পেতে প্রত্যেকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ব্যর্থ হয়েছে পরিবার। এখন ঈসমাইলের ছবি নিয়ে রাস্তায় ঘুরছেন স্ত্রী-সন্তান। বাবার ছবি বুকে বেঁধে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে মেয়ে আনিসা ইসলাম ইনসি (১৭)। সে বলে, ‘গত পাঁচ বছর থেকে আমার একটি নতুন পরিচয় হয়েছে। আমি একজন গুম হওয়া বাবার সন্তান।’ 

রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে গুম হওয়া পরিবারগুলোর সদস্যদের নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমাবেশে এসব কথা বলে ইনসি। 

আগামীকাল রোববার (১০ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আজ শনিবার সকালে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

তবে দাঁড়ানোর ১০ মিনিট পরেই পুলিশের বাধার মুখে পড়েন সমাবেশের আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা। এ সময় আনিসা ইসলাম ইনসি পুলিশকে উদ্দেশ করে বলে, ‘এই যে আপনারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমাদের সামনে পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনারা কি আমাদের ভয় পাচ্ছেন? আপনারা লাঠি নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনারা কি আমাদের মারবেন? তাহলে আমার বাবার সঙ্গে আমাদেরও গুম করে দিতেন।’ 

এ সময় মাইক্রোফোন কেড়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. আক্তারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ওরা তো এখানে দাঁড়াতেই পারে না। ওরা অনধিকার চর্চা করেছে। ওদের মাইক্রোফোন কেড়ে নেবে কেন। এই প্রোগ্রামের জন্য তারা কোনো অনুমতি নেয়নি। তাই এখানে তাদের প্রোগ্রাম করতে নিষেধ করা হয়। তারপর তারা প্রেসক্লাবে চলে যায়।’ 

মাইক কেড়ে নেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে সংগঠনের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের ৪৪টি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমরা সমাবেশ আয়োজন করেছিলাম, আমাদের মাইক কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ 

নিখোঁজ ও বিচারবিহর্ভূত হত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছেনপুলিশি বাধার মুখে জাদুঘরের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিণ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পৌঁছায় মায়ের ডাকের সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা। সেখানে সংগঠনটির মানববন্ধনে বক্তব্য দেন বিভিন্ন সময় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে গুমের শিকার বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারহানা আক্তার বলেন, ‘আমরা কী অন্যায় করেছি যে আমার স্বামীকে গুম করা হয়েছে? আমার স্বামীর কী দোষ—আমি এটা জানতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়েন না। আপনার কাছে রেখে দেন। শুধু এটুকু বলেন, কেন আপনি আমার স্বামীকে গুম করেছেন। আর কিছু জানতে চাই না আপনার কাছে।’

গুম হওয়া গাড়িচালক কাউসার হোসেনের মেয়ে লামিয়া আক্তার মীম কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে। ছোট্ট এই শিশু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আজ ১১ বছর হয়ে গেছে আমি আমার বাবাকে দেখি না। আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। বাবার সাথে রাস্তা দিয়ে হাত ধরে হাঁটতে চাই।’ 

গুমের শিকার সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নি বলেন, ‘১০ বছর আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ নাই। আমরা রাস্তায় রাস্তায় ভাইয়ের জন্য কাঁদি।’

বিভিন্ন মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের ধরতে গিয়ে তাঁদের স্বজনদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরেন সংগঠনটির সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি। তিনি বলেন, ‘এখন যাদের গায়েবি মামলা দিয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কারাগারে নির্যাতন করা হচ্ছে; যাদের না পেয়ে তাদের স্বজনদের, বাবাকে, ভাইকে, স্ত্রীকে সন্তানসহ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে—তাদের বিচারের দাবিতে, তাদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে রাজপথে দাঁড়িয়েছি।’ 

নিখোঁজ ও বিচারবিহর্ভূত হত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছেনএই সমাবেশে অন্তত ২০ জন বিভিন্ন সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের পরিবারও অংশ নিয়েছিল। 

মানুষের বুকের ওপর ও রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান সরকার—এমনটা উল্লেখ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান। সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট দানবীয় সরকার মানুষের বুকের রক্তের ওপর দিয়ে, মানুষের লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে।’ 

এ সময় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘যত অত্যাচারই করুক, মায়ের ডাক তারপরও তাদের লড়াই অব্যাহত রাখছে।’

মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের (একাংশের) সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালাসহ আরও অনেকে।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময় গুম হওয়া ৭৬ জনের একটি তালিকা ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ। এই তালিকার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য, এই ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা ‘নিখোঁজ’।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

আইপিএলে চাহালের রেকর্ড হ্যাটট্রিকের রাতে রহস্যময় পোস্ট এই নারীর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত