Ajker Patrika

মিয়ানমারের বিরল খনিজ কি চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ত্রিমুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে

আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২: ২৩
মিয়ানমারের বিরল খনিজ কি চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ত্রিমুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে

২১শ শতকের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মূল হাতিয়ার হচ্ছে প্রযুক্তি। আর প্রযুক্তিকে সচল রাখে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস বা বিরল খনিজ ধাতু। ১৭টি ধাতুর এই গ্রুপ ছাড়া আধুনিক অর্থনীতি কার্যত অসম্ভব। ডিসপ্রসিয়াম ও টার্বিয়ামের মতো ভারী চুম্বক তৈরি করে বৈদ্যুতিক মোটর, সেমিকন্ডাক্টর, রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র, স্মার্টফোন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

চীন বর্তমানে বিশ্বের বিরল খনিজ উত্তোলনের প্রায় ৭০ শতাংশ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক চুম্বক উৎপাদনের প্রায় পুরোটা বেইজিংয়ের দখলে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপ ও ভারত চীনের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল।

চীন শুধু রপ্তানি নয়, বরং রপ্তানির শর্তও ব্যবহার করছে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে তারা হঠাৎ করে বিরল খনিজ ও চুম্বক রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ভারতের বৈদ্যুতিক গাড়ি ও প্রতিরক্ষা শিল্পে তাৎক্ষণিক সংকট দেখা দেয়।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যের চিপওয়ে-পাংওয়া খনি অঞ্চলের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ হেভি রেয়ার আর্থ মজুত। ২০২৪ সালে এটি দখল করে নেয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ)।

১৯৬১ সালে কাচিন জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গঠিত হয় কেআইএ। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তারা জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। এখন তাদের হাতে থাকা খনিগুলো শুধু অর্থনৈতিক সম্পদই নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার।

চীনের ইউনান প্রদেশের নিকটবর্তী হওয়ায় এ খনিজ সহজেই চীনে প্রবাহিত হয়। কিন্তু ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি লজিস্টিক মায়া।

বহুদিন ধরে ভারত অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বাড়াতে চাইছে। মিয়ানমার এই নীতির কেন্দ্রবিন্দু।

রয়টার্সের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের খনি মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত আইআরইএল ও বেসরকারি মিডওয়েস্ট অ্যাডভান্সি ম্যাটেরিয়ালসকে কাচিন থেকে খনিজ নমুনা সংগ্রহে নির্দেশ দিয়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ভারতের জন্য বিরল ঘটনা হলেও, তারা চীনের একচেটিয়া দখল ভাঙতে অস্বাভাবিক পথেও হাঁটছে।

কিন্তু ভারতের সমস্যা হলো— ভারী বিরল খনিজ প্রক্রিয়াজাত করার প্রযুক্তি ও অবকাঠামো নেই। এ জন্য তারা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য আরও বিস্তৃত। তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে চাইছে। এর অংশ হিসেবেই মিয়ানমারের খনিজে তাদের আগ্রহ। ট্রাম্প প্রশাসন থেকেই মার্কিন কর্মকর্তারা মিয়ানমারের বিরল খনিজ নিয়ে প্রস্তাব শুনেছেন।

এখন তারা ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে একটি বিকল্প সরবরাহ শৃঙ্খল গড়তে চাইছে। এই উদ্যোগ কার্যকর হলে চীনের একচেটিয়া দখল নড়বড়ে হবে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) মিয়ানমারের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাতে পারে চীন, যা ভারত মহাসাগরে তাদের সরাসরি প্রবেশের পথ খুলে দেয়।

কাচিনের খনিজ শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, বরং BRI-এর সাফল্য টিকিয়ে রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই চীন কোনোভাবেই চাইবে না ভারত-যুক্তরাষ্ট্র এখানে প্রভাব বিস্তার করুক।

এখন প্রশ্ন—মিয়ানমার কি চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিমুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে?

চীন: সহজ ভৌগোলিক প্রবেশাধিকার, প্রযুক্তি ও অর্থায়ন। ভারত: বিকল্প সরবরাহের জরুরি প্রয়োজন, তবে অবকাঠামো সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র: কৌশলগত প্রতিযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি বাস্তবায়ন।

এ প্রতিযোগিতায় কেআইএ কার্যত ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠেছে। তারা চীনের ওপর নির্ভরশীল হলেও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন দর-কষাকষির সুযোগ পাচ্ছে। বিরল খনিজ আহরণে ব্যবহৃত ইন-সিচু লিচিং পদ্ধতি ভয়াবহ পরিবেশদূষণ ঘটায়। মাটি-পানি দূষিত হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে। শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের খবরও রয়েছে।

অর্থাৎ, খনিজ দৌড়ে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে মানবাধিকার ও পরিবেশের হুমকি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে, তবে সশস্ত্র সংঘাতের ভেতরে এসব প্রশ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সরাসরি এই প্রতিযোগিতায় নেই, তবে প্রভাব ফেলবে তিন দিক থেকে—

১. ভূরাজনীতি: ভারত যদি কাচিন থেকে সরবরাহ চেইন তৈরি করে, তা উত্তর-পূর্ব ভারতের ভেতর দিয়ে যাবে। সীমান্ত–স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও জরুরি।

২. শিল্পোন্নয়ন: নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যান, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে রেয়ার আর্থ অপরিহার্য। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিল্পনীতিতে বিকল্প উৎস নিশ্চিত করতে হবে।

৩. অংশীদারত্ব: ভারত-জাপান-মার্কিন সাপ্লাই চেইনে বাংলাদেশ গবেষণা, প্রক্রিয়াজাতকরণ বা ট্রানজিট সুবিধায় অংশ নিতে পারে।

৪. পরিবেশ ও ন্যায়: আঞ্চলিক দূষণ বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মানবাধিকার ও পরিবেশ ইস্যুতে ঢাকার স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি।

মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য এখন শুধু খনিজের ভান্ডার নয়, বরং বৈশ্বিক ভূরাজনীতির নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন শক্তির প্রতিযোগিতা সেখানে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।

কে জয়ী হবে, তা নির্ভর করছে শুধু খনিজের প্রাপ্যতা নয়, বরং আঞ্চলিক শান্তি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং কূটনৈতিক দর-কষাকষির ওপর।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা স্পষ্ট: এই প্রতিযোগিতা থেকে বাইরে থাকা সম্ভব নয়। বরং এখনই কৌশল নিতে হবে—বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করা, আঞ্চলিক সহযোগিতায় যুক্ত হওয়া এবং পরিবেশ-মানবাধিকার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জবাব ভাইরাল

জুনেও যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম, এবার বাধা দেওয়ায় বিস্মিত হয়েছি: সোহেল তাজ

১% এর টাকায় ২৫% ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠা সেই ইউএনওকে বদলি

জি এম কাদের জাতীয় পার্টির সাধারণ সদস্য: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ

গোদাগাড়ীতে নৌকাডুবিতে একজনের মৃত্যু, দুজন নিখোঁজ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত