Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /আসামে নির্বাচনের আগে নয়া চাল, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বলি বাংলাভাষী মুসলিম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৪৮
সাম্প্রতিক সময়ে আসাম সরকার বিপুল বাংলাভাষী মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। ছবি: সিজেপি
সাম্প্রতিক সময়ে আসাম সরকার বিপুল বাংলাভাষী মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। ছবি: সিজেপি

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা একটি এলাকায় নীল ত্রিপলের নিচে মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে শত শত মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশু। সম্প্রতি তাদের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করে দিয়েছে আসাম রাজ্য সরকার। রাজ্যটিতে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান।

এই মানুষগুলো সেই হাজারো পরিবারের অংশ, যাদের বাড়িঘর সম্প্রতি সরকার ‘সরকারি জমিতে অবৈধ বসতি’র অভিযোগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে এত বড় মাত্রায় উচ্ছেদ আগে দেখা যায়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার আগামী বছর অনুষ্ঠেয় বিধানসভা নির্বাচনে আসামে ফের ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছে। আর সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে সেখানে এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। আর গত বছরের আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের’ ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে সারা দেশে কড়া নজরদারি শুরু করেছে ভারত সরকার।

আসামের গোয়ালপাড়া জেলার বাসিন্দা ৫৩ বছর বয়সী আরান আলী। উচ্ছেদের শিকার হয়ে তিনি খোলা আকাশের নিচে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসত গড়েছেন। তাঁর জন্মও আসামেই। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়, আমরা বিদেশি, আমরা অবৈধ দখলদার।’

ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে ৪ হাজার ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত ২৬২ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্যটিতে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালি অভিবাসীদের’ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা এই ‘অভিবাসীদের’ কারণে স্থানীয় সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বিপন্ন হতে পারে বলে মনে করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিযানের লক্ষ্য কেবলই মুসলিমেরা। ইতিমধ্যে বিক্ষোভে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে।

বিজেপি নেতা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।’ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমরা নির্ভয়ে এই অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছি। ইতিমধ্যেই আসামের জনসংখ্যায় ভয়ানক পরিবর্তন এসেছে।’

তিনি জানান, ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, আসামের ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৩০ শতাংশই মুসলিম অভিবাসী। তিনি বলেন, আর কয়েক বছরের মধ্যেই সংখ্যালঘুর সংখ্যা ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে রয়টার্স তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

বিজেপির দীর্ঘদিনের অবস্থান হলো—ভারত হিন্দুদের প্রাকৃতিক আবাসভূমি। ২০১৯ সালে বিজেপি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করে, যাতে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। মুসলিমেরা এই আইনের বাইরে।

বিভিন্ন হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মার সরকার ৫০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করেছে, যাদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলিম। শুধু গত এক মাসেই পাঁচটি অভিযানে ৩ হাজার ৪০০ বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৪ হাজার ৭০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করেছিল আগের সরকার।

আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক প্রবীণ দোনথি বলেন, আইনি অবস্থান যেমনই হোক না কেন, বাংলাভাষী মুসলিমেরা এখন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ভারতের বিরোধী নেতারাও বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে নির্বাচনের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ তুলেছেন। আসামের বিধানসভার বিরোধীদলীয় সদস্য অখিল গগৈ বলেন, ‘এই উচ্ছেদ অভিযান বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক।’

আসামের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় ফিরলে গৃহহীন পরিবারগুলোর ঘর পুনর্নির্মাণ করবে এবং যারা ধ্বংস করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনবে।

গত এপ্রিলে ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার সেই ঘটনার জন্য পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের দায়ী করে ভারত। কিন্তু এর মূল টার্গেটে পরিণত হয় ভারতের বাংলাভাষী মুসলিমেরা। সেই হামলার ঘটনার পরপরই বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলো ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে আটকাতে শুরু করে।

বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার পতনের পর নয়াদিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে টানাপোড়েন ও বাংলাদেশে তথাকথিত ‘হিন্দু নির্যাতনের’ খবরকে পুঁজি করে বিজেপি ভারতের জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়েছে। আর এই বিষয়কে বিজেপি ভোটব্যাংকের ফায়দা লোটার জন্য ব্যবহার করছে।

আসামসহ বেশ কিছু রাজ্য সীমান্ত থেকে শত শত বাংলাভাষী মুসলিমকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করেছে। তবে যাদের ব্যাপারে আদালতে আপিল চলমান, তাদের আবার ফিরিয়ে আনতেও হয়েছে—বলে জানিয়েছে রয়টার্স। আসামের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্যের বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলো ৩০ হাজার মানুষকে ‘বিদেশি’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

এই মানুষগুলোর বেশির ভাগই আসামে বহুদিন ধরে বসবাস করছে। সেখানে তাদের পরিবার আছে, জমি আছে, কিন্তু তারা এতটাই দরিদ্র যে আইনি লড়াই চালাতে অক্ষম। আর এই সুযোগই তুলছে বিজেপি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে জানায়, ভারতে ২ কোটিরও বেশি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বসবাস করছে। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারত সরকার জানায়, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য তারা ২ হাজার ৩৬৯ জনের তালিকা পাঠিয়েছে এবং দ্রুত যাচাইপ্রক্রিয়া শেষ করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে এই বিষয়ে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য করেনি।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনার পর হিমন্ত বিশ্বশর্মা বারবার বলছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম অনুপ্রবেশ রুখে দিচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে আটক ব্যক্তিদের ছবি ও তথ্যও প্রকাশ করছেন।

তবে বিশ্লেষক প্রবীণ দোনথি বলেন, ‘আসামের জাতিগত জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে বিজেপির ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে কেবলই বাংলাভাষীরা নন, বরং বাঙালি মুসলিমেরা।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব করেন উপদেষ্টা— আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়রের অভিযোগ

চীনা যুদ্ধবিমান থেকে এলএস-৬ বোমা ফেলে কেন নিজ দেশে ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালাল পাকিস্তান

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

ভবদহের দুঃখ ঘোচাতে আসছে সেনাবাহিনী, খনন করবে ৫ নদ-নদীর ৮১.৫ কিমি

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত