Ajker Patrika

লাল জোয়ারের পালকি

কামার আহমাদ সাইমন
লাল জোয়ারের পালকি

ধুলা উড়িয়ে খালি গায়ে পালকি টেনে নিয়ে যায় একদল বেহারা—পালকির ভেতরে বসে তাদের বাঁকাচোরা কথা শুনে কান্না পায় কিশোরী মেয়েটার। নয় মাসের ৯ তারিখে জন্ম বলে বাড়িতে ওকে সবাই আদর করে ডাকত ‘ছোট নয়’। সেই আদরের ‘নয়’কেই এক শুঁড়ি কারখানার (ওয়াইন ডিস্টিলারি) মালিক বুড়ো কুষ্ঠ রোগীর কাছে বিয়ে দেন গরিব বাবা, একটা গাধার লোভে। এই নিয়ে নয়কে গান গেয়ে ত্যক্ত করতে করতে বেয়ারার দল রওনা দেয় বুড়োর বাড়ি।

নয়-এর দিকে তাকিয়ে কষ্ট হয় আমার, অডিটোরিয়ামের বিশাল পর্দার একদম সামনে বসে আমি বেজার হয়ে ভাবি, ‘বেয়ারা’ শব্দটা কি তাহলে পালকির ‘বেহারা’দের থেকেই আসছে? চারপাশে আখের মতো লম্বা লম্বা জোয়ার-বাজরার জঙ্গল। আমাদের দেশের একসময়ের অতি পরিচিত ফসল জোয়ার।

অনেক অঞ্চলে একে ‘জয়ধান’ বলত, যার জায়গা এখন দখল করেছে গম। সেই বুনো জোয়ারের জঙ্গল থেকে হঠাৎ এক ডাকাত এসে পড়ে। কেড়ে নেয় বেহারাদের সব টাকা, তুলে নিয়ে যেতে চায় নয়কেও। ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে বেহারার দল। পালকি থেকে নেমে ডাকাতের সঙ্গে রওনা দেয় নয়, তারপর একটু থেমে ঘুরে তাকায়। ভয় পাওয়া বেহারাদের দেখে হাসি পায় তার, চোখের ভাষায় বলে, ‘এই তোমাদের বাহাদুরি!’ আঁতে লাগে একজন বেহারার, লাফ দেয় সে ডাকাতের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপ দেয় বাকিরাও, পিটিয়ে মারে ডাকাতকে। পালকিতে এসে বসে নয়—মুখ তুলে তাকায় সাহসী বেহারার দিকে, প্রেমে পড়ে বেয়ারা বেহারা।

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী চীনা ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার মো ইয়ানের (Mo Yan) উপন্যাস ‘রেড সোরগাম’ (Red Sorghum)-এর প্রথম দুই পর্ব নিয়ে বানানো ছবি। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (১৯৬৬-৭৬) পর পঞ্চম প্রজন্মের অন্যতম প্রধান নির্মাতা চাঙ ইমোর (Zhang Yimou) প্রথম ছবি ‘রেড সোরগাম’ বা ‘লাল জোয়ার’ (১৯৮৭)।

বার্লিনে গোল্ডেন বেয়ার জয়ী ছবিটা প্রথম দেখেছিলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। একরকম ভুল করেই ঢুকেছিলাম অডিটোরিয়ামে, পরে দেখি চীনা চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে, কলেজ ফাঁকি দিয়ে, ছবি দেখলাম টানা সাত দিন—সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা।

কিশোর বয়স, ‘লাল জোয়ার’ ছবি শেষে মুখ ‘হা’ করে পর্দার দিকে কতক্ষণ তাকায় ছিলাম, জানি না। নয়কে বুড়োর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল সাহসী বেহারা। তিন দিনের মাথায় বুড়োটা খুন হন, কেউ জানে না কে করেছে কাজটা। যদিও নয়-এর সন্দেহ, কাজটা সাহসী বেহারার। বুড়ো মরার পর পুরোনো মজুরদের নিয়ে নতুন করে শুঁড়ি কারখানাটা চালু করে নয়। ফিরে আসে সাহসী বেহারা, ঘর বাঁধে নয়-এর সঙ্গে। শুরুর গল্পটা শেষে আবার ফিরে আসে-শেষে এসে বুঝি শুরুটা কেন এমন ছিল। ছবির সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ছবির শেষে জাপানি সৈন্যরা দখল করে নেয় ওদের গ্রাম। আবার প্রতিরোধের ডাক দেয় নয়, এবার আর চোখের ইশারায় না, পরিষ্কার উচ্চারণে। ওর ডাকে বুনো বেহারার দল থেকে জন্ম নেয় একদল স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা।

আগে কোথাও বলার সুযোগ হয়নি, ‘শুনতে কি পাও!’ ছবি দিয়ে যখন আমার জলত্রয়ীর কাজ শুরু করি, তখন খুব মনে পড়ছিল ‘লাল জোয়ার’ ছবিটা। মুক্তির অপেক্ষায় জলত্রয়ীর দ্বিতীয় পর্ব ‘অন্য দিন...’, তৃতীয় পর্ব ‘আরও কিছু জীবন’; এর প্রস্তুতি শুরু করেছি। এখন বুঝতে পারি, ছেলেবেলায় আমাদের দেখার চোখ তৈরি করে আমাদের চারপাশের সময়। আমরা যখন বড় হই, তখন আবার আমাদের সেই চোখই তৈরি করে নতুন সময়। সিনেমায় চোখ হলো পালকির মতো, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে গল্প নিয়ে যায় সিনেমা। ছেলেবেলায় জোয়ারের জঙ্গলে দেখা লাল পালকি আমাকে একটা নতুন পৃথিবীর গল্প বলেছিল। কালকের পৃথিবীর জন্য আজকে আমার দরকার আরেকটা নতুন গল্প বলে যাওয়া।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত