ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রচেষ্টা এবং দেশটির ইসলামি প্রশাসনকে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেভাবে ‘অতিরঞ্জিত’ করে তুলে ধরা হয়—তার বিরুদ্ধে অবস্থান প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেনেথ নি’ল ওয়াল্টজের। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যয়নে তিনি অন্যতম খ্যাতনামা গবেষক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘নিওরিয়ালিজমের’ জনক হিসেবে পরিচিত কেনেথ ওয়াল্টজ মারা যান ২০১৩ সালে। মৃত্যুর আগের বছর ২০১২ সালে তাঁর একটি নিবন্ধ ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের এই প্রেক্ষাপটে তাঁর পর্যবেক্ষণটি খুবই প্রাসঙ্গিক। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান।
কেনেথ এন. ওয়াল্টজ

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।
কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।
ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।
তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।
অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।
ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।
তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!
ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।
তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!
তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।
এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।
তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!
অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।
কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।
ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।
তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।
অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।
ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।
তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!
ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।
তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!
তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।
এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।
তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!
অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রচেষ্টা এবং দেশটির ইসলামি প্রশাসনকে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেভাবে ‘অতিরঞ্জিত’ করে তুলে ধরা হয়—তার বিরুদ্ধে অবস্থান প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেনেথ নি’ল ওয়াল্টজের। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যয়নে তিনি অন্যতম খ্যাতনামা গবেষক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘নিওরিয়ালিজমের’ জনক হিসেবে পরিচিত কেনেথ ওয়াল্টজ মারা যান ২০১৩ সালে। মৃত্যুর আগের বছর ২০১২ সালে তাঁর একটি নিবন্ধ ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের এই প্রেক্ষাপটে তাঁর পর্যবেক্ষণটি খুবই প্রাসঙ্গিক। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান।
কেনেথ এন. ওয়াল্টজ

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।
কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।
ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।
তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।
অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।
ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।
তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!
ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।
তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!
তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।
এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।
তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!
অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।
কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।
ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।
তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।
অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।
ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।
তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!
ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।
তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!
তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।
এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।
তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!
অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক

আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
২ দিন আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন বাহিনী ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছাকাছি অভিযান চালিয়ে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করেছে। ট্যাংকারে ভেনেজুয়েলা ও ইরানের তেল বহন করা হচ্ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এই ঘটনার পর ভেনেজুয়েলার তেল বহনের অভিযোগের আরও ছয়টি জাহাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রথম ট্যাংকারটির অবস্থান (লোকেশন) গোপন করার বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নিশ্চিত করেছেন, জব্দ হওয়া জাহাজটির নাম ‘স্কিপার’। তাঁর দাবি, এটি ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা ভুক্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রুড অয়েল ট্যাংকার।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর। জব্দ হওয়ার আগে এটি গত ৭ নভেম্বর থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেনি।
মেরিন অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপ্লার (Kpler) জানিয়েছে, ‘স্কিপার’-এর অবস্থান গোপন করার (স্পুফিং) দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালে যখন জাহাজটি ‘আদিশা’ (Adisa) নামে চলছিল, তখন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এটিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক তেল পাচার নেটওয়ার্কের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘স্কিপার’ ঘন ঘন ট্র্যাকারকে মিথ্যা তথ্য দিত। যেমন, এআইএস সিস্টেমে জাহাজটি ৭ ও ৮ জুলাই ইরাকের বসরা অয়েল টার্মিনালে অবস্থান দেখালেও, টার্মিনাল রিপোর্টে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। উল্টো কেপ্লার জানিয়েছে, সেই সময়েই ট্যাংকারটি ইরানের খার্গ দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত তেল বোঝাই করছিল। এ ছাড়া, ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজটি এআইএস-এ সম্পূর্ণ ভুল সংকেত পাঠাচ্ছিল, যা এর আসল অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্কিপার’ সম্ভবত ‘ডার্ক ফ্লিট’ নামক বিশ্বব্যাপী তেলবাহী ট্যাংকারের একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কটি মালিকানা, পরিচয় এবং ভ্রমণ ইতিহাস গোপন করে তেলের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কাজ করে।
যদিও ‘স্কিপার’ গায়ানার পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করছিল, কিন্তু গায়ানা সরকার দ্রুত বিবৃতি দিয়ে জানায় যে ২০ বছর বয়সী এই ট্যাংকারটি তাদের দেশে নিবন্ধিত নয় এবং এটি ‘অবৈধভাবে গায়ানার পতাকা ব্যবহার করছিল’। জাহাজটির নিবন্ধিত মালিক হিসেবে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ-ভিত্তিক ‘ট্রাইটন নেভিগেশন করপোরেশন’-এর নাম রয়েছে। তবে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এই ট্রাইটন করপোরেশনকে একজন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানি ধনকুবের ভিক্তর আর্তেমভ তাঁর বৈশ্বিক ‘তেল পাচার নেটওয়ার্ক’ পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতেন।
ভেনেজুয়েলার তেল মজুত বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মাদুরোর প্রশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে দেশটির তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ‘স্কিপার’ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। কেপ্লার বিশ্লেষকেরা জানান, ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দর থেকে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন (১১ লাখ) ব্যারেল মেরে ক্রুড তেল বোঝাই করেছিল এবং গন্তব্য হিসেবে কিউবার নাম উল্লেখ করেছিল।
১১ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এটি পূর্বে যাত্রা করে একটি ‘শিপ-টু-শিপ ট্রান্সফার’ সম্পন্ন করে। এটির কার্গো পরে চীনেও ‘ভুয়া ঘোষিত’ হয়েছিল। মার্কিন অভিযানের মাত্র কয়েক দিন আগে, ৭ ডিসেম্বরে এটি ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে স্থানান্তরে জড়িত ছিল বলে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। বেলজিয়ামের নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক ভ্যান লোকারেন জানান, এই ধরনের স্থানান্তর আইনত অবৈধ না হলেও, তা ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ এবং সাধারণত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্যই করা হয়।
‘স্কিপার’ সর্বশেষ ৭ নভেম্বর তার অবস্থান ঘোষণা করে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়। মার্কিন অভিযানে ১০ ডিসেম্বর এর অবস্থান পুনরায় দৃশ্যমান হয়। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, ১৮ নভেম্বর স্যাটেলাইট চিত্রগুলো নিশ্চিত করছে যে ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দরে ছিল।
তথ্যসূত্র: বিবিসি

নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন বাহিনী ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছাকাছি অভিযান চালিয়ে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করেছে। ট্যাংকারে ভেনেজুয়েলা ও ইরানের তেল বহন করা হচ্ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এই ঘটনার পর ভেনেজুয়েলার তেল বহনের অভিযোগের আরও ছয়টি জাহাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রথম ট্যাংকারটির অবস্থান (লোকেশন) গোপন করার বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নিশ্চিত করেছেন, জব্দ হওয়া জাহাজটির নাম ‘স্কিপার’। তাঁর দাবি, এটি ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা ভুক্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রুড অয়েল ট্যাংকার।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর। জব্দ হওয়ার আগে এটি গত ৭ নভেম্বর থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেনি।
মেরিন অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপ্লার (Kpler) জানিয়েছে, ‘স্কিপার’-এর অবস্থান গোপন করার (স্পুফিং) দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালে যখন জাহাজটি ‘আদিশা’ (Adisa) নামে চলছিল, তখন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এটিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক তেল পাচার নেটওয়ার্কের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘স্কিপার’ ঘন ঘন ট্র্যাকারকে মিথ্যা তথ্য দিত। যেমন, এআইএস সিস্টেমে জাহাজটি ৭ ও ৮ জুলাই ইরাকের বসরা অয়েল টার্মিনালে অবস্থান দেখালেও, টার্মিনাল রিপোর্টে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। উল্টো কেপ্লার জানিয়েছে, সেই সময়েই ট্যাংকারটি ইরানের খার্গ দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত তেল বোঝাই করছিল। এ ছাড়া, ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজটি এআইএস-এ সম্পূর্ণ ভুল সংকেত পাঠাচ্ছিল, যা এর আসল অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্কিপার’ সম্ভবত ‘ডার্ক ফ্লিট’ নামক বিশ্বব্যাপী তেলবাহী ট্যাংকারের একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কটি মালিকানা, পরিচয় এবং ভ্রমণ ইতিহাস গোপন করে তেলের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কাজ করে।
যদিও ‘স্কিপার’ গায়ানার পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করছিল, কিন্তু গায়ানা সরকার দ্রুত বিবৃতি দিয়ে জানায় যে ২০ বছর বয়সী এই ট্যাংকারটি তাদের দেশে নিবন্ধিত নয় এবং এটি ‘অবৈধভাবে গায়ানার পতাকা ব্যবহার করছিল’। জাহাজটির নিবন্ধিত মালিক হিসেবে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ-ভিত্তিক ‘ট্রাইটন নেভিগেশন করপোরেশন’-এর নাম রয়েছে। তবে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এই ট্রাইটন করপোরেশনকে একজন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানি ধনকুবের ভিক্তর আর্তেমভ তাঁর বৈশ্বিক ‘তেল পাচার নেটওয়ার্ক’ পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতেন।
ভেনেজুয়েলার তেল মজুত বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মাদুরোর প্রশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে দেশটির তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ‘স্কিপার’ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। কেপ্লার বিশ্লেষকেরা জানান, ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দর থেকে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন (১১ লাখ) ব্যারেল মেরে ক্রুড তেল বোঝাই করেছিল এবং গন্তব্য হিসেবে কিউবার নাম উল্লেখ করেছিল।
১১ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এটি পূর্বে যাত্রা করে একটি ‘শিপ-টু-শিপ ট্রান্সফার’ সম্পন্ন করে। এটির কার্গো পরে চীনেও ‘ভুয়া ঘোষিত’ হয়েছিল। মার্কিন অভিযানের মাত্র কয়েক দিন আগে, ৭ ডিসেম্বরে এটি ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে স্থানান্তরে জড়িত ছিল বলে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। বেলজিয়ামের নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক ভ্যান লোকারেন জানান, এই ধরনের স্থানান্তর আইনত অবৈধ না হলেও, তা ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ এবং সাধারণত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্যই করা হয়।
‘স্কিপার’ সর্বশেষ ৭ নভেম্বর তার অবস্থান ঘোষণা করে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়। মার্কিন অভিযানে ১০ ডিসেম্বর এর অবস্থান পুনরায় দৃশ্যমান হয়। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, ১৮ নভেম্বর স্যাটেলাইট চিত্রগুলো নিশ্চিত করছে যে ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দরে ছিল।
তথ্যসূত্র: বিবিসি

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর...
২১ জুন ২০২৫
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন, তখন একই অফিসে বসে সৌম্যা বসরমালিংগম বিভিন্ন ভিডিওর ঘরানা, চরিত্রের মুড ও টোন বিশ্লেষণ করছেন। আসলে তাঁরা দুজনই এমন এক শিল্পের কর্মী, যে শিল্প বিশ্বজুড়ে এআই মডেল প্রশিক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য ছাঁকছে ও বিশ্লেষণ করছে।
এই কাজকে প্রযুক্তি জগতে বলা হয় ডেটা অ্যানোটেশন—যেখানে মানুষ ছবি, ভিডিও ও টেক্সট ডেটাকে ট্যাগ করে এআইয়ের শেখার উপযোগী করে তোলে। ভারত এখন এই শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। ২০২০ সালে যেখানে মাত্র ৭০ হাজার মানুষ এই খাতে কাজ করত, ২০৩০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ১০ লাখে। একই সময়ে এই বাজারের মূল্য বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হতে পরে বলে জানিয়েছে ভারতের সফটওয়্যার শিল্প সংস্থা নাস্কম।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই ৭১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি চাকরি হারানোর কারণ হিসেবে সরাসরি এআইকে দায়ী করা হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকায় এআই–সম্পর্কিত ছাঁটাইয়ের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি—মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন, মেটা—সবাই কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে এআইকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু একই এআই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাগুলোর আউটসোর্সিং বাড়িয়ে দিচ্ছে এশিয়ায়। এর ফলে পাকিস্তান, ভারত ও ফিলিপাইনে আউটসোর্সিং কর্মীসংখ্যা গত পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন—দক্ষিণ এশিয়ার কম খরচের দক্ষ জনবলকে এআই সহজে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ নিল মাহোনি বলেন, ‘যে কাজ খুব সহজ এবং ব্যয়বহুল—সেই কাজই প্রথমে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। এশিয়ার শ্রমবাজার এখনো খুব সস্তা।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে এআই–চালিত ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ মডেল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে—যেখানে মানুষ এআইয়ের ভুল সংশোধন করবে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের নেক্সটওয়েলথ কোম্পানির কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা এমন দোকানে নজরদারি করে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ক্যাশিয়ার ছাড়াই কেনাকাটা করা যায়। কোনো ভুল হলে কয়েক সেকেন্ডেই মানুষ যাচাই করে তা সংশোধন করে।
এই সব কাজ ভারতের ছোট শহরের যুবকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। কারুর শহরের সেই কর্মী ধারাণি চন্দ্রশেখর জানান, পারিবারিক কারণে তিনি কখনো বড় শহরে চাকরি খোঁজেননি, কিন্তু এখন তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে পারছেন নিজের শহরেই। অন্যদিকে তাঁর সহকর্মী ধনাসীলন পলানিয়াপ্পান এই শিল্পে কাজ করে জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশযাত্রার সুযোগ পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি চীনের কিংদাও শহরে গিয়েছিলেন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে।
এআই যতই উন্নত হোক, শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেটা অ্যানোটেশনের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না। কারণ বাস্তব জগতে কাজ করতে গেলে এআইকে সব সময় মানুষের সুপারভিশনের প্রয়োজন হবে। এমনকি মেটার মতো কোম্পানি যখন স্কেল এআই–এ ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তখন তা প্রমাণ করে এই ক্ষেত্রের গুরুত্ব কমছে না।
তবুও অনেক কর্মীর মনের ভেতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এআই কি একদিন আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলবে? কারুরের তরুণ নবিন বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তির যুগের সবচেয়ে বড় ঢেউয়ের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু মনে মনে একটা ভয় তো থেকেই যায়—এআই যেন আমাদের জায়গা দখল না করে।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন, তখন একই অফিসে বসে সৌম্যা বসরমালিংগম বিভিন্ন ভিডিওর ঘরানা, চরিত্রের মুড ও টোন বিশ্লেষণ করছেন। আসলে তাঁরা দুজনই এমন এক শিল্পের কর্মী, যে শিল্প বিশ্বজুড়ে এআই মডেল প্রশিক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য ছাঁকছে ও বিশ্লেষণ করছে।
এই কাজকে প্রযুক্তি জগতে বলা হয় ডেটা অ্যানোটেশন—যেখানে মানুষ ছবি, ভিডিও ও টেক্সট ডেটাকে ট্যাগ করে এআইয়ের শেখার উপযোগী করে তোলে। ভারত এখন এই শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। ২০২০ সালে যেখানে মাত্র ৭০ হাজার মানুষ এই খাতে কাজ করত, ২০৩০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ১০ লাখে। একই সময়ে এই বাজারের মূল্য বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হতে পরে বলে জানিয়েছে ভারতের সফটওয়্যার শিল্প সংস্থা নাস্কম।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই ৭১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি চাকরি হারানোর কারণ হিসেবে সরাসরি এআইকে দায়ী করা হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকায় এআই–সম্পর্কিত ছাঁটাইয়ের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি—মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন, মেটা—সবাই কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে এআইকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু একই এআই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাগুলোর আউটসোর্সিং বাড়িয়ে দিচ্ছে এশিয়ায়। এর ফলে পাকিস্তান, ভারত ও ফিলিপাইনে আউটসোর্সিং কর্মীসংখ্যা গত পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন—দক্ষিণ এশিয়ার কম খরচের দক্ষ জনবলকে এআই সহজে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ নিল মাহোনি বলেন, ‘যে কাজ খুব সহজ এবং ব্যয়বহুল—সেই কাজই প্রথমে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। এশিয়ার শ্রমবাজার এখনো খুব সস্তা।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে এআই–চালিত ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ মডেল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে—যেখানে মানুষ এআইয়ের ভুল সংশোধন করবে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের নেক্সটওয়েলথ কোম্পানির কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা এমন দোকানে নজরদারি করে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ক্যাশিয়ার ছাড়াই কেনাকাটা করা যায়। কোনো ভুল হলে কয়েক সেকেন্ডেই মানুষ যাচাই করে তা সংশোধন করে।
এই সব কাজ ভারতের ছোট শহরের যুবকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। কারুর শহরের সেই কর্মী ধারাণি চন্দ্রশেখর জানান, পারিবারিক কারণে তিনি কখনো বড় শহরে চাকরি খোঁজেননি, কিন্তু এখন তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে পারছেন নিজের শহরেই। অন্যদিকে তাঁর সহকর্মী ধনাসীলন পলানিয়াপ্পান এই শিল্পে কাজ করে জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশযাত্রার সুযোগ পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি চীনের কিংদাও শহরে গিয়েছিলেন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে।
এআই যতই উন্নত হোক, শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেটা অ্যানোটেশনের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না। কারণ বাস্তব জগতে কাজ করতে গেলে এআইকে সব সময় মানুষের সুপারভিশনের প্রয়োজন হবে। এমনকি মেটার মতো কোম্পানি যখন স্কেল এআই–এ ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তখন তা প্রমাণ করে এই ক্ষেত্রের গুরুত্ব কমছে না।
তবুও অনেক কর্মীর মনের ভেতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এআই কি একদিন আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলবে? কারুরের তরুণ নবিন বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তির যুগের সবচেয়ে বড় ঢেউয়ের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু মনে মনে একটা ভয় তো থেকেই যায়—এআই যেন আমাদের জায়গা দখল না করে।’

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর...
২১ জুন ২০২৫
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ওয়াশিংটনে যখনই কোনো নতুন প্রশাসন আসে, সঙ্গে করে তারা নিজস্ব মতাদর্শগত অবস্থানও নিয়ে আসে। আর সঙ্গে অনিবার্যভাবে তারা এমন এক দলিল প্রকাশ করে, যেখানে তাদের জাতীয় নিরাপত্তানীতির ধারণাগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএস) সর্বশেষ সংস্করণটিও সেই চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। তবে এর তাৎপর্য আরও গভীরে—আগের কৌশলগত দলিলগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী যুগের বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির ঐকমত্যের সামান্য হেরফেরকে প্রতিফলিত করে থাকলেও এই দলিল সেই ঐকমত্য থেকে এক নাটকীয় বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে।
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে এবং আমেরিকার পরিবর্তিত মানসিকতাও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।
এশিয়ার জন্য এই দলিল এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, যেখান থেকে বোঝা যায়—দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে দেখছে, কীভাবে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচার করছে ও চীনকে মূল্যায়ন করছে এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এই যুগে আমেরিকার নেতৃত্বকে কীভাবে কল্পনা করছে।
একদিকে এনএসএসে মাগা জাতীয়তাবাদের সেই পরিচিত ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে—যা সংযম, জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন লক্ষ্যযুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করার এক মিশ্রণ। দলিলটি এমন একটি কৌশলের ডাক দিয়েছে, যা ঐতিহ্যগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। তার বদলে এটি সবার ওপরে আমেরিকার জন্য যা কাজ করে বা সহজ কথায়, আমেরিকা ফার্স্ট—তা দিয়েই অনুপ্রাণিত।
নতুন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যের বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে আঞ্চলিক স্বার্থের পুনর্নবীকরণের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থের এক সংকীর্ণ সংজ্ঞার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। যেসব দেশ বহুদিন ধরে ওয়াশিংটনের উপদেশ দেওয়ার ধরনে ক্ষুব্ধ ছিল, তাদের জন্য এই পরিবর্তন একটি ‘স্বাগত জানানো’ আদর্শিক পুনর্বিন্যাস।
নতুন মার্কিন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য একই সঙ্গে সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ—দুটোই নিয়ে এসেছে। প্রথম ইতিবাচক দিকটি হলো—এই দলিলে এশিয়া বা আধুনিক কৌশলগত ভাষায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পশ্চিমা গোলার্ধের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একেবারে শীর্ষে স্থান পেয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধ ট্রাম্পের কৌশলের মূল কেন্দ্রে রয়েছে। এশিয়ার ওপর এই মনোযোগ ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়া পিভট’, ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ এবং বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে। চীনের উত্থান ও এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে এই মনোযোগ অনিবার্য ছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো একক শক্তি যদি এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তার বিরোধিতা করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলের দীর্ঘকালীন মূল প্রতিপাদ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এ বিষয়ের পুনরাবৃত্তি চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন এশিয়ার রাজধানীগুলোতে স্বাগত জানানো হবে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই কৌশল এশিয়াকে সেই চরম কঠোর সমালোচনা থেকে রেহাই দিয়েছে, যা তিনি ইউরোপের ওপর বর্ষণ করেছেন। এই নথিতে ইউরোপকে অবক্ষয়, নির্ভরশীলতা ও উদারনৈতিক বাড়াবাড়ির জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এশিয়াকে স্পষ্ট কৌশলগত সম্মান দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। ইউরোপকে ‘পশ্চিমা সভ্যতাকে রক্ষা’ করার জন্য সামরিক সক্রিয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিপরীতে ইন্দো-প্যাসিফিক ও মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ও বাছাই করা হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। এর কারণ এই নয় যে, ট্রাম্প ইউরোপের চেয়ে এশিয়াকে বেশি পছন্দ করেন। বরং, মাগার আদর্শিক যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও উদারনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার অভ্যন্তরের একটি গৃহযুদ্ধ। এশিয়া আপাতত এই বিবাদের বাইরে রয়েছে।
তৃতীয়ত, এশিয়া আন্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর আমেরিকান সমালোচনার শিকার কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমলাতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা মাগার ক্রোধের জন্ম দেয়; কিন্তু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি থাকা এশিয়া এখন ট্রাম্পীয় বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও লেনদেনভিত্তিক সহযোগিতার ওপর কেন্দ্রীভূত। মানবাধিকার ও সামাজিক মানদণ্ডের ওপর উদার ও আন্তর্জাতিকতাবাদী জোর সব সময়ই অধিকাংশ এশীয় সরকারের কাছে নেতিবাচকভাবে গৃহীত হয়েছে। কেবল চীনই নয়, এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অথচ গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী সমাজগুলোতেও একইভাবে মূল্যায়িত হয়েছে এই মার্কিন অবস্থান। তাদের কাছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর এবং বিশ্বকে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর এক সম্প্রদায় হিসেবে দেখার ধারণাটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।
চতুর্থত, বেইজিংসহ কিছু এশীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার বাগাড়ম্বরকে অবিশ্বাস করেছে। এই কথা পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে সান্ত্বনাদায়ক শোনালেও এশিয়ার কিছু অংশে এটি জবরদস্তিমূলক বা ভন্ডামি বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে, ওয়াশিংটন সব সময় তাদের উচ্চারিত নিয়মগুলো মেনে চলত না। ট্রাম্পের বাস্তববাদ ও স্বার্থের ওপর জোর এবং কূটনীতিকে বাণিজ্যনীতি হিসেবে দেখা ব্যাপকভাবে বিশ্বজুড়েই অনুরণিত হচ্ছে। আদর্শের ওপর উদারনৈতিক বাগাড়ম্বরে সন্দিহান এশীয় সরকারগুলো লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতায় স্বচ্ছন্দ। এই গত শরৎকালেও ট্রাম্পের এশিয়া ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। লেনদেনভিত্তিক একটি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝা, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং দর-কষাকষি করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
পঞ্চমত, চীনকে প্রায় সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি ‘পারস্পরিক সুবিধাজনক অর্থনৈতিক সম্পর্কের’ আহ্বানকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেক এশীয় রাষ্ট্র। ১৯৮০-এর দশক থেকে সিনো–মার্কিন ‘ঐক্য’ থেকে এশিয়ার একটি বৃহৎ অংশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে এবং তারা একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে অস্বস্তিতে আছে। ওয়াশিংটন বা বেইজিংয়ের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে না চাওয়ার যে ব্যাপক অনুভূতি, তা চীনকে প্রায় সমকক্ষ হিসেবে পুনরায় যুক্ত করার ট্রাম্পের আপাত ইচ্ছার মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়। ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বেশি দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আহ্বান তাদের নিজস্ব কৌশলগত পরিচিতি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।
তবে এই সুসংবাদের আড়ালে কিছু উদ্বেগজনক দিকও রয়েছে, আছে ঝুঁকিও। প্রথমত, যদিও ট্রাম্পের সার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, তবু এশিয়া খুব ভালোভাবেই ওয়াশিংটনের অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর কাঠামোগত প্রলোভন সম্পর্কে সচেতন। এটি নীতি থেকে নয়, বরং ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত। বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করে, কারণ, তারা তা করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই এটির দাবি করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকি আমেরিকানদের শাস্তি দেওয়া ও জবরদস্তি করার স্থায়ী প্রবৃত্তিকেই তুলে ধরে। সংযমের ঘোষণা সেই প্রবৃত্তিকে দূর করবে না।
দ্বিতীয়ত, যদিও ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি এশিয়ায় অনুরণিত হয়, কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প সাধারণ লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে তাঁর বিশাল নতুন বিনিয়োগের দাবিগুলো এমন শর্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, যা কেবল চাঁদাবাজির মতো বলেই মনে করা যেতে পারে। একই রকম উদ্বেগজনক ছিল সাম্প্রতিক আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে চাপানো শর্তাবলি। এই ব্যবস্থাগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানানোর সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে। বরং এগুলো ক্ষমতাগত অসামঞ্জস্যতা ও চাপকেই প্রতিফলিত করে। এশীয় রাষ্ট্রগুলো লেনদেনভিত্তিক নীতিকে স্বাগত জানাতে পারে, কিন্তু তারা জবরদস্তিমূলক ‘বাণিজ্যবাদে’ ক্ষুব্ধ।
তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনের নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা বর্জন এশীয় দেশগুলোর বাস্তববাদীদের খুশি করতে পারে। তবে এই বিসর্জনেরও মূল্য আছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকার করে, তবে এশিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর করুণার পাত্র হয়ে উঠবে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়ার বিষয়টি চীনা সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিষয়ে অবিলম্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ছোট এশীয় রাষ্ট্রগুলো বিস্তৃত, অনুমানযোগ্য নিয়ম চায়—তারা উদার আদর্শবাদী বলে নয়, বরং নিয়মগুলো দুর্বলকে শক্তিশালী থেকে রক্ষা করে বলে এটা চায়। এর পাশাপাশি, উদার মূল্যবোধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজ আন্দোলনগুলোকে হতাশ করবে, যারা দমন-পীড়নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকত।
চতুর্থত, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর ট্রাম্পের জোর বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির মধ্যে সম্ভাব্য আপস নিয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করে, কিন্তু অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা ও সামরিক প্রতিযোগিতার মধ্যকার টানাপোড়েন বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান। চীনের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
নয়া নিরাপত্তা কৌশল: চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর যুক্তরাষ্ট্রেরওয়াশিংটন ও তার আঞ্চলিক অংশীদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চীনা সক্ষমতা বাড়বে। মিত্রদের কাছে ট্রাম্পের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দাবি কিছু দেশকে চরম সমাধানের দিকে ঠেলে দিতে পারে—যার মধ্যে পারমাণবিক বিকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করাও অন্তর্ভুক্ত। চীন যে ক্রমশ তাঁর পক্ষে সামরিক ভারসাম্যকে স্থানান্তরিত করছে, এই উপলব্ধিতে এই অঞ্চলের উদ্বেগ আরও তীব্র হচ্ছে।
পঞ্চমত, তাইওয়ান নিয়ে এনএসএসের ভাষার তীব্র আলোচনা এশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক ফাটলকে তুলে ধরে। তবু কেবল আভিধানিক বিতর্ক থেকে বোঝা যায় না যে, কোনো প্রকৃত সংকটে ট্রাম্প বা অন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কীভাবে আচরণ করবেন। এ সময়ে আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে। চীনা আক্রমণকে জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচির মন্তব্যের পর ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে যে পাল্টা চাপ দেওয়া হয়েছিল, তা একটি সতর্কসংকেত। এমনকি ট্রাম্প যখন এশীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র এর বিনিময়ে কী সরবরাহ করবে, সে বিষয়ে তিনি কম স্পষ্টতা দিচ্ছেন। তাই এই কৌশলগত অস্পষ্টতা এখন প্রতিশ্রুতির বদলে অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে এশিয়া—ইউরোপের মতো নয়—যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি সময় ও সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি গুরুতর। রাশিয়ার বিপরীতে—যার শক্তিমত্তা ইউরোপের তুলনায় সীমিত—সেখানে চীন এশিয়ার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ওয়াশিংটন কীভাবে বেইজিংয়ের সঙ্গে তার জটিল সম্পর্ককে পরিচালিত করবে—যে সম্পর্ক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা দ্বারা চিহ্নিত। চীনের প্রতি মার্কিন নীতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে মারাত্মক পরিণতি আনতে পারে।
এশিয়াকে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা ট্রাম্পবাদের কৌশলগত বিবর্তনের গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা এশিয়ার নেই বললেই চলে। ইউরোপীয়রা হয়তো উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং আটলান্টিকতাবাদের পুনরুদ্ধারের আশা করতে পারেন, এশিয়ার সেই বিলাসিতা নেই। চীন যখন বিশাল আকার ধারণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক অভিমুখ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে, তখন এশিয়াকে স্বনির্ভরতার কৌশল অবলম্বন করতে হবে—জাতীয় সক্ষমতা জোরদার করা, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অংশীদারত্ব প্রসারিত করা এবং নমনীয় জোট গঠন করা।
একই সময়ে, এই কৌশলপত্র ওয়াশিংটন–সমর্থিত একটি ‘দায়িত্ব বণ্টন নেটওয়ার্ক’-এর প্রস্তাব করেছে। যেসব দেশ তাদের নিজেদের আশপাশে নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছায় আরও বেশি দায়িত্ব নেবে—তাদের বাণিজ্যিক বিষয়ে আরও অনুকূল আচরণ, প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও প্রতিরক্ষা সংগ্রহের মাধ্যমে—যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকবে।’ এশিয়ার এই প্রস্তাবের সুযোগগুলো কাজে লাগানো উচিত।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

ওয়াশিংটনে যখনই কোনো নতুন প্রশাসন আসে, সঙ্গে করে তারা নিজস্ব মতাদর্শগত অবস্থানও নিয়ে আসে। আর সঙ্গে অনিবার্যভাবে তারা এমন এক দলিল প্রকাশ করে, যেখানে তাদের জাতীয় নিরাপত্তানীতির ধারণাগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএস) সর্বশেষ সংস্করণটিও সেই চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। তবে এর তাৎপর্য আরও গভীরে—আগের কৌশলগত দলিলগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী যুগের বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির ঐকমত্যের সামান্য হেরফেরকে প্রতিফলিত করে থাকলেও এই দলিল সেই ঐকমত্য থেকে এক নাটকীয় বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে।
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে এবং আমেরিকার পরিবর্তিত মানসিকতাও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।
এশিয়ার জন্য এই দলিল এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, যেখান থেকে বোঝা যায়—দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে দেখছে, কীভাবে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচার করছে ও চীনকে মূল্যায়ন করছে এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এই যুগে আমেরিকার নেতৃত্বকে কীভাবে কল্পনা করছে।
একদিকে এনএসএসে মাগা জাতীয়তাবাদের সেই পরিচিত ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে—যা সংযম, জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন লক্ষ্যযুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করার এক মিশ্রণ। দলিলটি এমন একটি কৌশলের ডাক দিয়েছে, যা ঐতিহ্যগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। তার বদলে এটি সবার ওপরে আমেরিকার জন্য যা কাজ করে বা সহজ কথায়, আমেরিকা ফার্স্ট—তা দিয়েই অনুপ্রাণিত।
নতুন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যের বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে আঞ্চলিক স্বার্থের পুনর্নবীকরণের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থের এক সংকীর্ণ সংজ্ঞার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। যেসব দেশ বহুদিন ধরে ওয়াশিংটনের উপদেশ দেওয়ার ধরনে ক্ষুব্ধ ছিল, তাদের জন্য এই পরিবর্তন একটি ‘স্বাগত জানানো’ আদর্শিক পুনর্বিন্যাস।
নতুন মার্কিন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য একই সঙ্গে সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ—দুটোই নিয়ে এসেছে। প্রথম ইতিবাচক দিকটি হলো—এই দলিলে এশিয়া বা আধুনিক কৌশলগত ভাষায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পশ্চিমা গোলার্ধের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একেবারে শীর্ষে স্থান পেয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধ ট্রাম্পের কৌশলের মূল কেন্দ্রে রয়েছে। এশিয়ার ওপর এই মনোযোগ ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়া পিভট’, ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ এবং বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে। চীনের উত্থান ও এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে এই মনোযোগ অনিবার্য ছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো একক শক্তি যদি এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তার বিরোধিতা করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলের দীর্ঘকালীন মূল প্রতিপাদ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এ বিষয়ের পুনরাবৃত্তি চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন এশিয়ার রাজধানীগুলোতে স্বাগত জানানো হবে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই কৌশল এশিয়াকে সেই চরম কঠোর সমালোচনা থেকে রেহাই দিয়েছে, যা তিনি ইউরোপের ওপর বর্ষণ করেছেন। এই নথিতে ইউরোপকে অবক্ষয়, নির্ভরশীলতা ও উদারনৈতিক বাড়াবাড়ির জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এশিয়াকে স্পষ্ট কৌশলগত সম্মান দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। ইউরোপকে ‘পশ্চিমা সভ্যতাকে রক্ষা’ করার জন্য সামরিক সক্রিয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিপরীতে ইন্দো-প্যাসিফিক ও মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ও বাছাই করা হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। এর কারণ এই নয় যে, ট্রাম্প ইউরোপের চেয়ে এশিয়াকে বেশি পছন্দ করেন। বরং, মাগার আদর্শিক যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও উদারনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার অভ্যন্তরের একটি গৃহযুদ্ধ। এশিয়া আপাতত এই বিবাদের বাইরে রয়েছে।
তৃতীয়ত, এশিয়া আন্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর আমেরিকান সমালোচনার শিকার কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমলাতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা মাগার ক্রোধের জন্ম দেয়; কিন্তু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি থাকা এশিয়া এখন ট্রাম্পীয় বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও লেনদেনভিত্তিক সহযোগিতার ওপর কেন্দ্রীভূত। মানবাধিকার ও সামাজিক মানদণ্ডের ওপর উদার ও আন্তর্জাতিকতাবাদী জোর সব সময়ই অধিকাংশ এশীয় সরকারের কাছে নেতিবাচকভাবে গৃহীত হয়েছে। কেবল চীনই নয়, এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অথচ গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী সমাজগুলোতেও একইভাবে মূল্যায়িত হয়েছে এই মার্কিন অবস্থান। তাদের কাছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর এবং বিশ্বকে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর এক সম্প্রদায় হিসেবে দেখার ধারণাটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।
চতুর্থত, বেইজিংসহ কিছু এশীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার বাগাড়ম্বরকে অবিশ্বাস করেছে। এই কথা পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে সান্ত্বনাদায়ক শোনালেও এশিয়ার কিছু অংশে এটি জবরদস্তিমূলক বা ভন্ডামি বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে, ওয়াশিংটন সব সময় তাদের উচ্চারিত নিয়মগুলো মেনে চলত না। ট্রাম্পের বাস্তববাদ ও স্বার্থের ওপর জোর এবং কূটনীতিকে বাণিজ্যনীতি হিসেবে দেখা ব্যাপকভাবে বিশ্বজুড়েই অনুরণিত হচ্ছে। আদর্শের ওপর উদারনৈতিক বাগাড়ম্বরে সন্দিহান এশীয় সরকারগুলো লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতায় স্বচ্ছন্দ। এই গত শরৎকালেও ট্রাম্পের এশিয়া ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। লেনদেনভিত্তিক একটি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝা, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং দর-কষাকষি করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
পঞ্চমত, চীনকে প্রায় সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি ‘পারস্পরিক সুবিধাজনক অর্থনৈতিক সম্পর্কের’ আহ্বানকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেক এশীয় রাষ্ট্র। ১৯৮০-এর দশক থেকে সিনো–মার্কিন ‘ঐক্য’ থেকে এশিয়ার একটি বৃহৎ অংশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে এবং তারা একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে অস্বস্তিতে আছে। ওয়াশিংটন বা বেইজিংয়ের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে না চাওয়ার যে ব্যাপক অনুভূতি, তা চীনকে প্রায় সমকক্ষ হিসেবে পুনরায় যুক্ত করার ট্রাম্পের আপাত ইচ্ছার মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়। ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বেশি দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আহ্বান তাদের নিজস্ব কৌশলগত পরিচিতি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।
তবে এই সুসংবাদের আড়ালে কিছু উদ্বেগজনক দিকও রয়েছে, আছে ঝুঁকিও। প্রথমত, যদিও ট্রাম্পের সার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, তবু এশিয়া খুব ভালোভাবেই ওয়াশিংটনের অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর কাঠামোগত প্রলোভন সম্পর্কে সচেতন। এটি নীতি থেকে নয়, বরং ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত। বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করে, কারণ, তারা তা করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই এটির দাবি করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকি আমেরিকানদের শাস্তি দেওয়া ও জবরদস্তি করার স্থায়ী প্রবৃত্তিকেই তুলে ধরে। সংযমের ঘোষণা সেই প্রবৃত্তিকে দূর করবে না।
দ্বিতীয়ত, যদিও ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি এশিয়ায় অনুরণিত হয়, কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প সাধারণ লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে তাঁর বিশাল নতুন বিনিয়োগের দাবিগুলো এমন শর্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, যা কেবল চাঁদাবাজির মতো বলেই মনে করা যেতে পারে। একই রকম উদ্বেগজনক ছিল সাম্প্রতিক আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে চাপানো শর্তাবলি। এই ব্যবস্থাগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানানোর সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে। বরং এগুলো ক্ষমতাগত অসামঞ্জস্যতা ও চাপকেই প্রতিফলিত করে। এশীয় রাষ্ট্রগুলো লেনদেনভিত্তিক নীতিকে স্বাগত জানাতে পারে, কিন্তু তারা জবরদস্তিমূলক ‘বাণিজ্যবাদে’ ক্ষুব্ধ।
তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনের নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা বর্জন এশীয় দেশগুলোর বাস্তববাদীদের খুশি করতে পারে। তবে এই বিসর্জনেরও মূল্য আছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকার করে, তবে এশিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর করুণার পাত্র হয়ে উঠবে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়ার বিষয়টি চীনা সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিষয়ে অবিলম্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ছোট এশীয় রাষ্ট্রগুলো বিস্তৃত, অনুমানযোগ্য নিয়ম চায়—তারা উদার আদর্শবাদী বলে নয়, বরং নিয়মগুলো দুর্বলকে শক্তিশালী থেকে রক্ষা করে বলে এটা চায়। এর পাশাপাশি, উদার মূল্যবোধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজ আন্দোলনগুলোকে হতাশ করবে, যারা দমন-পীড়নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকত।
চতুর্থত, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর ট্রাম্পের জোর বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির মধ্যে সম্ভাব্য আপস নিয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করে, কিন্তু অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা ও সামরিক প্রতিযোগিতার মধ্যকার টানাপোড়েন বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান। চীনের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
নয়া নিরাপত্তা কৌশল: চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর যুক্তরাষ্ট্রেরওয়াশিংটন ও তার আঞ্চলিক অংশীদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চীনা সক্ষমতা বাড়বে। মিত্রদের কাছে ট্রাম্পের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দাবি কিছু দেশকে চরম সমাধানের দিকে ঠেলে দিতে পারে—যার মধ্যে পারমাণবিক বিকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করাও অন্তর্ভুক্ত। চীন যে ক্রমশ তাঁর পক্ষে সামরিক ভারসাম্যকে স্থানান্তরিত করছে, এই উপলব্ধিতে এই অঞ্চলের উদ্বেগ আরও তীব্র হচ্ছে।
পঞ্চমত, তাইওয়ান নিয়ে এনএসএসের ভাষার তীব্র আলোচনা এশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক ফাটলকে তুলে ধরে। তবু কেবল আভিধানিক বিতর্ক থেকে বোঝা যায় না যে, কোনো প্রকৃত সংকটে ট্রাম্প বা অন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কীভাবে আচরণ করবেন। এ সময়ে আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে। চীনা আক্রমণকে জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচির মন্তব্যের পর ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে যে পাল্টা চাপ দেওয়া হয়েছিল, তা একটি সতর্কসংকেত। এমনকি ট্রাম্প যখন এশীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র এর বিনিময়ে কী সরবরাহ করবে, সে বিষয়ে তিনি কম স্পষ্টতা দিচ্ছেন। তাই এই কৌশলগত অস্পষ্টতা এখন প্রতিশ্রুতির বদলে অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে এশিয়া—ইউরোপের মতো নয়—যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি সময় ও সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি গুরুতর। রাশিয়ার বিপরীতে—যার শক্তিমত্তা ইউরোপের তুলনায় সীমিত—সেখানে চীন এশিয়ার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ওয়াশিংটন কীভাবে বেইজিংয়ের সঙ্গে তার জটিল সম্পর্ককে পরিচালিত করবে—যে সম্পর্ক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা দ্বারা চিহ্নিত। চীনের প্রতি মার্কিন নীতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে মারাত্মক পরিণতি আনতে পারে।
এশিয়াকে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা ট্রাম্পবাদের কৌশলগত বিবর্তনের গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা এশিয়ার নেই বললেই চলে। ইউরোপীয়রা হয়তো উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং আটলান্টিকতাবাদের পুনরুদ্ধারের আশা করতে পারেন, এশিয়ার সেই বিলাসিতা নেই। চীন যখন বিশাল আকার ধারণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক অভিমুখ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে, তখন এশিয়াকে স্বনির্ভরতার কৌশল অবলম্বন করতে হবে—জাতীয় সক্ষমতা জোরদার করা, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অংশীদারত্ব প্রসারিত করা এবং নমনীয় জোট গঠন করা।
একই সময়ে, এই কৌশলপত্র ওয়াশিংটন–সমর্থিত একটি ‘দায়িত্ব বণ্টন নেটওয়ার্ক’-এর প্রস্তাব করেছে। যেসব দেশ তাদের নিজেদের আশপাশে নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছায় আরও বেশি দায়িত্ব নেবে—তাদের বাণিজ্যিক বিষয়ে আরও অনুকূল আচরণ, প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও প্রতিরক্ষা সংগ্রহের মাধ্যমে—যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকবে।’ এশিয়ার এই প্রস্তাবের সুযোগগুলো কাজে লাগানো উচিত।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর...
২১ জুন ২০২৫
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
২ দিন আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’। বহু চীনা নাগরিকের কাছেও অপরিচিত এই শব্দটির অর্থ হলো—সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো বার্তা বা আদেশ পৌঁছে দেওয়া। এবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল শীর্ষ নির্দেশেই—অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আদেশে।
তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সি চিনপিং সরাসরি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার ফোনালাপে সি অর্ধেক সময় ব্যয় করেন তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান বুঝিয়ে বলতে। ট্রাম্প পরে মন্তব্য করেন—সির উপস্থিতিতে পাশে থাকা কর্মকর্তারা ভয়ে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সির এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ডাইতো বুনকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাশি সুজুকির বক্তব্য অনুযায়ী, সি চিনপিং বিশ্বাস করেন তাইওয়ান ইস্যুর মূল উৎস ১৮৯৪-৯৫ সালের প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অনেক শক্তিশালী কুইং সাম্রাজ্য সহজেই পরাজিত হয় উদীয়মান জাপানের কাছে এবং সেই পরাজয়ের পরই তাইওয়ান চলে যায় জাপানের অধীনে।
২০১৮ সালে সির লিউগং দ্বীপ সফরও এই ঐতিহাসিক ক্ষতের স্মরণ। এ দ্বীপেই অবস্থান করত বেইয়াং নৌবহর, যেটিকে একসময় এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ১৮৯৫ সালে জাপানের হামলায় তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। সির সফর ছিল ওই পরাজয় মনে রাখার বার্তা, যেন আবারও চীন দুর্বলতা প্রদর্শন করে একই পরিণতির শিকার না হয়।
বর্তমানে পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর বিমানের দিকে চীনা যুদ্ধবিমান রাডার লক্ষ্য করে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। চীন অভিযোগ করছে, তাকাইচির মন্তব্য দিয়ে জাপান তাইওয়ান প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে জাপানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—এমন ব্যাখ্যা অতিরঞ্জিত; তাদের না ইচ্ছা আছে, না সক্ষমতা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অচলাবস্থা কাটাতে সবচেয়ে জরুরি হলো সংলাপের সুযোগ তৈরি করা। অবিশ্বাস দূর করে আলোচনার টেবিলে ফিরে এলে তবেই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সি চিনপিংয়ের রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি অচলাবস্থাতেই থাকতে পারে।

চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’। বহু চীনা নাগরিকের কাছেও অপরিচিত এই শব্দটির অর্থ হলো—সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো বার্তা বা আদেশ পৌঁছে দেওয়া। এবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল শীর্ষ নির্দেশেই—অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আদেশে।
তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সি চিনপিং সরাসরি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার ফোনালাপে সি অর্ধেক সময় ব্যয় করেন তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান বুঝিয়ে বলতে। ট্রাম্প পরে মন্তব্য করেন—সির উপস্থিতিতে পাশে থাকা কর্মকর্তারা ভয়ে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সির এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ডাইতো বুনকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাশি সুজুকির বক্তব্য অনুযায়ী, সি চিনপিং বিশ্বাস করেন তাইওয়ান ইস্যুর মূল উৎস ১৮৯৪-৯৫ সালের প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অনেক শক্তিশালী কুইং সাম্রাজ্য সহজেই পরাজিত হয় উদীয়মান জাপানের কাছে এবং সেই পরাজয়ের পরই তাইওয়ান চলে যায় জাপানের অধীনে।
২০১৮ সালে সির লিউগং দ্বীপ সফরও এই ঐতিহাসিক ক্ষতের স্মরণ। এ দ্বীপেই অবস্থান করত বেইয়াং নৌবহর, যেটিকে একসময় এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ১৮৯৫ সালে জাপানের হামলায় তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। সির সফর ছিল ওই পরাজয় মনে রাখার বার্তা, যেন আবারও চীন দুর্বলতা প্রদর্শন করে একই পরিণতির শিকার না হয়।
বর্তমানে পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর বিমানের দিকে চীনা যুদ্ধবিমান রাডার লক্ষ্য করে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। চীন অভিযোগ করছে, তাকাইচির মন্তব্য দিয়ে জাপান তাইওয়ান প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে জাপানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—এমন ব্যাখ্যা অতিরঞ্জিত; তাদের না ইচ্ছা আছে, না সক্ষমতা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অচলাবস্থা কাটাতে সবচেয়ে জরুরি হলো সংলাপের সুযোগ তৈরি করা। অবিশ্বাস দূর করে আলোচনার টেবিলে ফিরে এলে তবেই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সি চিনপিংয়ের রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি অচলাবস্থাতেই থাকতে পারে।

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর...
২১ জুন ২০২৫
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
২ দিন আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে