Ajker Patrika

‘ছেলেটারে আমার ৪০ ফুট ছ্যাচড়াইয়া নিয়া গেছিল’ 

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ১১: ৪০
‘ছেলেটারে আমার ৪০ ফুট ছ্যাচড়াইয়া নিয়া গেছিল’ 

তিন বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি নানা দপ্তর, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক—সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন শাহজাহান কবীর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর—আবেদন করেছেন সব জায়গাতেই। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। যে বাসচালক তাঁর একমাত্র ছেলেকে পিষে মেরেছিল, সে এখন মুক্ত। এখনো বাস চালায় সে। সড়কে স্বজনহারাদের সমাবেশে এসে এমনটাই জানাচ্ছিলেন ২০১৮ সালে বাসচাপায় নিহত সাইফুল ইসলাম রানার বাবা শাহজাহান কবির। শুক্রবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন করা সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। 

আজকের পত্রিকাকে শাহজাহান কবির বলেন, ‘আমি এখন ধোপার কাজ করি। ছেলেটা থাকলে বুড়া বয়সে হয়তো এই কাজ আমার করা লাগত না। দুইটা মেয়ে আমার। আমি কাজ না করলে সংসার চালাইব কে?’

রাজধানীর একটি কমিউনিটি হাসপাতালে নার্স (সেবক) হিসেবে চাকরি করতেন সাইফুল। ২০১৮ সালের ৩ আগস্ট মগবাজারে গোল্ডেন লাইনের একটি বেপরোয়া গতির বাস পিষে মারে মোটরসাইকেলে থাকা সাইফুলকে। বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে তিনি পড়ে যাওয়ার পর তাঁকে পিষে দিয়েই বাস নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চালক। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা চালককে ধরে পুলিশে দেয়। 

সাইফুলের বাবা বলেন, ‘ছেলেটারে আমার ৪০ ফুট ছ্যাচড়াইয়া নিয়া গেছিল। শুরুতেই যদি বাসটা থামাইয়া দিত। আমার ছেলেটা হয়তো বাঁইচা যাইত।’  

সমাবেশে আসা সাইফুলের মা সুবর্ণা পারভিন ডুকড়ে কেঁদে বারবার শুধু বলছিলেন, ‘আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আর কারও সন্তানের যেন এমন পরিণতি না হয়।’  

রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাসচাপায় নিহত শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীবের বন্ধু মাহফুজ হাসান রাহাতও বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে রাজীব নিহতের পর যদি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা যেত, তাহলে ২০২১-এ এসে নাঈমকে প্রাণ দিতে হতো না। আমরা নিরাপদ সড়ক চাই। আমরা আর একটা মায়ের কোলও খালি হতে দেখতে চাই না।’ 

সড়কে স্বজনহারাদের পাশাপাশি সমাবেশে অংশ নেয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। তারা বলে, ২০১৮ সালে রাজীব, মিম নিহতের পর যে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা যদি সফল হতো, তাহলে আজ আমাদের আরেকটা ভাইকে হারাতে হতো না। সড়কে মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যা। আমরা এই হত্যার অবসান চাই। নভেম্বরেও সড়কে ৫৪ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তারা বলে, এত লাশের ভার আমরা আর বইতে পারছি না। 

শুক্রবারের এই সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারা জানায়, ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের ৯ দফা দাবি না মানলে ১৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ের সামনে অনশন কর্মসূচি শুরু হবে। 

শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শিক্ষার্থীসহ সব সড়ক হত্যার বিচার করতে হবে এবং পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, সারা দেশে সব গণপরিবহনে (সড়ক, নৌ, রেল ও মেট্রোরেল) শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে, গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য যথাস্থানে ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্রুততর সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত সকল যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। 

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত ৭ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে বাসের ভাড়া ২৬ থেকে ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর প্রেক্ষিতে ১৮ নভেম্বর অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন চলাকালে গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এরপর থেকে হাফ পাসসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই ২৯ নভেম্বর রামপুরায় মইনুদ্দীন নামের আরেক শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপর আরও জোরালো হয় শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত