Ajker Patrika

ইউক্রেন যুদ্ধ: মাটি ছাড়িয়ে মহাকাশেও 

আব্দুর রহমান
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২২, ১৩: ০৪
ইউক্রেন যুদ্ধ: মাটি ছাড়িয়ে মহাকাশেও 

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের দাবিকৃত ‘বিশেষ অভিযান’ শুরুর পর থেকে বেশ কিছু চমক দেখেছে বিশ্ব। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি, বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ—সবই দেখেছে। কিন্তু যুদ্ধের ২৫ দিন পরও যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং মাটির যুদ্ধ এবার মহাকাশে পৌঁছে গেছে। 

মহাকাশে এ যুদ্ধের বিস্তার কীভাবে হলো, সে আলোচনার আগে মাটিতেই এ যুদ্ধের বিস্তৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়া যাক। রাশিয়ার তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে—তারা ইউক্রেনের একটি সমরাস্ত্র গুদামসহ বেশ কিছু সামরিক স্থাপনায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘কিনঝাল’ ব্যবহার করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন নিউজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে রাশিয়ার নিক্ষেপিত ‘কিনঝাল’ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টি শনাক্ত করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বলয়ে থাকা বিশ্বের একাধিক দেশ রাশিয়া এবং দেশটির অলিগার্কদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করেছে। কিন্তু যুদ্ধ থামেনি বা থামার কোনো ইঙ্গিতও দেখা যায়নি। বরং বাড়ছে, ভূমি থেকে মহাকাশে। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) এক নিবন্ধ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে মাটি থেকে আকাশে পৌঁছে গেছে, তার একটি চিত্র দেখানো হয়েছে। ১৬ মার্চ প্রকাশিত ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) তৈরির পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যেভাবে সম্মিলিত নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে, তা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যকার সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চিহ্ন হিসেবে প্রশংসিত হয়ে এসেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে মহাকাশ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা দেশগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে। 

 

বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত ‘Russia’s invasion of Ukraine is redrawing the geopolitics of space’—শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন কেবল পৃথিবীর ভূ-রাজনীতিই, নয় মহাকাশের রাজনীতিকেও নতুনভাবে ম্যাপিং করছে। বিশ্বের স্পেস এজেন্সিগুলো এবং গবেষকেরা যুদ্ধের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। 

রাশিয়ার একটি রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে উড্ডয়নের প্রাক্কালে সয়ুজ রকেট।

পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বর্তমানে রাশিয়ার দুজন, যুক্তরাষ্ট্রে চারজন ও ইউরোপের একজন মহাকাশচারী রয়েছেন। তাঁদের থাকাটা বড় কোনো বিষয় নয়। যে বিষয়টি উদ্বেগের, তা হলো—রাশিয়ার ওপর ক্রমবর্ধমান নিষেধাজ্ঞা-অবরোধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া আইএসএস থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ইঙ্গিত স্পষ্ট না হলেও একটি বার্তা যে তাতে রয়েছে, তা স্পষ্ট। 

রাশিয়ার মহাকাশ কর্মসূচির বিরুদ্ধেও বাইডেন প্রশাসন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমসের (ROSCOSMOS) পরিচালক দিমিত্রি রোগোজিন টুইটারে যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘আপনি কি আইএসএসে আমাদের সহযোগিতা ধ্বংস করতে চান?’ যুক্তরাষ্ট্র কি চায়, তা আপাতত স্পষ্ট না হলেও রাশিয়া যে বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে মোটেও খুশি নয়, তা স্পষ্ট। 

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং রসকসমস যৌথভাবে কাজ করে থাকে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্থাপিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রায়ই তার কক্ষপথ থেকে নিচে নেমে আসে। সেটিকে আবারও কক্ষপথে ফেরাতে রাশিয়ার সয়ুজ রকেট ব্যবহার করা হয়। এই বিষয়টি সামনে রেখে রোগোজিন প্রশ্ন করেছেন—আইএসএস যদি নামতে নামতে, অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত ডি-অরবিটিংয়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে পতিত হয়, তবে তা থেকে রক্ষা করবে কে? উত্তর বাইডেনের জন্যই রেখে দিয়ে রোগোজিন বলেছেন, ‘সব ঝুঁকি আপনার। (এই ঝুঁকি) আপনি গ্রহণ করতে প্রস্তুত?’ 

রোগোজিনের প্রশ্ন থেকে এটি স্পষ্ট যে—নাসা একা সয়ুজ ক্যাপসুল ছাড়া আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে তার নির্ধারিত অরবিটে ফেরত নিতে সক্ষম হবে না। তবে এখানেও একটি আশার আলো আছে। স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলোন মাস্ক রোগোজিনের মন্তব্যের জবাবে বলেছিলেন, স্পেসএক্সের ড্রাগন মহাকাশযান এই সেবা দিতে সক্ষম। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মাস্ক এই ঘোষণা দিলেও বিষয়টি আসলে খুব সহজেই মিটে যাচ্ছে না। 

ঘটনা কেবল মহাকাশ স্টেশন নিয়েই থেমে থাকেনি। গড়িয়েছে রকেট ইঞ্জিনের সরবরাহ অবধি। অতি সম্প্রতি, রোগোজিন ঘোষণা করেছেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের বিশ্বসেরা রকেট ইঞ্জিন সরবরাহ করব না। তাঁদের অন্য কিছু নিয়ে উড়তে দিন—তাঁদের ঝাঁড়ুর কাঠি, না কী আছে, তা অবশ্য আমি জানি না।’ 

তবে আশার কথা হলো—নকশা অনুসারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ১৪টি অন্যান্য দেশ যৌথভাবে কাজ করছে। স্টেশনের একটি অংশ রাশিয়া নির্মিত এবং দেশটির মহাকাশচারীদের দ্বারা পরিচালিত। অন্য অংশটি মার্কিন, ইউরোপীয়, জাপানি ও কানাডার মহাকাশ সংস্থাগুলো কর্তৃক নির্মিত ও পরিচালিত। স্টেশনের মৌলিক পরিষেবার জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে স্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশগুলো এবং রাশিয়া মহাকাশ স্টেশনকে তার কক্ষপথে থাকতে প্রয়োজনীয় শক্তি এবং কার্যক্রম সম্পন্ন করে। 

নেচারে প্রকাশিত নিবন্ধ নাসাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে—মহাকাশ স্টেশনটি যথারীতি কাজ করছে। সেখানে থাকা মহাকাশচারীরা কেউই ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কেপ কেনেডি উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে নাসার একটি রকেট। কেবল তাই নয়, ২০২১ সালের নভেম্বরে রাশিয়া অ্যান্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালালে প্রতিক্রিয়া পশ্চিমা দেশগুলো জাতিসংঘে মহাকাশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা বিষয়ে একটি সংলাপ আয়োজনের বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করে। তবে সেই সংলাপ আয়োজনের পথ এক প্রকার রুদ্ধই বলা যায়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া—উভয়ই দেশই উভয় দেশের প্রেসিডেন্ট-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ফলে আশা দুরাশায় পরিণত হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। 

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা দপ্তর প্রকাশিত ২০২২ সালের বার্ষিক ‘হুমকি মূল্যায়নে’ সতর্ক করে বলা হয়—চীন ও রাশিয়া ‘ক্রমবর্ধমানহারে আগামী দিনের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে মহাকাশকেই’ বিবেচনা করছে। তাই, বহুপক্ষীয় মহাকাশ ফোরাম যেমন ‘উন্মুক্ত কর্মপরিকল্পনা দল বা ওইডব্লিউজি পক্ষগুলোর মধ্যকার ভুল ধারণা ও সংঘাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওইডব্লিউজি-এর প্রথম বৈঠকটি চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের একাধিক আপত্তি ও ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান সংকটের কারণে বৈঠকটি মে মাসে আয়োজনের কথা বলা হয়। 

যা হোক, সামগ্রিকভাবে রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের কার্যক্রম এবং বক্তব্য ১৯৬৭ সালের মহাকাশ চুক্তির অধীনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের বিষয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। তৈরি করছে মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা। এ অবস্থায় রাশিয়ার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ত্যাগ, যুক্তরাষ্ট্রকে রকেট ইঞ্জিন না দেওয়ার যে সতর্কবার্তা, তা কোনোভাবেই কোনো হাসির বিষয় নয়।

 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা ছাত্রদল কর্মী ইপ্সিতার, ধর্ষণের অভিযোগ আসে ৯৯৯ থেকে

ইরানের হামলার তীব্র নিন্দা কাতারের, পাল্টা জবাবের হুঁশিয়ারি

মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশে পরবর্তী ঘোষণার আগপর্যন্ত বাংলাদেশি সব ফ্লাইট বাতিল

নূরুল হুদাকে হেনস্তা: বিচারের দাবিতে ৩৪ বীর মুক্তিযোদ্ধার বিবৃতি

মার্কিন ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হামলার আগে কাতারকে জানায় ইরান: সিএনএন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত