
বিদ্রোহীরা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বাশার আল–আসাদ ও তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। আর এই পতনে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস), তুরস্ক–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ), যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী।
আসাদের পতনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চোখেমুখে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বও খুশি। অনেকে মনে করছেন, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাবই সুসংহত হলো। এই ধারণা থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহ ও আসাদের পতনের পেছনে ইসরায়েলি মদদ দেখতে পাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, এতে নিদেনপক্ষে ফিলিস্তিনেরই ক্ষতি হলো। যদিও ফিলিস্তিনের কবি–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবীরা আসাদের পতনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্তিনের কি কিছু আসে–যায়?
এটি বুঝতে হলে ফিলিস্তিন তথা গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসের সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আসাদ সরকারের পূর্ব ভূমিকা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে।
গত বছরের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধের আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে বরাবরই পরাশক্তি ও বিশ্লেষকদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষ—হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান ও সিরিয়ার মধ্যকার বিশেষ ধরনের এক জোটের ওপর।
অবশ্য গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসের পক্ষে হিজবুল্লাহ ও ইরান সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকার হামাসের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনে অপেক্ষাকৃত নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরেই হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকারে সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর বছরগুলোতে হামাস সিরিয়ারবিরোধী পক্ষের বিপ্লবীদের সমর্থন জানিয়েছিল। এতে আসাদ সরকারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
হিজবুল্লাহ এবং ইরানের উৎসাহেই এই পুনর্মিলন ঘটে। এর একটি কারণ ছিল আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে ওঠা। একের পর এক আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিচ্ছিল। এমনকি সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আলোচনা শুরু করেছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজায় ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের মধ্যে হামাস কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন তারা মরিয়া হয়ে নতুন মিত্র খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় এবং সিরীয় অবকাঠামো বারবার ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেহরান এবং হিজবুল্লাহর চাপের মুখে দামেস্ক হামাসের সঙ্গে পূর্ববর্তী শত্রুতা বজায় রাখার অবস্থায় ছিল না।
যদিও সিরিয়া হামাসের সামরিক শক্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না এবং গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলায় তাদের কোনো ভূমিকাও ছিল বলে মনে হয় না। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৃহত্তর জোটে সিরিয়ার অবস্থান আঞ্চলিক সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে।
এখানে সিরিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই সিরিয়া তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সিরিয়া একটি রুট হিসেবে কাজ করে। ইরানের জন্য আরব–ইসরায়েলি রণক্ষেত্রে সিরিয়া কার্যত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার সুযোগ পাওয়া যায় এবং অঞ্চলজুড়ে মার্কিন অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ তৈরি হয়।
তবে সিরিয়া এই জোটে ‘নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী’ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়া প্রায় কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেনি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আসাদ প্রশাসন ইরান বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে কোনো ফ্রন্ট খুলতে চাইলে হিজবুল্লাহ বা ইরানিপন্থী মিলিশিয়াদের মাধ্যমেই করতে হতো ইরানকে। সিরিয়ার নিজে কোনো যুদ্ধে জড়ানোর মতো সক্ষমতা বা অবস্থায় ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়া ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান ও ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের ওপর একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দামেস্ক ও আলেপ্পো বিমানবন্দরে বোমা হামলা করেছে। অন্যদিকে, ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ৪০ বার হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে। এ নিয়ে ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
এই সহিংসতাগুলো সিরিয়ায় আরও অস্থিরতা তৈরি করে। সিরিয়াকে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রকারান্তরে এই পরিস্থিতি সিরিয়ার জনগণের জন্য আরও ভোগান্তি বয়ে আনে।
হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভেতর দিয়ে গাজার প্রতি সিরিয়ার সমর্থনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আসাদ রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হতে চেয়েছেন। কিন্তু এ অবস্থান তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। অর্থনৈতিক সংকট বাড়তেই থাকে, যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, গাজার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে আসাদ মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছেন এবং তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আড়াল করতে চেয়েছেন। কিন্তু আরব বিশ্বে আসাদের শাসনব্যবস্থার অতীতের নৃশংসতার স্মৃতি মানুষের মধ্যে তাজা। অনেকে গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ও বোমা বর্ষণের সঙ্গে সিরিয়ার ইয়ারমুক শরণার্থীশিবিরে সংঘটিত অবরোধের মিল খুঁজে পান।
আসাদের পতন কতটা প্রভাব ফেলবে
সিরিয়ার সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এই সংগঠনটির আগে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে বর্তমান নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এখন আর সেই মতাদর্শ ধারণ করেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমে এটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও তারা এখন এইচটিএসকে নিয়ে সরাসরি আপত্তি তুলছে না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, উগ্রবাদী ইসলামি সংগঠনগুলো এই বিদ্রোহের সঙ্গে নেই।
অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কের পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা গেলেও এইচটিএসের সঙ্গে বহিশক্তির কোনো সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।
তবে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানই দেখাচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে আশাবাদী, তবে এইচটিএসকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। যদিও এইচটিএস যে ইরানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেই আগ্রহী সেটি গতকাল প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন আল–জোলানি। তিনি সম্ভবত ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করতেই চাচ্ছেন।
এদিকে ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে তাদের অবস্থান জানান দিতে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। গোলান মালভূমির অধিকৃত অঞ্চলে ট্যাংক মোতায়েন করেছে। সিরিয়ার সীমান্তের ভেতরে চলে গেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ার সীমান্তবাসীকে ঘরে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি ইসরায়েলের সাময়িক আগাম সতর্কতা।
তবে এটি স্পষ্ট যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল জানিয়ে দিতে চাচ্ছে, সিরিয়া সীমান্ত তথা সার্বভৌমত্বে ইসরায়েলকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সিরিয়াতে যে–ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে—এমন কোনো উপাদান সহ্য করা হবে না। আর এই অঞ্চলে ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাব খর্ব হওয়ায় ইসরায়েল আরও বেশি ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ যে পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ
সিরিয়াতে আসাদের পতন, ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাববলয় সংকুচিত হয়ে আসার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ইসরায়েলের প্রভাব বাড়বে। তাতে ফিলিস্তিনের মানুষের কী আসে–যায়? প্রকৃতপক্ষে, ইরান, হিজবুল্লাহ এবং এই অঞ্চলে ইরানপন্থী মিলিশিয়াগুলো আপাতদৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়ে গেলেও গাজায় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ একটুও কমেনি। এখন পর্যন্ত প্রাণহানি প্রায় অর্ধলাখ। গাজা ধ্বংসস্তূপ। হামাস নেতৃত্বশূন্য ক্ষীণবল। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা থেকে কাতার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। হামাস নেতাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যস্থতায় এখন মিসর আর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ইরানের অংশ কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে ইরান লেবাননে তার মিত্র হিজবুল্লাহ ও অন্য মিলিশিয়াগুলোকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাসনা পূর্ণ করতে চায়। এখানে ফিলিস্তিন স্বার্থ দাবার ঘুঁটি মাত্র!
বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস সহযোগে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’–এর হাতে নেই। ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকট মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর লড়াই এবং পশ্চিম তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা প্রত্যাশার মধ্যে নিহিত।
সুতরাং, সিরিয়ায় আসাদের পতন এবং ইসলামপন্থী এইচটিএস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থানের মধ্যে অস্থিরতার সমূহ আশঙ্কার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনিদের রক্তের মূল্য আঞ্চলিক পরাশক্তিদের খায়েশের কাছে অতি নগণ্য!
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

বিদ্রোহীরা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বাশার আল–আসাদ ও তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। আর এই পতনে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস), তুরস্ক–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ), যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী।
আসাদের পতনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চোখেমুখে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বও খুশি। অনেকে মনে করছেন, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাবই সুসংহত হলো। এই ধারণা থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহ ও আসাদের পতনের পেছনে ইসরায়েলি মদদ দেখতে পাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, এতে নিদেনপক্ষে ফিলিস্তিনেরই ক্ষতি হলো। যদিও ফিলিস্তিনের কবি–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবীরা আসাদের পতনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্তিনের কি কিছু আসে–যায়?
এটি বুঝতে হলে ফিলিস্তিন তথা গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসের সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আসাদ সরকারের পূর্ব ভূমিকা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে।
গত বছরের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধের আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে বরাবরই পরাশক্তি ও বিশ্লেষকদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষ—হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান ও সিরিয়ার মধ্যকার বিশেষ ধরনের এক জোটের ওপর।
অবশ্য গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসের পক্ষে হিজবুল্লাহ ও ইরান সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকার হামাসের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনে অপেক্ষাকৃত নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরেই হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকারে সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর বছরগুলোতে হামাস সিরিয়ারবিরোধী পক্ষের বিপ্লবীদের সমর্থন জানিয়েছিল। এতে আসাদ সরকারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
হিজবুল্লাহ এবং ইরানের উৎসাহেই এই পুনর্মিলন ঘটে। এর একটি কারণ ছিল আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে ওঠা। একের পর এক আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিচ্ছিল। এমনকি সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আলোচনা শুরু করেছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজায় ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের মধ্যে হামাস কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন তারা মরিয়া হয়ে নতুন মিত্র খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় এবং সিরীয় অবকাঠামো বারবার ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেহরান এবং হিজবুল্লাহর চাপের মুখে দামেস্ক হামাসের সঙ্গে পূর্ববর্তী শত্রুতা বজায় রাখার অবস্থায় ছিল না।
যদিও সিরিয়া হামাসের সামরিক শক্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না এবং গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলায় তাদের কোনো ভূমিকাও ছিল বলে মনে হয় না। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৃহত্তর জোটে সিরিয়ার অবস্থান আঞ্চলিক সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে।
এখানে সিরিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই সিরিয়া তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সিরিয়া একটি রুট হিসেবে কাজ করে। ইরানের জন্য আরব–ইসরায়েলি রণক্ষেত্রে সিরিয়া কার্যত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার সুযোগ পাওয়া যায় এবং অঞ্চলজুড়ে মার্কিন অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ তৈরি হয়।
তবে সিরিয়া এই জোটে ‘নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী’ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়া প্রায় কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেনি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আসাদ প্রশাসন ইরান বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে কোনো ফ্রন্ট খুলতে চাইলে হিজবুল্লাহ বা ইরানিপন্থী মিলিশিয়াদের মাধ্যমেই করতে হতো ইরানকে। সিরিয়ার নিজে কোনো যুদ্ধে জড়ানোর মতো সক্ষমতা বা অবস্থায় ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়া ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান ও ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের ওপর একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দামেস্ক ও আলেপ্পো বিমানবন্দরে বোমা হামলা করেছে। অন্যদিকে, ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ৪০ বার হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে। এ নিয়ে ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
এই সহিংসতাগুলো সিরিয়ায় আরও অস্থিরতা তৈরি করে। সিরিয়াকে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রকারান্তরে এই পরিস্থিতি সিরিয়ার জনগণের জন্য আরও ভোগান্তি বয়ে আনে।
হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভেতর দিয়ে গাজার প্রতি সিরিয়ার সমর্থনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আসাদ রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হতে চেয়েছেন। কিন্তু এ অবস্থান তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। অর্থনৈতিক সংকট বাড়তেই থাকে, যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, গাজার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে আসাদ মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছেন এবং তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আড়াল করতে চেয়েছেন। কিন্তু আরব বিশ্বে আসাদের শাসনব্যবস্থার অতীতের নৃশংসতার স্মৃতি মানুষের মধ্যে তাজা। অনেকে গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ও বোমা বর্ষণের সঙ্গে সিরিয়ার ইয়ারমুক শরণার্থীশিবিরে সংঘটিত অবরোধের মিল খুঁজে পান।
আসাদের পতন কতটা প্রভাব ফেলবে
সিরিয়ার সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এই সংগঠনটির আগে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে বর্তমান নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এখন আর সেই মতাদর্শ ধারণ করেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমে এটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও তারা এখন এইচটিএসকে নিয়ে সরাসরি আপত্তি তুলছে না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, উগ্রবাদী ইসলামি সংগঠনগুলো এই বিদ্রোহের সঙ্গে নেই।
অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কের পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা গেলেও এইচটিএসের সঙ্গে বহিশক্তির কোনো সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।
তবে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানই দেখাচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে আশাবাদী, তবে এইচটিএসকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। যদিও এইচটিএস যে ইরানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেই আগ্রহী সেটি গতকাল প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন আল–জোলানি। তিনি সম্ভবত ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করতেই চাচ্ছেন।
এদিকে ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে তাদের অবস্থান জানান দিতে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। গোলান মালভূমির অধিকৃত অঞ্চলে ট্যাংক মোতায়েন করেছে। সিরিয়ার সীমান্তের ভেতরে চলে গেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ার সীমান্তবাসীকে ঘরে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি ইসরায়েলের সাময়িক আগাম সতর্কতা।
তবে এটি স্পষ্ট যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল জানিয়ে দিতে চাচ্ছে, সিরিয়া সীমান্ত তথা সার্বভৌমত্বে ইসরায়েলকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সিরিয়াতে যে–ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে—এমন কোনো উপাদান সহ্য করা হবে না। আর এই অঞ্চলে ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাব খর্ব হওয়ায় ইসরায়েল আরও বেশি ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ যে পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ
সিরিয়াতে আসাদের পতন, ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাববলয় সংকুচিত হয়ে আসার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ইসরায়েলের প্রভাব বাড়বে। তাতে ফিলিস্তিনের মানুষের কী আসে–যায়? প্রকৃতপক্ষে, ইরান, হিজবুল্লাহ এবং এই অঞ্চলে ইরানপন্থী মিলিশিয়াগুলো আপাতদৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়ে গেলেও গাজায় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ একটুও কমেনি। এখন পর্যন্ত প্রাণহানি প্রায় অর্ধলাখ। গাজা ধ্বংসস্তূপ। হামাস নেতৃত্বশূন্য ক্ষীণবল। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা থেকে কাতার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। হামাস নেতাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যস্থতায় এখন মিসর আর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ইরানের অংশ কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে ইরান লেবাননে তার মিত্র হিজবুল্লাহ ও অন্য মিলিশিয়াগুলোকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাসনা পূর্ণ করতে চায়। এখানে ফিলিস্তিন স্বার্থ দাবার ঘুঁটি মাত্র!
বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস সহযোগে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’–এর হাতে নেই। ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকট মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর লড়াই এবং পশ্চিম তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা প্রত্যাশার মধ্যে নিহিত।
সুতরাং, সিরিয়ায় আসাদের পতন এবং ইসলামপন্থী এইচটিএস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থানের মধ্যে অস্থিরতার সমূহ আশঙ্কার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনিদের রক্তের মূল্য আঞ্চলিক পরাশক্তিদের খায়েশের কাছে অতি নগণ্য!
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

বিদ্রোহীরা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বাশার আল–আসাদ ও তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। আর এই পতনে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস), তুরস্ক–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ), যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী।
আসাদের পতনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চোখেমুখে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বও খুশি। অনেকে মনে করছেন, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাবই সুসংহত হলো। এই ধারণা থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহ ও আসাদের পতনের পেছনে ইসরায়েলি মদদ দেখতে পাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, এতে নিদেনপক্ষে ফিলিস্তিনেরই ক্ষতি হলো। যদিও ফিলিস্তিনের কবি–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবীরা আসাদের পতনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্তিনের কি কিছু আসে–যায়?
এটি বুঝতে হলে ফিলিস্তিন তথা গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসের সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আসাদ সরকারের পূর্ব ভূমিকা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে।
গত বছরের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধের আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে বরাবরই পরাশক্তি ও বিশ্লেষকদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষ—হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান ও সিরিয়ার মধ্যকার বিশেষ ধরনের এক জোটের ওপর।
অবশ্য গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসের পক্ষে হিজবুল্লাহ ও ইরান সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকার হামাসের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনে অপেক্ষাকৃত নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরেই হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকারে সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর বছরগুলোতে হামাস সিরিয়ারবিরোধী পক্ষের বিপ্লবীদের সমর্থন জানিয়েছিল। এতে আসাদ সরকারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
হিজবুল্লাহ এবং ইরানের উৎসাহেই এই পুনর্মিলন ঘটে। এর একটি কারণ ছিল আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে ওঠা। একের পর এক আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিচ্ছিল। এমনকি সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আলোচনা শুরু করেছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজায় ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের মধ্যে হামাস কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন তারা মরিয়া হয়ে নতুন মিত্র খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় এবং সিরীয় অবকাঠামো বারবার ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেহরান এবং হিজবুল্লাহর চাপের মুখে দামেস্ক হামাসের সঙ্গে পূর্ববর্তী শত্রুতা বজায় রাখার অবস্থায় ছিল না।
যদিও সিরিয়া হামাসের সামরিক শক্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না এবং গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলায় তাদের কোনো ভূমিকাও ছিল বলে মনে হয় না। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৃহত্তর জোটে সিরিয়ার অবস্থান আঞ্চলিক সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে।
এখানে সিরিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই সিরিয়া তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সিরিয়া একটি রুট হিসেবে কাজ করে। ইরানের জন্য আরব–ইসরায়েলি রণক্ষেত্রে সিরিয়া কার্যত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার সুযোগ পাওয়া যায় এবং অঞ্চলজুড়ে মার্কিন অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ তৈরি হয়।
তবে সিরিয়া এই জোটে ‘নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী’ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়া প্রায় কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেনি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আসাদ প্রশাসন ইরান বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে কোনো ফ্রন্ট খুলতে চাইলে হিজবুল্লাহ বা ইরানিপন্থী মিলিশিয়াদের মাধ্যমেই করতে হতো ইরানকে। সিরিয়ার নিজে কোনো যুদ্ধে জড়ানোর মতো সক্ষমতা বা অবস্থায় ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়া ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান ও ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের ওপর একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দামেস্ক ও আলেপ্পো বিমানবন্দরে বোমা হামলা করেছে। অন্যদিকে, ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ৪০ বার হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে। এ নিয়ে ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
এই সহিংসতাগুলো সিরিয়ায় আরও অস্থিরতা তৈরি করে। সিরিয়াকে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রকারান্তরে এই পরিস্থিতি সিরিয়ার জনগণের জন্য আরও ভোগান্তি বয়ে আনে।
হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভেতর দিয়ে গাজার প্রতি সিরিয়ার সমর্থনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আসাদ রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হতে চেয়েছেন। কিন্তু এ অবস্থান তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। অর্থনৈতিক সংকট বাড়তেই থাকে, যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, গাজার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে আসাদ মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছেন এবং তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আড়াল করতে চেয়েছেন। কিন্তু আরব বিশ্বে আসাদের শাসনব্যবস্থার অতীতের নৃশংসতার স্মৃতি মানুষের মধ্যে তাজা। অনেকে গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ও বোমা বর্ষণের সঙ্গে সিরিয়ার ইয়ারমুক শরণার্থীশিবিরে সংঘটিত অবরোধের মিল খুঁজে পান।
আসাদের পতন কতটা প্রভাব ফেলবে
সিরিয়ার সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এই সংগঠনটির আগে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে বর্তমান নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এখন আর সেই মতাদর্শ ধারণ করেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমে এটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও তারা এখন এইচটিএসকে নিয়ে সরাসরি আপত্তি তুলছে না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, উগ্রবাদী ইসলামি সংগঠনগুলো এই বিদ্রোহের সঙ্গে নেই।
অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কের পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা গেলেও এইচটিএসের সঙ্গে বহিশক্তির কোনো সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।
তবে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানই দেখাচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে আশাবাদী, তবে এইচটিএসকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। যদিও এইচটিএস যে ইরানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেই আগ্রহী সেটি গতকাল প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন আল–জোলানি। তিনি সম্ভবত ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করতেই চাচ্ছেন।
এদিকে ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে তাদের অবস্থান জানান দিতে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। গোলান মালভূমির অধিকৃত অঞ্চলে ট্যাংক মোতায়েন করেছে। সিরিয়ার সীমান্তের ভেতরে চলে গেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ার সীমান্তবাসীকে ঘরে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি ইসরায়েলের সাময়িক আগাম সতর্কতা।
তবে এটি স্পষ্ট যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল জানিয়ে দিতে চাচ্ছে, সিরিয়া সীমান্ত তথা সার্বভৌমত্বে ইসরায়েলকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সিরিয়াতে যে–ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে—এমন কোনো উপাদান সহ্য করা হবে না। আর এই অঞ্চলে ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাব খর্ব হওয়ায় ইসরায়েল আরও বেশি ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ যে পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ
সিরিয়াতে আসাদের পতন, ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাববলয় সংকুচিত হয়ে আসার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ইসরায়েলের প্রভাব বাড়বে। তাতে ফিলিস্তিনের মানুষের কী আসে–যায়? প্রকৃতপক্ষে, ইরান, হিজবুল্লাহ এবং এই অঞ্চলে ইরানপন্থী মিলিশিয়াগুলো আপাতদৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়ে গেলেও গাজায় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ একটুও কমেনি। এখন পর্যন্ত প্রাণহানি প্রায় অর্ধলাখ। গাজা ধ্বংসস্তূপ। হামাস নেতৃত্বশূন্য ক্ষীণবল। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা থেকে কাতার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। হামাস নেতাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যস্থতায় এখন মিসর আর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ইরানের অংশ কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে ইরান লেবাননে তার মিত্র হিজবুল্লাহ ও অন্য মিলিশিয়াগুলোকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাসনা পূর্ণ করতে চায়। এখানে ফিলিস্তিন স্বার্থ দাবার ঘুঁটি মাত্র!
বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস সহযোগে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’–এর হাতে নেই। ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকট মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর লড়াই এবং পশ্চিম তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা প্রত্যাশার মধ্যে নিহিত।
সুতরাং, সিরিয়ায় আসাদের পতন এবং ইসলামপন্থী এইচটিএস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থানের মধ্যে অস্থিরতার সমূহ আশঙ্কার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনিদের রক্তের মূল্য আঞ্চলিক পরাশক্তিদের খায়েশের কাছে অতি নগণ্য!
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

বিদ্রোহীরা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বাশার আল–আসাদ ও তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। আর এই পতনে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস), তুরস্ক–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ), যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী।
আসাদের পতনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চোখেমুখে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বও খুশি। অনেকে মনে করছেন, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাবই সুসংহত হলো। এই ধারণা থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহ ও আসাদের পতনের পেছনে ইসরায়েলি মদদ দেখতে পাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, এতে নিদেনপক্ষে ফিলিস্তিনেরই ক্ষতি হলো। যদিও ফিলিস্তিনের কবি–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবীরা আসাদের পতনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্তিনের কি কিছু আসে–যায়?
এটি বুঝতে হলে ফিলিস্তিন তথা গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসের সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আসাদ সরকারের পূর্ব ভূমিকা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে।
গত বছরের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধের আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে বরাবরই পরাশক্তি ও বিশ্লেষকদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষ—হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান ও সিরিয়ার মধ্যকার বিশেষ ধরনের এক জোটের ওপর।
অবশ্য গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসের পক্ষে হিজবুল্লাহ ও ইরান সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকার হামাসের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনে অপেক্ষাকৃত নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরেই হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকারে সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর বছরগুলোতে হামাস সিরিয়ারবিরোধী পক্ষের বিপ্লবীদের সমর্থন জানিয়েছিল। এতে আসাদ সরকারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
হিজবুল্লাহ এবং ইরানের উৎসাহেই এই পুনর্মিলন ঘটে। এর একটি কারণ ছিল আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে ওঠা। একের পর এক আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিচ্ছিল। এমনকি সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আলোচনা শুরু করেছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজায় ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের মধ্যে হামাস কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন তারা মরিয়া হয়ে নতুন মিত্র খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় এবং সিরীয় অবকাঠামো বারবার ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেহরান এবং হিজবুল্লাহর চাপের মুখে দামেস্ক হামাসের সঙ্গে পূর্ববর্তী শত্রুতা বজায় রাখার অবস্থায় ছিল না।
যদিও সিরিয়া হামাসের সামরিক শক্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না এবং গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলায় তাদের কোনো ভূমিকাও ছিল বলে মনে হয় না। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৃহত্তর জোটে সিরিয়ার অবস্থান আঞ্চলিক সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে।
এখানে সিরিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই সিরিয়া তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সিরিয়া একটি রুট হিসেবে কাজ করে। ইরানের জন্য আরব–ইসরায়েলি রণক্ষেত্রে সিরিয়া কার্যত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার সুযোগ পাওয়া যায় এবং অঞ্চলজুড়ে মার্কিন অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ তৈরি হয়।
তবে সিরিয়া এই জোটে ‘নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী’ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়া প্রায় কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেনি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আসাদ প্রশাসন ইরান বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে কোনো ফ্রন্ট খুলতে চাইলে হিজবুল্লাহ বা ইরানিপন্থী মিলিশিয়াদের মাধ্যমেই করতে হতো ইরানকে। সিরিয়ার নিজে কোনো যুদ্ধে জড়ানোর মতো সক্ষমতা বা অবস্থায় ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়া ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান ও ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের ওপর একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দামেস্ক ও আলেপ্পো বিমানবন্দরে বোমা হামলা করেছে। অন্যদিকে, ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ৪০ বার হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে। এ নিয়ে ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
এই সহিংসতাগুলো সিরিয়ায় আরও অস্থিরতা তৈরি করে। সিরিয়াকে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রকারান্তরে এই পরিস্থিতি সিরিয়ার জনগণের জন্য আরও ভোগান্তি বয়ে আনে।
হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভেতর দিয়ে গাজার প্রতি সিরিয়ার সমর্থনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আসাদ রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হতে চেয়েছেন। কিন্তু এ অবস্থান তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। অর্থনৈতিক সংকট বাড়তেই থাকে, যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, গাজার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে আসাদ মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছেন এবং তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আড়াল করতে চেয়েছেন। কিন্তু আরব বিশ্বে আসাদের শাসনব্যবস্থার অতীতের নৃশংসতার স্মৃতি মানুষের মধ্যে তাজা। অনেকে গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ও বোমা বর্ষণের সঙ্গে সিরিয়ার ইয়ারমুক শরণার্থীশিবিরে সংঘটিত অবরোধের মিল খুঁজে পান।
আসাদের পতন কতটা প্রভাব ফেলবে
সিরিয়ার সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এই সংগঠনটির আগে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে বর্তমান নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এখন আর সেই মতাদর্শ ধারণ করেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমে এটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও তারা এখন এইচটিএসকে নিয়ে সরাসরি আপত্তি তুলছে না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, উগ্রবাদী ইসলামি সংগঠনগুলো এই বিদ্রোহের সঙ্গে নেই।
অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কের পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা গেলেও এইচটিএসের সঙ্গে বহিশক্তির কোনো সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।
তবে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানই দেখাচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে আশাবাদী, তবে এইচটিএসকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। যদিও এইচটিএস যে ইরানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেই আগ্রহী সেটি গতকাল প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন আল–জোলানি। তিনি সম্ভবত ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করতেই চাচ্ছেন।
এদিকে ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে তাদের অবস্থান জানান দিতে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। গোলান মালভূমির অধিকৃত অঞ্চলে ট্যাংক মোতায়েন করেছে। সিরিয়ার সীমান্তের ভেতরে চলে গেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ার সীমান্তবাসীকে ঘরে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি ইসরায়েলের সাময়িক আগাম সতর্কতা।
তবে এটি স্পষ্ট যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল জানিয়ে দিতে চাচ্ছে, সিরিয়া সীমান্ত তথা সার্বভৌমত্বে ইসরায়েলকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সিরিয়াতে যে–ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে—এমন কোনো উপাদান সহ্য করা হবে না। আর এই অঞ্চলে ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাব খর্ব হওয়ায় ইসরায়েল আরও বেশি ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ যে পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ
সিরিয়াতে আসাদের পতন, ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাববলয় সংকুচিত হয়ে আসার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ইসরায়েলের প্রভাব বাড়বে। তাতে ফিলিস্তিনের মানুষের কী আসে–যায়? প্রকৃতপক্ষে, ইরান, হিজবুল্লাহ এবং এই অঞ্চলে ইরানপন্থী মিলিশিয়াগুলো আপাতদৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়ে গেলেও গাজায় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ একটুও কমেনি। এখন পর্যন্ত প্রাণহানি প্রায় অর্ধলাখ। গাজা ধ্বংসস্তূপ। হামাস নেতৃত্বশূন্য ক্ষীণবল। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা থেকে কাতার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। হামাস নেতাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যস্থতায় এখন মিসর আর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ইরানের অংশ কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে ইরান লেবাননে তার মিত্র হিজবুল্লাহ ও অন্য মিলিশিয়াগুলোকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাসনা পূর্ণ করতে চায়। এখানে ফিলিস্তিন স্বার্থ দাবার ঘুঁটি মাত্র!
বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস সহযোগে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’–এর হাতে নেই। ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকট মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর লড়াই এবং পশ্চিম তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা প্রত্যাশার মধ্যে নিহিত।
সুতরাং, সিরিয়ায় আসাদের পতন এবং ইসলামপন্থী এইচটিএস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থানের মধ্যে অস্থিরতার সমূহ আশঙ্কার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনিদের রক্তের মূল্য আঞ্চলিক পরাশক্তিদের খায়েশের কাছে অতি নগণ্য!
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির জয় কী কোনো পথনির্দেশ নাকি অসংগতি? গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রশ্ন ঘিরে রেখেছিল জোহরান মামদানিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।
৫ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় এক বছর পূর্তির লগ্নে এই নির্বাচনকে ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৮ ঘণ্টা আগে
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১ দিন আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির জয় কি কোনো পথনির্দেশ নাকি অসংগতি? গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রশ্ন ঘিরে রেখেছিল জোহরান মামদানিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।
মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। এর মধ্যে ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে আবার শ্রমজীবী আমেরিকানদের দিকে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে মূলধারার রাজনীতিতে একসময়ে বাতিল হয়ে যাওয়া মতাদর্শগুলো একেবারে বাদ না দেওয়া। কুমো একে বলেছেন ‘গৃহযুদ্ধ।’ আর এই গৃহযুদ্ধে কুমোর মতো ‘মধ্যপন্থীরা’ মুখোমুখি হয়েছেন মামদানির মতো প্রগতিশীল নতুনদের।
ভোটের দিন বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ব্রুকলিনের ক্রাউন হাইটস এলাকার ৬৮ বছর বয়সী ভোটার মাইকেল ব্ল্যাকম্যান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া’ ছিল তাঁর কাছে নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ইস্যু। তিনি বলেন, ‘মামদানি হয়তো তাঁর সব প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর অন্তত একটা আদর্শ আছে।’
ব্ল্যাকম্যানের কাছে কুমো মানে ‘একই পুরোনো রাজনীতি’র পুনরাবৃত্তি, যা বহুদিন ধরে উদারপন্থী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ধনবান দাতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি তাঁকে সমর্থন দেওয়া সেটিই প্রমাণ করে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জাস্টিস ডেমোক্র্যাটস নামের সংগঠন জানায়, ‘জোহরানের এই বিজয় করপোরেটপন্থী, প্রতিষ্ঠিত ডেমোক্র্যাটদের জন্য সতর্কবার্তা—আপনি যদি সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ না করেন, আপনার সময় শেষ হয়ে আসছে।’
মামদানির প্রচারণা শিবিরও তাঁর এই বিজয়কে স্থানীয় সীমানা ছাড়িয়ে এক বড় বার্তা হিসেবে তুলে ধরেছে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটর মাইকেল জিয়ানারিস নির্বাচনের আগের রাতে মামদানির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই বার্তা শুধু নিউইয়র্ক সিটির জন্য নয়, শুধু নিউইয়র্ক রাজ্যের জন্য নয়, এমনকি শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্যও নয়—এটা গোটা বিশ্বের জন্য।’ তিনি যোগ করেন, ‘মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারা সবকিছু করতে পারে।’
মামদানির প্রচারণা থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়, তা সময়ই বলবে। জাতীয় পর্যায়ে অনেক শীর্ষ ডেমোক্র্যাট নেতা এখনো তাঁকে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। তাঁদের আশঙ্কা, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সদস্য হিসেবে মামদানির অবস্থান এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে তাঁর স্পষ্ট সমর্থন হয়তো ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটারদের দূরে ঠেলে দিতে পারে।
এই তালিকার শীর্ষে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর চাক শুমার। তিনি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিরপেক্ষ থেকেছেন। তবে ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদ ট্রিপ ইয়াং বলেন, সমর্থন যেখান থেকেই আসুক না কেন, দলের নেতারা মামদানির এই প্রচারণাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। কারণ, গত বছরের প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজয়ের পর ডেমোক্র্যাটরা এখন ভবিষ্যতের পথ খুঁজছে।
ইয়াং বলেন, কুমোর অভিযোগ করা ‘গৃহযুদ্ধ’ আসলে অতিরঞ্জন। কারণ, পুরোনো ধাঁচের ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ নিয়ে কেউ সংগঠিতভাবে কুমোর বিপক্ষে নামেননি। বরং তাঁর মতে মামদানির এই জয় দেখিয়ে দিয়েছে পার্টি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা দলের নেতৃত্ব পছন্দ করুক বা না করুক। ডেমোক্রেটিক পার্টি যাচ্ছে এমন এক রূপান্তরের দিকে, যেখানে লেবেল বা মতাদর্শের চেয়ে চিন্তার বৈচিত্র্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ইয়াং বলেন, ‘আপনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট, মধ্যপন্থী বা রক্ষণশীল যা-ই হোন না কেন, সেটা আসলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভোটাররা খোঁজে এমন প্রার্থীকে, যিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং তাঁদের সবচেয়ে জরুরি সমস্যার কথা বলতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘নিউইয়র্ক সিটিতে এখন বড় বিষয় হলো জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু মূল ব্যাপারটা হলো একটা সমস্যাকে চিহ্নিত করা, তারপর সেটি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া।’
ইয়াং আরও বলেন, শহরের বিভিন্ন কমিউনিটিতে মামদানির নিয়মিত উপস্থিতি, এমনকি বৈরী গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছাও ডেমোক্র্যাটদের অনুসরণ করা উচিত। তাঁর কথায়, ‘অনেক ডেমোক্র্যাট কেবল নিরাপদ রাজনৈতিক পরিসরেই থাকেন।’
ব্রুকলিনের বার্ড কলেজের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড্যানিয়েল ওয়ার্টেল-লন্ডন বলেন, মামদানির সাফল্য প্রমাণ করেছে, ‘সহনীয় জীবনযাপন এখন আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ইস্যু।’ তিনি বলেন, ডেমোক্র্যাটরা ঐতিহাসিকভাবে সাফল্য পান যখন তাঁরা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্নে যেমন জীবনের ব্যয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মতো ‘রুটি-রুজির ইস্যুতে’ মন দেন।
তবে এসবের দিকে মনোযোগ দেওয়া মানে এই নয় যে প্রগতিশীল মূল্যবোধ বা আদর্শ বিসর্জন দিতে হবে। ওয়ার্টেল-লন্ডনের ভাষায়, ‘মামদানি দেখিয়েছেন কীভাবে এসব অগ্রাধিকারকে সামাজিক ন্যায়বিচারের নৈতিক জরুরির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়, যা অনেক প্রগতিশীল মানুষের প্রেরণার উৎস।’
তিনি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা যদি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন কাটিয়ে একটি বড় ঐক্যবদ্ধ জোট গড়তে চান, তাহলে তাঁদের মামদানির পথ থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’ অনেকের কাছে, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং গাজায় গণহত্যার নিন্দা করার মধ্য দিয়ে এই প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন মামদানি।
তবে এই অবস্থানেই সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর আক্রমণের মুখে পড়েছেন তিনি। কুমো মামদানিকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ ও ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও মামদানি কিছু বক্তব্যে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন; যেমন তিনি ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তারপরও তিনি ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েলের সমালোচনায় দৃঢ়।
নির্বাচনের আগের রাতে মামদানির সমর্থক শবনম সালেহেজাদেহি বলেন, ‘তাঁর রাজনীতিতে যে নীতিগত দৃঢ়তা আছে, তা আমি পছন্দ করি।’ গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে ফিলিস্তিনপন্থী মনোভাব বাড়ছে। যদিও দলের শীর্ষ নেতারা এখনো ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পক্ষে। সালেহেজাদেহি বলেন, ‘মামদানি ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে দেখেন। তিনি গাজায় যা ঘটছে, সেটিকে স্পষ্টভাবে গণহত্যা হিসেবেই দেখেন।’
তবে মামদানির এই জয়ের গল্প এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। আগামী জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর নীতি বাস্তবায়নে সামনে আসবে বহু বাধা। বিশেষ করে যদি তিনি তাঁর অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে কিছু বাস্তবায়ন করতে চান; যেমন সর্বজনীন শিশুসেবা চালু করা, যার জন্য করপোরেশন ও ধনীদের ওপর কর বাড়াতে হবে।
ওয়ার্টেল-লন্ডন বলেন, ‘তবু ইতিহাস বলে, এসব লড়াই জেতা অসম্ভব নয়। এমনকি রিপাবলিকান মেয়র ব্লুমবার্গও একসময় কর বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। কারণ, তিনি কার্যকর ও সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব দেখিয়েছিলেন। যদি মামদানি তেমন নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাহলে তিনি মানুষকে অবাক করে দিতে পারবেন তাঁর অর্জনের পরিমাণ দেখিয়ে।’
৩৪ বছর বয়সী সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সামাদ আহমেদের কাছে মামদানির প্রার্থিতা ছিল এক রকম ‘রূপান্তরমূলক অভিজ্ঞতা।’ জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দেন। তবে তিনি জানেন, জনমত খুব সহজেই পাল্টে যেতে পারে। যদি মামদানি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হন, তাহলে তা তাঁর মতো প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সামাদ বলেন, ‘আমি কখনো মনে করিনি যে কোনো প্রার্থী আমার মতো নিউইয়র্কারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কিন্তু মামদানি আমাকে সে আশা দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন এটা তাঁর দায়িত্ব—আমাদের এই আশাকে সঠিক বলে প্রমাণ করা। না হলে নিউইয়র্কাররা তাঁকে বিদায় জানাতে দেরি করবে না। আমেরিকানরা এমনই।’
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির জয় কি কোনো পথনির্দেশ নাকি অসংগতি? গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রশ্ন ঘিরে রেখেছিল জোহরান মামদানিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।
মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। এর মধ্যে ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে আবার শ্রমজীবী আমেরিকানদের দিকে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে মূলধারার রাজনীতিতে একসময়ে বাতিল হয়ে যাওয়া মতাদর্শগুলো একেবারে বাদ না দেওয়া। কুমো একে বলেছেন ‘গৃহযুদ্ধ।’ আর এই গৃহযুদ্ধে কুমোর মতো ‘মধ্যপন্থীরা’ মুখোমুখি হয়েছেন মামদানির মতো প্রগতিশীল নতুনদের।
ভোটের দিন বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ব্রুকলিনের ক্রাউন হাইটস এলাকার ৬৮ বছর বয়সী ভোটার মাইকেল ব্ল্যাকম্যান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া’ ছিল তাঁর কাছে নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ইস্যু। তিনি বলেন, ‘মামদানি হয়তো তাঁর সব প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর অন্তত একটা আদর্শ আছে।’
ব্ল্যাকম্যানের কাছে কুমো মানে ‘একই পুরোনো রাজনীতি’র পুনরাবৃত্তি, যা বহুদিন ধরে উদারপন্থী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ধনবান দাতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি তাঁকে সমর্থন দেওয়া সেটিই প্রমাণ করে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জাস্টিস ডেমোক্র্যাটস নামের সংগঠন জানায়, ‘জোহরানের এই বিজয় করপোরেটপন্থী, প্রতিষ্ঠিত ডেমোক্র্যাটদের জন্য সতর্কবার্তা—আপনি যদি সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ না করেন, আপনার সময় শেষ হয়ে আসছে।’
মামদানির প্রচারণা শিবিরও তাঁর এই বিজয়কে স্থানীয় সীমানা ছাড়িয়ে এক বড় বার্তা হিসেবে তুলে ধরেছে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটর মাইকেল জিয়ানারিস নির্বাচনের আগের রাতে মামদানির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই বার্তা শুধু নিউইয়র্ক সিটির জন্য নয়, শুধু নিউইয়র্ক রাজ্যের জন্য নয়, এমনকি শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্যও নয়—এটা গোটা বিশ্বের জন্য।’ তিনি যোগ করেন, ‘মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারা সবকিছু করতে পারে।’
মামদানির প্রচারণা থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়, তা সময়ই বলবে। জাতীয় পর্যায়ে অনেক শীর্ষ ডেমোক্র্যাট নেতা এখনো তাঁকে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। তাঁদের আশঙ্কা, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সদস্য হিসেবে মামদানির অবস্থান এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে তাঁর স্পষ্ট সমর্থন হয়তো ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটারদের দূরে ঠেলে দিতে পারে।
এই তালিকার শীর্ষে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর চাক শুমার। তিনি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিরপেক্ষ থেকেছেন। তবে ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদ ট্রিপ ইয়াং বলেন, সমর্থন যেখান থেকেই আসুক না কেন, দলের নেতারা মামদানির এই প্রচারণাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। কারণ, গত বছরের প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজয়ের পর ডেমোক্র্যাটরা এখন ভবিষ্যতের পথ খুঁজছে।
ইয়াং বলেন, কুমোর অভিযোগ করা ‘গৃহযুদ্ধ’ আসলে অতিরঞ্জন। কারণ, পুরোনো ধাঁচের ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ নিয়ে কেউ সংগঠিতভাবে কুমোর বিপক্ষে নামেননি। বরং তাঁর মতে মামদানির এই জয় দেখিয়ে দিয়েছে পার্টি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা দলের নেতৃত্ব পছন্দ করুক বা না করুক। ডেমোক্রেটিক পার্টি যাচ্ছে এমন এক রূপান্তরের দিকে, যেখানে লেবেল বা মতাদর্শের চেয়ে চিন্তার বৈচিত্র্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ইয়াং বলেন, ‘আপনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট, মধ্যপন্থী বা রক্ষণশীল যা-ই হোন না কেন, সেটা আসলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভোটাররা খোঁজে এমন প্রার্থীকে, যিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং তাঁদের সবচেয়ে জরুরি সমস্যার কথা বলতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘নিউইয়র্ক সিটিতে এখন বড় বিষয় হলো জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু মূল ব্যাপারটা হলো একটা সমস্যাকে চিহ্নিত করা, তারপর সেটি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া।’
ইয়াং আরও বলেন, শহরের বিভিন্ন কমিউনিটিতে মামদানির নিয়মিত উপস্থিতি, এমনকি বৈরী গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছাও ডেমোক্র্যাটদের অনুসরণ করা উচিত। তাঁর কথায়, ‘অনেক ডেমোক্র্যাট কেবল নিরাপদ রাজনৈতিক পরিসরেই থাকেন।’
ব্রুকলিনের বার্ড কলেজের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড্যানিয়েল ওয়ার্টেল-লন্ডন বলেন, মামদানির সাফল্য প্রমাণ করেছে, ‘সহনীয় জীবনযাপন এখন আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ইস্যু।’ তিনি বলেন, ডেমোক্র্যাটরা ঐতিহাসিকভাবে সাফল্য পান যখন তাঁরা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্নে যেমন জীবনের ব্যয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মতো ‘রুটি-রুজির ইস্যুতে’ মন দেন।
তবে এসবের দিকে মনোযোগ দেওয়া মানে এই নয় যে প্রগতিশীল মূল্যবোধ বা আদর্শ বিসর্জন দিতে হবে। ওয়ার্টেল-লন্ডনের ভাষায়, ‘মামদানি দেখিয়েছেন কীভাবে এসব অগ্রাধিকারকে সামাজিক ন্যায়বিচারের নৈতিক জরুরির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়, যা অনেক প্রগতিশীল মানুষের প্রেরণার উৎস।’
তিনি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা যদি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন কাটিয়ে একটি বড় ঐক্যবদ্ধ জোট গড়তে চান, তাহলে তাঁদের মামদানির পথ থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’ অনেকের কাছে, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং গাজায় গণহত্যার নিন্দা করার মধ্য দিয়ে এই প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন মামদানি।
তবে এই অবস্থানেই সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর আক্রমণের মুখে পড়েছেন তিনি। কুমো মামদানিকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ ও ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও মামদানি কিছু বক্তব্যে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন; যেমন তিনি ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তারপরও তিনি ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েলের সমালোচনায় দৃঢ়।
নির্বাচনের আগের রাতে মামদানির সমর্থক শবনম সালেহেজাদেহি বলেন, ‘তাঁর রাজনীতিতে যে নীতিগত দৃঢ়তা আছে, তা আমি পছন্দ করি।’ গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে ফিলিস্তিনপন্থী মনোভাব বাড়ছে। যদিও দলের শীর্ষ নেতারা এখনো ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পক্ষে। সালেহেজাদেহি বলেন, ‘মামদানি ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে দেখেন। তিনি গাজায় যা ঘটছে, সেটিকে স্পষ্টভাবে গণহত্যা হিসেবেই দেখেন।’
তবে মামদানির এই জয়ের গল্প এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। আগামী জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর নীতি বাস্তবায়নে সামনে আসবে বহু বাধা। বিশেষ করে যদি তিনি তাঁর অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে কিছু বাস্তবায়ন করতে চান; যেমন সর্বজনীন শিশুসেবা চালু করা, যার জন্য করপোরেশন ও ধনীদের ওপর কর বাড়াতে হবে।
ওয়ার্টেল-লন্ডন বলেন, ‘তবু ইতিহাস বলে, এসব লড়াই জেতা অসম্ভব নয়। এমনকি রিপাবলিকান মেয়র ব্লুমবার্গও একসময় কর বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। কারণ, তিনি কার্যকর ও সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব দেখিয়েছিলেন। যদি মামদানি তেমন নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাহলে তিনি মানুষকে অবাক করে দিতে পারবেন তাঁর অর্জনের পরিমাণ দেখিয়ে।’
৩৪ বছর বয়সী সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সামাদ আহমেদের কাছে মামদানির প্রার্থিতা ছিল এক রকম ‘রূপান্তরমূলক অভিজ্ঞতা।’ জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দেন। তবে তিনি জানেন, জনমত খুব সহজেই পাল্টে যেতে পারে। যদি মামদানি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হন, তাহলে তা তাঁর মতো প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সামাদ বলেন, ‘আমি কখনো মনে করিনি যে কোনো প্রার্থী আমার মতো নিউইয়র্কারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কিন্তু মামদানি আমাকে সে আশা দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন এটা তাঁর দায়িত্ব—আমাদের এই আশাকে সঠিক বলে প্রমাণ করা। না হলে নিউইয়র্কাররা তাঁকে বিদায় জানাতে দেরি করবে না। আমেরিকানরা এমনই।’
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় এক বছর পূর্তির লগ্নে এই নির্বাচনকে ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৮ ঘণ্টা আগে
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১ দিন আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় এক বছর পূর্তির লগ্নে এই নির্বাচনকে ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। মধ্যপন্থী থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক পর্যন্ত, আদর্শগত দিক থেকে আলাদা ঘরানার ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরাও এই জয়ে বিজয়ী হয়েছেন। স্পষ্টত ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য এটি এক নতুন পথের ইঙ্গিত।
ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাট ও সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার। রিপাবলিকান লেফটেন্যান্ট গভর্নর উইনসাম আর্লে-সিয়ার্সকে পরাজিত করে তিনি রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে রেকর্ড গড়লেন।
এই জয়ের পেছনে রয়েছে উত্তর ভার্জিনিয়ার শহরতলি ও আধা শহরতলির লুডন কাউন্টির মতো অঞ্চলগুলোর ‘সাব-আরবান সুইং’। স্প্যানবার্গারের বিজয়ের আধিপত্য বুঝতে এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট: লুডন কাউন্টিতে তিনি ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। এই অনুপাত ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
সিএনএনের এক্সিট পোল অনুসারে যেসব পরিবারে কোনো ফেডারেল কর্মী বা ফেডারেল ঠিকাদার আছেন, স্প্যানবার্গার তাঁদের ৬১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের ফেডারেল কর্মী বাহিনীকে দুর্বল করার নীতির প্রতি এই অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক ভোটারের অসন্তোষের ইঙ্গিত।
স্প্যানবার্গারের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জে জনস, যিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৫ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিলেন, তিনিও জয়লাভ করতে সক্ষম হন।
নিউ জার্সিতে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি মিকি শেরিল জয়লাভ করেন, এটিও রাজ্যের ট্রাম্পবিরোধী মনোভাবের স্পষ্ট প্রতিফলন। এই রাজ্যে নিবন্ধিত ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের চেয়ে ৮ লাখের বেশি হওয়া সত্ত্বেও রিপাবলিকান প্রার্থী জ্যাক চিয়াত্তারেল্লি তাঁর আঞ্চলিক অহম ‘জার্সি গাই’ ক্যাম্পেইন এবং ট্রাম্পের সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
সিএনএনের এক্সিট পোল অনুযায়ী, শেরিল লাতিনো ভোটারদের ৬৪ শতাংশ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের ৯১ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন।
যেখানে চিয়াত্তারেল্লি সহজে জিতেছেন, সেখানকার ভোটদাতাদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ মনে করেন, শুল্ক-কর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে ৩২ শতাংশ ভোটার যখন অর্থনীতিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের ৬১ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশ ব্যবধানে শেরিলকে সমর্থন দিয়েছেন। এটিই জয়ের মূল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক সিটিতে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক জোহরান মামদানি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে দ্বিতীয়বারের মতো (প্রাইমারির পর) পরাজিত করেন। যেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই স্বতন্ত্র প্রার্থী কুমোকে ভোট দেওয়ার জন্য রিপাবলিকানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কুমোর জন্য এটি একটি চরম বিব্রতকর ঘটনা। ট্রাম্পের পক্ষ থেকেও এটি একটি ব্যর্থতা। তিনি কুমোকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘যদি একজন খারাপ ডেমোক্র্যাট এবং একজন কমিউনিস্টের মধ্যে বেছে নিতে হয়, আমি সব সময় খারাপ ডেমোক্র্যাটকেই বেছে নেব।’
মামদানি তাঁর প্রচারে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর ওপর ক্রমাগত জোর দিয়েছেন। তাঁর জয়ের ফলে সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন নির্মাণের পথে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোর জন্য অনুমোদিত ব্যালট প্রস্তাবগুলো কার্যকর হলে নিউইয়র্ক সিটি দেশের অন্যান্য শহরের জন্য একটি আদর্শ মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ভোটাররাও একটি সীমানা পুনর্নির্ধারণ ব্যালট প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন, যা আগামী বছর হাউস দখলে ডেমোক্র্যাটদের আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটরা পাঁচটি অতিরিক্ত অনুকূল নির্বাচনী এলাকা পেতে পারেন।
গভর্নর গ্যাভিন নিউসম এই প্রচেষ্টার প্রধান মুখ ছিলেন। তিনি এই জন্য ১০৮ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেন এবং প্রচারণায় নিজে উপস্থিত থাকেন। এটি নিউসমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মুহূর্ত। ২০২৮ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সক্ষমতা প্রদর্শনের একটি সুযোগ।
এসব বড় জয়ের বাইরেও ডেমোক্র্যাটরা ছোটখাটো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন:
পেনসিলভানিয়া: ডেমোক্র্যাট রাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তাঁদের ১০ বছরের নতুন মেয়াদ নিশ্চিত করেছেন। ফলে এই ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ রাজ্যের আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ডেমোক্র্যাটদের হাতেই রইল।
মেইন: ভোটাররা এমন একটি ব্যালট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে ভোট দেওয়ার সময় ছবিসহ পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করার মতো কড়া নিয়ম ছিল।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে এই নির্বাচন ডেমোক্র্যাটদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক (মধ্যপন্থী বনাম প্রগতিশীল) মেটাতে সামান্যই সাহায্য করবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি অসন্তোষ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর সম্মিলিত বার্তাটি তাদের জন্য আগামী নির্বাচনী লড়াইয়ে জেতার একটি সূত্র দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় এক বছর পূর্তির লগ্নে এই নির্বাচনকে ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। মধ্যপন্থী থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক পর্যন্ত, আদর্শগত দিক থেকে আলাদা ঘরানার ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরাও এই জয়ে বিজয়ী হয়েছেন। স্পষ্টত ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য এটি এক নতুন পথের ইঙ্গিত।
ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাট ও সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার। রিপাবলিকান লেফটেন্যান্ট গভর্নর উইনসাম আর্লে-সিয়ার্সকে পরাজিত করে তিনি রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে রেকর্ড গড়লেন।
এই জয়ের পেছনে রয়েছে উত্তর ভার্জিনিয়ার শহরতলি ও আধা শহরতলির লুডন কাউন্টির মতো অঞ্চলগুলোর ‘সাব-আরবান সুইং’। স্প্যানবার্গারের বিজয়ের আধিপত্য বুঝতে এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট: লুডন কাউন্টিতে তিনি ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। এই অনুপাত ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
সিএনএনের এক্সিট পোল অনুসারে যেসব পরিবারে কোনো ফেডারেল কর্মী বা ফেডারেল ঠিকাদার আছেন, স্প্যানবার্গার তাঁদের ৬১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের ফেডারেল কর্মী বাহিনীকে দুর্বল করার নীতির প্রতি এই অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক ভোটারের অসন্তোষের ইঙ্গিত।
স্প্যানবার্গারের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জে জনস, যিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৫ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিলেন, তিনিও জয়লাভ করতে সক্ষম হন।
নিউ জার্সিতে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি মিকি শেরিল জয়লাভ করেন, এটিও রাজ্যের ট্রাম্পবিরোধী মনোভাবের স্পষ্ট প্রতিফলন। এই রাজ্যে নিবন্ধিত ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের চেয়ে ৮ লাখের বেশি হওয়া সত্ত্বেও রিপাবলিকান প্রার্থী জ্যাক চিয়াত্তারেল্লি তাঁর আঞ্চলিক অহম ‘জার্সি গাই’ ক্যাম্পেইন এবং ট্রাম্পের সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
সিএনএনের এক্সিট পোল অনুযায়ী, শেরিল লাতিনো ভোটারদের ৬৪ শতাংশ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের ৯১ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন।
যেখানে চিয়াত্তারেল্লি সহজে জিতেছেন, সেখানকার ভোটদাতাদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ মনে করেন, শুল্ক-কর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে ৩২ শতাংশ ভোটার যখন অর্থনীতিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের ৬১ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশ ব্যবধানে শেরিলকে সমর্থন দিয়েছেন। এটিই জয়ের মূল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক সিটিতে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক জোহরান মামদানি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে দ্বিতীয়বারের মতো (প্রাইমারির পর) পরাজিত করেন। যেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই স্বতন্ত্র প্রার্থী কুমোকে ভোট দেওয়ার জন্য রিপাবলিকানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কুমোর জন্য এটি একটি চরম বিব্রতকর ঘটনা। ট্রাম্পের পক্ষ থেকেও এটি একটি ব্যর্থতা। তিনি কুমোকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘যদি একজন খারাপ ডেমোক্র্যাট এবং একজন কমিউনিস্টের মধ্যে বেছে নিতে হয়, আমি সব সময় খারাপ ডেমোক্র্যাটকেই বেছে নেব।’
মামদানি তাঁর প্রচারে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর ওপর ক্রমাগত জোর দিয়েছেন। তাঁর জয়ের ফলে সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন নির্মাণের পথে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোর জন্য অনুমোদিত ব্যালট প্রস্তাবগুলো কার্যকর হলে নিউইয়র্ক সিটি দেশের অন্যান্য শহরের জন্য একটি আদর্শ মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ভোটাররাও একটি সীমানা পুনর্নির্ধারণ ব্যালট প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন, যা আগামী বছর হাউস দখলে ডেমোক্র্যাটদের আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটরা পাঁচটি অতিরিক্ত অনুকূল নির্বাচনী এলাকা পেতে পারেন।
গভর্নর গ্যাভিন নিউসম এই প্রচেষ্টার প্রধান মুখ ছিলেন। তিনি এই জন্য ১০৮ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেন এবং প্রচারণায় নিজে উপস্থিত থাকেন। এটি নিউসমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মুহূর্ত। ২০২৮ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সক্ষমতা প্রদর্শনের একটি সুযোগ।
এসব বড় জয়ের বাইরেও ডেমোক্র্যাটরা ছোটখাটো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন:
পেনসিলভানিয়া: ডেমোক্র্যাট রাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তাঁদের ১০ বছরের নতুন মেয়াদ নিশ্চিত করেছেন। ফলে এই ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ রাজ্যের আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ডেমোক্র্যাটদের হাতেই রইল।
মেইন: ভোটাররা এমন একটি ব্যালট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে ভোট দেওয়ার সময় ছবিসহ পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করার মতো কড়া নিয়ম ছিল।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে এই নির্বাচন ডেমোক্র্যাটদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক (মধ্যপন্থী বনাম প্রগতিশীল) মেটাতে সামান্যই সাহায্য করবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি অসন্তোষ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর সম্মিলিত বার্তাটি তাদের জন্য আগামী নির্বাচনী লড়াইয়ে জেতার একটি সূত্র দিতে পারে।

আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির জয় কী কোনো পথনির্দেশ নাকি অসংগতি? গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রশ্ন ঘিরে রেখেছিল জোহরান মামদানিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।
৫ ঘণ্টা আগে
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১ দিন আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
ভারতের বিহার রাজ্যে ভোটার তালিকা যাচাইয়ের বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য—প্রতিটি নিবন্ধিত ভোটারের পরিচয় যাচাই করা এবং রাজ্যের বাইরে থাকা ও মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ক্লেরেন্স টপ্পো এই যাচাই অভিযানের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে কেউ কোনো নথি দেখতে আসেনি, নাগরিকদেরও কেউ নিজ গরজে কাগজপত্র জমা দিতে যায়নি।
টপ্পোর জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি জানতে পারেন, যে বিহারে যিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানেই নাকি তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, নথিপত্র দেখাচ্ছে তিনি নাকি রাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। তাঁর দুই ভাইয়ের নামও অনুপস্থিতদের তালিকায়। অথচ, তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল একজন অন্য রাজ্যে গেছেন। টপ্পো বলেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি ভারতে থাকার পরও যদি আমার ভোটার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়—তাহলে সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার।’
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনেক সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, টপ্পো এই ধর্মের মানুষ। পাশাপাশি তিনি দলিত, অর্থাৎ ভারতের বর্ণ প্রথায় ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছে—এমনটা ভেবে টপ্পো চেয়েছিলেন নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিতে’। কিন্তু পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শোনার পর তাঁর সেই আশাও শেষ! টপ্পো বলেন, ‘ভোট আমাদের দেশের লাগাম ধরার অধিকার। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’
বিহারে চলমান ভোটার যাচাই প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ কার্যত ভোটাধিকার হারিয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেওয়ার নতুন কৌশল। বিহারের প্রায় ৬৮ লাখ ভোটারের নাম, অর্থাৎ মোট ৭ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ, এই যাচাই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে— স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। এই প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। রায় এলে নতুন ভোটার তালিকা বাতিলও হতে পারে।
এসআইআর-এর প্রথম ধাপে নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) কর্মীদের এক মাসের মধ্যে বিহারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহ করে একটি খসড়া তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় এবং হয়ওনি। বিহার পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) সাধারণ সম্পাদক সরফরাজ উদ্দিন বলেন, ‘এক মাসে প্রতিটি ঘরে যাওয়া, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করা, ফরম নেওয়া এবং নথি সংযুক্ত করা—একেবারেই অসম্ভব।’
সরফরাজ জানান, ২০০৩ সালে এসআইআর সম্পূর্ণ করতে এক বছর লেগেছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তবু প্রত্যেককে এক মাসে প্রায় ৯০০ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই শর্টকাটে কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মাঠকর্মীরা কাউকে খুঁজে পেতেন না, তখন নিজেরাই ফরম পূরণ করে সেখানে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন। ফলে অনেক প্রকৃত ভোটার বাদ পড়েছেন, আবার যারা বিহারে নেই তাদের অনেকের নাম তালিকায় থেকে গেছে।’
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া কেবল অসতর্কতার ফল নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। দিল্লির আইনজীবী ও এই প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘যদি তারা সচেতনভাবে সেই সব মানুষকে ভোটের বাইরে রাখে, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দেয় না, তাহলে এর প্রভাব বিশাল হবে। সাধারণত নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোটে।’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমনমূলক নীতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আর খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝাড়খণ্ডের আলাদা হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্য হয়। বিহারকে বলা হয় জাতপাতভিত্তিক অস্থির রাজনীতির এক ফুটন্ত কড়াই। একই নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করছেন—একবার এই জোটে, আরেকবার প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে যোগ দিয়ে। বিহারের সংবাদমাধ্যম ডেমোক্রেটিক চরখার সম্পাদক আমির আব্বাস বলেন, এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো বিহারকে বলা হয় ‘ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগার’।
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়লেও ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজ্য হিসেবে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজন করে বিহার। ফলে রাজনীতিকেরা দেশজুড়ে তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও মুখে মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মেনেই বিশাল জনসভা করেন। দুই বছর পর, বিহার আবারও প্রথম রাজ্য হিসেবে জনগণনার সময় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এই তথ্য পরে সর্বভারতীয় জনগণনায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আমির আব্বাসের আশঙ্কা, এবার যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ভোটারদের বঞ্চিত করার এক নতুন পরীক্ষা। সমালোচকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে—যাঁরা সাধারণত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী জোটকে সমর্থন করেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১ ধরনের কাগজপত্রের যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বিহারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা, সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত পরিচয়পত্র আধার কার্ড ওই তালিকায় ছিল না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, বরং যে নথিগুলো এসআইআর প্রক্রিয়ায় চাওয়া হয়েছিল—যেমন দশম শ্রেণির ভর্তি ফর্ম বা জমির দলিল—সেগুলো রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছেই নেই।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এসআইআর–এর দ্বিতীয় ধাপে, যাঁরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা আপত্তি জানিয়ে পুনরায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০ শতাংশ। ফলে অনেকে নিজের নাম বাদ পড়েছে কিনা, সেটিই যাচাই করতে পারেননি। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ পায় আরও দুই সপ্তাহ পর—১৭ আগস্ট।
এই খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটনার মুসলিম অধ্যুষিত ফুলওয়ারি শরিফ এলাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে লোকজনকে জানান দিচ্ছিলেন সমাজকর্মী জাহিব আজমল। তিনি তাঁদের জানাচ্ছিলেন—তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। আজমল বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন, ‘আমরা তো জানিই না কীভাবে তালিকা দেখতে হয়। আমাদের নাম কখনো বাদ পড়েনি। তাহলে কেন বাদ যাবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
সরকারি এই এসআইআর তালিকায় অস্পষ্ট ঠিকানা আর ভুল তথ্যের কারণে কর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আজমল বলেন, ‘তথ্য এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না। কোনো একটি এলাকায় যদি আপনার কেউ পরিচিত না থাকে তাহলে সেখানে কেবল তালিকা ধরে কাউকে খুঁজে পাবেন না।’
প্রথম ধাপের নির্বাচনী নিবন্ধন যাচাই (এসআইআর) শেষে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ভোটার নিবন্ধন করেন। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই নতুন ভোটার। তারা আগের তালিকায় ছিলেন না। অন্যদিকে, শুধু বিহারেই প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নির্দেশনাও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রশান্ত ভূষণ। তাঁর অভিযোগ, কমিশন ‘আসলে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা যদি ইচ্ছা করে সংখ্যালঘু ও দলিতদের মতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে, আর এমন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—যারা বিজেপিকে ভোট দেয়, তাহলে তারা অবশ্যই সেটা করবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী টপ্পো মনে করেন, তাঁর পরিবারের দ্বৈত সংখ্যালঘু পরিচয়ই (দলিত ও খ্রিষ্টান) হয়তো তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘একে আমি তফসিলি জাতির মানুষ, আবার খ্রিষ্টানও। এ কারণে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ অবশ্য পরে, স্থানীয় এক সাংবাদিক টপ্পোর ঘটনা প্রকাশ করার পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা এসে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের নাম পুনরায় নিবন্ধন করেন।
ভোটার যাচাই অভিযানের প্রভাব শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহারের এই যাচাই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মোদি সরকার এমন এক উদ্যোগ চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে বৈধ কাগজপত্রবিহীন মুসলমানদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিহারেও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এই যাচাই প্রক্রিয়া অবৈধ বিদেশিদের ভোট দেওয়া ঠেকাবে।
তবে বিরোধী দল ও অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, ভবিষ্যতে তাদের একইভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) মুখপাত্র কুমার পারভেজ বলেন, ‘যদি তাদের নাম ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে আগামী দিনে তারা নাগরিক হিসেবেও থাকবেন না।’
ভোটার নিবন্ধনকে নাগরিকত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা মোদির বিজেপির এক পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯ সাল থেকে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সারা দেশে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান চালাবে। এখন পর্যন্ত একমাত্র যে রাজ্যে যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দেখাতে হয়েছিল—১৯৭১ সালের আগে পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ভোটার তালিকায় ছিল কি না।
বিহারের অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা তাদের পরিবারের নাগরিকত্বই বিপন্ন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী কৃষ্ণ দয়াল সিংকে টপ্পোর মায়ের মতো ‘মেরে ফেলেছিল’ ভারত সরকার। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার সন্তানেরা হয়তো এমন প্রশ্নের মুখে পড়বে যে, “তোমার দাদু তো ভোটার ছিলেন না, নাগরিকও ছিলেন না, তাহলে তুমি এ দেশে এলে কীভাবে?”’
দয়াল সিং জানান, তাঁর অবশ্য কপাল ভালো। কারণ, প্রথম ধাপের এসআইআর–এ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটার হিসেবে পুনর্নিবন্ধনের আবেদন করান।
অনেকের কাছে এই ভোটার নিবন্ধন লাইফলাইন বা জীবনরেখার মতো। ৯২ বছর বয়সী জিতনি দেবী তাঁর মাসিক সরকারি পেনশন ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে খাবার এবং ওষুধের খরচ চালাতেন। এসআইআর চলাকালে, দেবীর পরিবারের ৭ জনের মধ্যে মাত্র দুজন তাদের গণনা ফর্ম জমা দিয়েছিলেন। নিরক্ষর জিতনি দেবী প্রথমে এই প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেননি। অবশ্য দেওয়ার কোনো কারণও ছিল না। কারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে আলমপুরে গ্রামে যাননি।
কিন্তু আগস্টে দেবী ব্যাংকে পেনশন নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, তিনি আর নিবন্ধিত নন। যেহেতু নিবন্ধন নেই, তাই তাঁর পেনশনও নেই। পরে, স্থানীয় এনজিও মানথনের এক কর্মী তাঁকে জানান যে, এসআইআর–এ তাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে।
জিতনি দেবী বলেন, ‘আমি জানি না আমি কী করব। আমি জানি না, সরকারই বা আমার সঙ্গে কী করবে। আমি জানি না আমি কীভাবে বাঁচব।’
এসআইআর-এর প্রভাব কতটা, তার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পেতে মাস কয়েক লাগবে। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অক্টোবর পর্যন্ত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চালিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত এসআইআর-এর ফলাফল বাতিল করতে পারে। ফলে বিহার রাজ্যে বিজেপি কি শাসক জোটের নেতৃত্বে থাকবে না কি থাকবে না—তা ১৪ নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে।
কিন্তু যা কিছু বিহারে ঘটছে, শিগগিরই দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে। রাজ্যের ভোটার যাচাই অভিযান শেষের পথে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্য-স্তরের সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সারা দেশে এসআইআর-এর প্রস্তুতি নিতে। গত ২৭ অক্টোবর আরও ১২টি অতিরিক্ত রাজ্য ও অঞ্চলে এসআইআর শুরু হয়েছে। এসব রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি ভোটার আছে।
১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব যাচাই করার বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ৯ কোটি ভারতীয় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। আর এ কারণেই মূলত বিহারের ঘটনা জাতীয় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত আগস্টে বিরোধীদলীয় সাংসদ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিহারে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর নেতারাও সেখানে অংশ নেন।
বিহারের ভোটার যাচাই অভিযান এখন নাগরিক সমাজ কর্মী ও বিরোধীদলীয় দলগুলোর চোখে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈধতা রক্ষার নতুন সংগ্রাম। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের ভাইস–প্রেসিডেন্ট পুষ্পেন্দ্র বলেন, ‘এখন এটা একজাতীয় অভিযান। এই এসআইআর অন্য রাজ্যেও যাচ্ছে এবং তারা (বিরোধী দল) জানে যে, তাদের এমন ক্যাম্পেইন গড়ে তুলতে হবে যাতে এই প্রক্রিয়াকে পরাস্ত করা যায়।’
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
ভারতের বিহার রাজ্যে ভোটার তালিকা যাচাইয়ের বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য—প্রতিটি নিবন্ধিত ভোটারের পরিচয় যাচাই করা এবং রাজ্যের বাইরে থাকা ও মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ক্লেরেন্স টপ্পো এই যাচাই অভিযানের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে কেউ কোনো নথি দেখতে আসেনি, নাগরিকদেরও কেউ নিজ গরজে কাগজপত্র জমা দিতে যায়নি।
টপ্পোর জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি জানতে পারেন, যে বিহারে যিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানেই নাকি তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, নথিপত্র দেখাচ্ছে তিনি নাকি রাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। তাঁর দুই ভাইয়ের নামও অনুপস্থিতদের তালিকায়। অথচ, তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল একজন অন্য রাজ্যে গেছেন। টপ্পো বলেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি ভারতে থাকার পরও যদি আমার ভোটার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়—তাহলে সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার।’
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনেক সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, টপ্পো এই ধর্মের মানুষ। পাশাপাশি তিনি দলিত, অর্থাৎ ভারতের বর্ণ প্রথায় ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছে—এমনটা ভেবে টপ্পো চেয়েছিলেন নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিতে’। কিন্তু পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শোনার পর তাঁর সেই আশাও শেষ! টপ্পো বলেন, ‘ভোট আমাদের দেশের লাগাম ধরার অধিকার। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’
বিহারে চলমান ভোটার যাচাই প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ কার্যত ভোটাধিকার হারিয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেওয়ার নতুন কৌশল। বিহারের প্রায় ৬৮ লাখ ভোটারের নাম, অর্থাৎ মোট ৭ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ, এই যাচাই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে— স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। এই প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। রায় এলে নতুন ভোটার তালিকা বাতিলও হতে পারে।
এসআইআর-এর প্রথম ধাপে নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) কর্মীদের এক মাসের মধ্যে বিহারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহ করে একটি খসড়া তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় এবং হয়ওনি। বিহার পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) সাধারণ সম্পাদক সরফরাজ উদ্দিন বলেন, ‘এক মাসে প্রতিটি ঘরে যাওয়া, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করা, ফরম নেওয়া এবং নথি সংযুক্ত করা—একেবারেই অসম্ভব।’
সরফরাজ জানান, ২০০৩ সালে এসআইআর সম্পূর্ণ করতে এক বছর লেগেছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তবু প্রত্যেককে এক মাসে প্রায় ৯০০ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই শর্টকাটে কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মাঠকর্মীরা কাউকে খুঁজে পেতেন না, তখন নিজেরাই ফরম পূরণ করে সেখানে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন। ফলে অনেক প্রকৃত ভোটার বাদ পড়েছেন, আবার যারা বিহারে নেই তাদের অনেকের নাম তালিকায় থেকে গেছে।’
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া কেবল অসতর্কতার ফল নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। দিল্লির আইনজীবী ও এই প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘যদি তারা সচেতনভাবে সেই সব মানুষকে ভোটের বাইরে রাখে, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দেয় না, তাহলে এর প্রভাব বিশাল হবে। সাধারণত নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোটে।’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমনমূলক নীতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আর খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝাড়খণ্ডের আলাদা হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্য হয়। বিহারকে বলা হয় জাতপাতভিত্তিক অস্থির রাজনীতির এক ফুটন্ত কড়াই। একই নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করছেন—একবার এই জোটে, আরেকবার প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে যোগ দিয়ে। বিহারের সংবাদমাধ্যম ডেমোক্রেটিক চরখার সম্পাদক আমির আব্বাস বলেন, এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো বিহারকে বলা হয় ‘ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগার’।
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়লেও ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজ্য হিসেবে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজন করে বিহার। ফলে রাজনীতিকেরা দেশজুড়ে তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও মুখে মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মেনেই বিশাল জনসভা করেন। দুই বছর পর, বিহার আবারও প্রথম রাজ্য হিসেবে জনগণনার সময় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এই তথ্য পরে সর্বভারতীয় জনগণনায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আমির আব্বাসের আশঙ্কা, এবার যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ভোটারদের বঞ্চিত করার এক নতুন পরীক্ষা। সমালোচকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে—যাঁরা সাধারণত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী জোটকে সমর্থন করেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১ ধরনের কাগজপত্রের যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বিহারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা, সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত পরিচয়পত্র আধার কার্ড ওই তালিকায় ছিল না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, বরং যে নথিগুলো এসআইআর প্রক্রিয়ায় চাওয়া হয়েছিল—যেমন দশম শ্রেণির ভর্তি ফর্ম বা জমির দলিল—সেগুলো রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছেই নেই।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এসআইআর–এর দ্বিতীয় ধাপে, যাঁরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা আপত্তি জানিয়ে পুনরায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০ শতাংশ। ফলে অনেকে নিজের নাম বাদ পড়েছে কিনা, সেটিই যাচাই করতে পারেননি। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ পায় আরও দুই সপ্তাহ পর—১৭ আগস্ট।
এই খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটনার মুসলিম অধ্যুষিত ফুলওয়ারি শরিফ এলাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে লোকজনকে জানান দিচ্ছিলেন সমাজকর্মী জাহিব আজমল। তিনি তাঁদের জানাচ্ছিলেন—তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। আজমল বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন, ‘আমরা তো জানিই না কীভাবে তালিকা দেখতে হয়। আমাদের নাম কখনো বাদ পড়েনি। তাহলে কেন বাদ যাবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
সরকারি এই এসআইআর তালিকায় অস্পষ্ট ঠিকানা আর ভুল তথ্যের কারণে কর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আজমল বলেন, ‘তথ্য এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না। কোনো একটি এলাকায় যদি আপনার কেউ পরিচিত না থাকে তাহলে সেখানে কেবল তালিকা ধরে কাউকে খুঁজে পাবেন না।’
প্রথম ধাপের নির্বাচনী নিবন্ধন যাচাই (এসআইআর) শেষে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ভোটার নিবন্ধন করেন। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই নতুন ভোটার। তারা আগের তালিকায় ছিলেন না। অন্যদিকে, শুধু বিহারেই প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নির্দেশনাও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রশান্ত ভূষণ। তাঁর অভিযোগ, কমিশন ‘আসলে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা যদি ইচ্ছা করে সংখ্যালঘু ও দলিতদের মতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে, আর এমন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—যারা বিজেপিকে ভোট দেয়, তাহলে তারা অবশ্যই সেটা করবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী টপ্পো মনে করেন, তাঁর পরিবারের দ্বৈত সংখ্যালঘু পরিচয়ই (দলিত ও খ্রিষ্টান) হয়তো তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘একে আমি তফসিলি জাতির মানুষ, আবার খ্রিষ্টানও। এ কারণে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ অবশ্য পরে, স্থানীয় এক সাংবাদিক টপ্পোর ঘটনা প্রকাশ করার পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা এসে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের নাম পুনরায় নিবন্ধন করেন।
ভোটার যাচাই অভিযানের প্রভাব শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহারের এই যাচাই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মোদি সরকার এমন এক উদ্যোগ চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে বৈধ কাগজপত্রবিহীন মুসলমানদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিহারেও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এই যাচাই প্রক্রিয়া অবৈধ বিদেশিদের ভোট দেওয়া ঠেকাবে।
তবে বিরোধী দল ও অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, ভবিষ্যতে তাদের একইভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) মুখপাত্র কুমার পারভেজ বলেন, ‘যদি তাদের নাম ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে আগামী দিনে তারা নাগরিক হিসেবেও থাকবেন না।’
ভোটার নিবন্ধনকে নাগরিকত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা মোদির বিজেপির এক পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯ সাল থেকে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সারা দেশে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান চালাবে। এখন পর্যন্ত একমাত্র যে রাজ্যে যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দেখাতে হয়েছিল—১৯৭১ সালের আগে পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ভোটার তালিকায় ছিল কি না।
বিহারের অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা তাদের পরিবারের নাগরিকত্বই বিপন্ন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী কৃষ্ণ দয়াল সিংকে টপ্পোর মায়ের মতো ‘মেরে ফেলেছিল’ ভারত সরকার। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার সন্তানেরা হয়তো এমন প্রশ্নের মুখে পড়বে যে, “তোমার দাদু তো ভোটার ছিলেন না, নাগরিকও ছিলেন না, তাহলে তুমি এ দেশে এলে কীভাবে?”’
দয়াল সিং জানান, তাঁর অবশ্য কপাল ভালো। কারণ, প্রথম ধাপের এসআইআর–এ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটার হিসেবে পুনর্নিবন্ধনের আবেদন করান।
অনেকের কাছে এই ভোটার নিবন্ধন লাইফলাইন বা জীবনরেখার মতো। ৯২ বছর বয়সী জিতনি দেবী তাঁর মাসিক সরকারি পেনশন ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে খাবার এবং ওষুধের খরচ চালাতেন। এসআইআর চলাকালে, দেবীর পরিবারের ৭ জনের মধ্যে মাত্র দুজন তাদের গণনা ফর্ম জমা দিয়েছিলেন। নিরক্ষর জিতনি দেবী প্রথমে এই প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেননি। অবশ্য দেওয়ার কোনো কারণও ছিল না। কারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে আলমপুরে গ্রামে যাননি।
কিন্তু আগস্টে দেবী ব্যাংকে পেনশন নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, তিনি আর নিবন্ধিত নন। যেহেতু নিবন্ধন নেই, তাই তাঁর পেনশনও নেই। পরে, স্থানীয় এনজিও মানথনের এক কর্মী তাঁকে জানান যে, এসআইআর–এ তাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে।
জিতনি দেবী বলেন, ‘আমি জানি না আমি কী করব। আমি জানি না, সরকারই বা আমার সঙ্গে কী করবে। আমি জানি না আমি কীভাবে বাঁচব।’
এসআইআর-এর প্রভাব কতটা, তার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পেতে মাস কয়েক লাগবে। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অক্টোবর পর্যন্ত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চালিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত এসআইআর-এর ফলাফল বাতিল করতে পারে। ফলে বিহার রাজ্যে বিজেপি কি শাসক জোটের নেতৃত্বে থাকবে না কি থাকবে না—তা ১৪ নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে।
কিন্তু যা কিছু বিহারে ঘটছে, শিগগিরই দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে। রাজ্যের ভোটার যাচাই অভিযান শেষের পথে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্য-স্তরের সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সারা দেশে এসআইআর-এর প্রস্তুতি নিতে। গত ২৭ অক্টোবর আরও ১২টি অতিরিক্ত রাজ্য ও অঞ্চলে এসআইআর শুরু হয়েছে। এসব রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি ভোটার আছে।
১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব যাচাই করার বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ৯ কোটি ভারতীয় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। আর এ কারণেই মূলত বিহারের ঘটনা জাতীয় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত আগস্টে বিরোধীদলীয় সাংসদ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিহারে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর নেতারাও সেখানে অংশ নেন।
বিহারের ভোটার যাচাই অভিযান এখন নাগরিক সমাজ কর্মী ও বিরোধীদলীয় দলগুলোর চোখে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈধতা রক্ষার নতুন সংগ্রাম। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের ভাইস–প্রেসিডেন্ট পুষ্পেন্দ্র বলেন, ‘এখন এটা একজাতীয় অভিযান। এই এসআইআর অন্য রাজ্যেও যাচ্ছে এবং তারা (বিরোধী দল) জানে যে, তাদের এমন ক্যাম্পেইন গড়ে তুলতে হবে যাতে এই প্রক্রিয়াকে পরাস্ত করা যায়।’
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির জয় কী কোনো পথনির্দেশ নাকি অসংগতি? গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রশ্ন ঘিরে রেখেছিল জোহরান মামদানিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।
৫ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় এক বছর পূর্তির লগ্নে এই নির্বাচনকে ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৮ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র এই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাদের এই উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাসে নয়, রাজনীতির মানসেও এক ধারণা গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্মগত অধিকারও হতে পারে। এই চিন্তাই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতির প্রতিটি দলে, প্রতিটি প্রদেশে, আর প্রতিটি স্তরে।
কেবল নেহরু–গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধেই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হলেও, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি আসলে ভারতের প্রায় সব দলেই দেখা যায়। জনতা দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় বাবার খালি আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন বাবার নাম অনুসারে ‘বিজু জনতা দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজুর পথ অনুসরণ করে নবীন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করেন।
মহারাষ্ট্রের দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মৃত্যুর আগে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরেও এখন রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। একই ধারা দেখা যায় সমাজবাদী পার্টিতেও। দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবও সেই পদে আসেন। এখন তিনি দলের সভাপতি ও এমপি। বিহারের লোক জনশক্তি পার্টিতেও একই চিত্র। প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসওয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও এই বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। জম্মু–কাশ্মীরে তিন প্রজন্ম ধরে আবদুল্লাহ পরিবার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বিরোধী শিবিরে নেতৃত্বে আছে মুফতি পরিবারের দুই প্রজন্ম। পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন শিরোমণি আকালি দল পরিচালনা করেছেন প্রকাশ সিং বাদল। এখন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল দলের প্রধান। তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই এখন উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবার এখনো ক্ষমতাসীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ছেলে এমকে স্ট্যালিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, আর তাঁর নাতিকে ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এটি শুধু কিছু বিখ্যাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থার গাঁথুনিতেই এই পারিবারিক রাজনীতি বীজ গভীরভাবে বোনা। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার থেকে একাধিক সদস্য রাজ্যের আইনসভায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ও ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীরও পারিবারিক রাজনৈতিক সংযোগ আছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ না কেউ রাজনীতিতে ছিলেন। তরুণ সাংসদদের প্রায় সবাই কোনো আত্মীয়—সাধারণত বাবা বা মা—থেকে আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নারী সাংসদদের ৭০ শতাংশ বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফল। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিকের সরাসরি উত্তরসূরি নেই, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুমারী মায়াবতী, তাঁরাও তাঁদের ভাতিজাদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তুলছেন।
ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি গোটা উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষে পরিবার। তবে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এই প্রবণতা কিছুটা বেমানান বলেই মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন ভারত এত গভীরভাবে এই পারিবারিক রাজনীতি মেনে নিয়েছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—পরিবার একটি কার্যকর রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের মনোযোগ পেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে একসময় গ্রহণ করে থাকেন, তবে তাঁরা সম্ভবত একই পরিবারের নতুন প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এভাবে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় না। ভারতের অতীত প্রেক্ষাপটে, যখন সাক্ষরতার হার ও গণমাধ্যমের প্রভাব কম ছিল, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু সাক্ষরতার হার যখন ৮১ শতাংশের কাছাকাছি এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন বোঝা যায় অন্য আরও কিছু কারণ আছে এর পেছনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো—দলীয় রাজনীতির ভেতরকার চর্চা ও গতিপ্রকৃতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রায় অস্বচ্ছ। প্রায় সব দলেই সিদ্ধান্ত নেয় একদল ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কখনো বা একক কোনো নেতা, যাদের আবার পরিবর্তন আনাতে আগ্রহ কম। ফলে, যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কই সাধারণত বেশি মূল্য পায়।
এ অবস্থায় প্রার্থী হতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নতুনদের জন্য বাধা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলোর হাতে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক পুঁজি, যা তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে জমিয়েছে। তাদের আছে তৈরি নির্বাচনী কাঠামো—দাতা, কর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক। এতে করে নতুন রাজনীতিকদের তুলনায় তাদের সুবিধা অনেক বেশি।
ভারতের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পেছনে সাংস্কৃতিক কারণও আছে। আধুনিকায়নের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজে এখনো জমিদারি মানসিকতা টিকে আছে। আগের দিনে যেভাবে স্থানীয় জমিদার বা রাজাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো, এখন সেই শ্রদ্ধা দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এতে মনে হয় রাজনৈতিক অভিজাতরা যেন অন্য শ্রেণির মানুষ, যাদের পরিবারই ক্ষমতার উপযুক্ত। এই অহংবোধ এতটাই গভীর যে দুর্বল কর্মক্ষমতাও তাদের নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারে না। বারবার নির্বাচনে হারলেও তারা দলীয় নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এ ধরনের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বংশপরম্পরায়, যোগ্যতা, নিষ্ঠা বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদলে, তখন শাসনব্যবস্থার মান নেমে যায়। সীমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া কখনোই সুবিধাজনক নয়। আরও খারাপ হয় যখন প্রার্থীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তার পদবি। এমন নেতারা সাধারণ মানুষের বাস্তব চ্যালেঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে জনগণের প্রয়োজন বুঝে কাজ করার সক্ষমতাও কম থাকে। তবুও তাদের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এখন সময় এসেছে ভারতকে ‘রাজবংশের’ রাজনীতি ছাড়িয়ে যোগ্যতাভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সংস্কার—আইন করে মেয়াদসীমা নির্ধারণ, দলীয় পর্যায়ে প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ভোটারদের সচেতন করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা বাছাইয়ের প্রেরণা জাগানো। যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক থাকবে, তত দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য—‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র এই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাদের এই উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাসে নয়, রাজনীতির মানসেও এক ধারণা গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্মগত অধিকারও হতে পারে। এই চিন্তাই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতির প্রতিটি দলে, প্রতিটি প্রদেশে, আর প্রতিটি স্তরে।
কেবল নেহরু–গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধেই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হলেও, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি আসলে ভারতের প্রায় সব দলেই দেখা যায়। জনতা দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় বাবার খালি আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন বাবার নাম অনুসারে ‘বিজু জনতা দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজুর পথ অনুসরণ করে নবীন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করেন।
মহারাষ্ট্রের দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মৃত্যুর আগে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরেও এখন রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। একই ধারা দেখা যায় সমাজবাদী পার্টিতেও। দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবও সেই পদে আসেন। এখন তিনি দলের সভাপতি ও এমপি। বিহারের লোক জনশক্তি পার্টিতেও একই চিত্র। প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসওয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও এই বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। জম্মু–কাশ্মীরে তিন প্রজন্ম ধরে আবদুল্লাহ পরিবার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বিরোধী শিবিরে নেতৃত্বে আছে মুফতি পরিবারের দুই প্রজন্ম। পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন শিরোমণি আকালি দল পরিচালনা করেছেন প্রকাশ সিং বাদল। এখন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল দলের প্রধান। তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই এখন উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবার এখনো ক্ষমতাসীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ছেলে এমকে স্ট্যালিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, আর তাঁর নাতিকে ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এটি শুধু কিছু বিখ্যাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থার গাঁথুনিতেই এই পারিবারিক রাজনীতি বীজ গভীরভাবে বোনা। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার থেকে একাধিক সদস্য রাজ্যের আইনসভায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ও ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীরও পারিবারিক রাজনৈতিক সংযোগ আছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ না কেউ রাজনীতিতে ছিলেন। তরুণ সাংসদদের প্রায় সবাই কোনো আত্মীয়—সাধারণত বাবা বা মা—থেকে আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নারী সাংসদদের ৭০ শতাংশ বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফল। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিকের সরাসরি উত্তরসূরি নেই, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুমারী মায়াবতী, তাঁরাও তাঁদের ভাতিজাদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তুলছেন।
ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি গোটা উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষে পরিবার। তবে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এই প্রবণতা কিছুটা বেমানান বলেই মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন ভারত এত গভীরভাবে এই পারিবারিক রাজনীতি মেনে নিয়েছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—পরিবার একটি কার্যকর রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের মনোযোগ পেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে একসময় গ্রহণ করে থাকেন, তবে তাঁরা সম্ভবত একই পরিবারের নতুন প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এভাবে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় না। ভারতের অতীত প্রেক্ষাপটে, যখন সাক্ষরতার হার ও গণমাধ্যমের প্রভাব কম ছিল, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু সাক্ষরতার হার যখন ৮১ শতাংশের কাছাকাছি এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন বোঝা যায় অন্য আরও কিছু কারণ আছে এর পেছনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো—দলীয় রাজনীতির ভেতরকার চর্চা ও গতিপ্রকৃতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রায় অস্বচ্ছ। প্রায় সব দলেই সিদ্ধান্ত নেয় একদল ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কখনো বা একক কোনো নেতা, যাদের আবার পরিবর্তন আনাতে আগ্রহ কম। ফলে, যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কই সাধারণত বেশি মূল্য পায়।
এ অবস্থায় প্রার্থী হতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নতুনদের জন্য বাধা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলোর হাতে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক পুঁজি, যা তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে জমিয়েছে। তাদের আছে তৈরি নির্বাচনী কাঠামো—দাতা, কর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক। এতে করে নতুন রাজনীতিকদের তুলনায় তাদের সুবিধা অনেক বেশি।
ভারতের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পেছনে সাংস্কৃতিক কারণও আছে। আধুনিকায়নের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজে এখনো জমিদারি মানসিকতা টিকে আছে। আগের দিনে যেভাবে স্থানীয় জমিদার বা রাজাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো, এখন সেই শ্রদ্ধা দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এতে মনে হয় রাজনৈতিক অভিজাতরা যেন অন্য শ্রেণির মানুষ, যাদের পরিবারই ক্ষমতার উপযুক্ত। এই অহংবোধ এতটাই গভীর যে দুর্বল কর্মক্ষমতাও তাদের নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারে না। বারবার নির্বাচনে হারলেও তারা দলীয় নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এ ধরনের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বংশপরম্পরায়, যোগ্যতা, নিষ্ঠা বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদলে, তখন শাসনব্যবস্থার মান নেমে যায়। সীমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া কখনোই সুবিধাজনক নয়। আরও খারাপ হয় যখন প্রার্থীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তার পদবি। এমন নেতারা সাধারণ মানুষের বাস্তব চ্যালেঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে জনগণের প্রয়োজন বুঝে কাজ করার সক্ষমতাও কম থাকে। তবুও তাদের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এখন সময় এসেছে ভারতকে ‘রাজবংশের’ রাজনীতি ছাড়িয়ে যোগ্যতাভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সংস্কার—আইন করে মেয়াদসীমা নির্ধারণ, দলীয় পর্যায়ে প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ভোটারদের সচেতন করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা বাছাইয়ের প্রেরণা জাগানো। যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক থাকবে, তত দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য—‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্টিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির জয় কী কোনো পথনির্দেশ নাকি অসংগতি? গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রশ্ন ঘিরে রেখেছিল জোহরান মামদানিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।
৫ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় এক বছর পূর্তির লগ্নে এই নির্বাচনকে ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৮ ঘণ্টা আগে
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১ দিন আগে