Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /ডিসেম্বরের মধ্যেই ফের যুদ্ধে জড়াতে পারে ইরান-ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ৫২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েল সম্ভবত চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগেই ইরানের সঙ্গে নতুন যুদ্ধ শুরু করবে। এমনও হতে পারে, হয়তো চলতি আগস্টের শেষেই এই যুদ্ধ শুরু করতে পারে তেল আবিব। ইরানও এমন আক্রমণের আশঙ্কা থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথম যুদ্ধে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে ধরে নিয়ে ইরান দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়েছিল, ধীরে ধীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। তবে এবার ইরান শুরু থেকেই শক্তিশালী ও নির্ণায়ক আঘাত হানতে পারে। তেহরানের লক্ষ্য থাকবে ‘ইসরায়েলের সামরিক আধিপত্য’ দমন করা অসম্ভব—এমন ধারণা ভেঙে ফেলা।

ফলে আসন্ন যুদ্ধ আগের যুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী-প্রাণঘাতী হওয়ার হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আবার ইসরায়েলের চাপে নতি স্বীকার করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে এমন এক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, যার তুলনায় ওয়াশিংটনের কাছে ইরাক যুদ্ধও সহজ বলে মনে হবে।

ইসরায়েলের জুন মাসের যুদ্ধ আসলে কখনোই শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ছিল না। এর মূল লক্ষ্য ছিল—মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দেওয়া। ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা কখনোই চূড়ান্ত বিষয় ছিল না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে চাপ দিয়ে আসছে, যাতে ইরান দুর্বল হয় এবং এমন এক আঞ্চলিক ভারসাম্য তৈরি হয়, যেখানে ইসরায়েলের প্রাধান্য থাকবে। কিন্তু এটি ইসরায়েল একা অর্জন করতে পারবে না।

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের হামলার তিনটি বড় লক্ষ্য ছিল—কেবল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা দুর্বল করা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকেও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা, ইরানের শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং দেশটিকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো দুর্বল করে ফেলা, যেখানে ইসরায়েল নির্বিঘ্নে বোমা হামলা চালাতে পারবে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ছাড়াই। তবে এ তিনটির মধ্যে কেবল একটি লক্ষ্য আংশিক সফল হয়। ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘ধ্বংস’ করতে পারেননি, কিংবা সেটিকে এমন জায়গায় পাঠাতে পারেননি, যেখানে বিষয়টিকে সমাধান হয়ে গেছে বলা যায়।

অন্যভাবে বললে, জুনের হামলায় ইসরায়েল সর্বোচ্চ ‘আংশিক সাফল্য’ পেয়েছে। ইসরায়েলের কাঙ্ক্ষিত ফল ছিল, ট্রাম্প যেন পূর্ণমাত্রায় জড়িয়ে পড়েন, ইরানের প্রচলিত বাহিনী এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু বানান। কিন্তু ট্রাম্প দ্রুত ও নির্ণায়ক সামরিক পদক্ষেপের পক্ষপাতী হলেও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে যেতে ভয় পান। তাই তাঁর কৌশল ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সীমিত হামলা চালানো, যাতে সংঘাত উসকে না উঠে। স্বল্পমেয়াদে ট্রাম্প এতে সফল হয়েছিলেন—তবে এটি ইসরায়েলের বিরক্তির কারণ হয়েছিল—কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তিনি ইসরায়েলের তৈরি করা এক উত্তেজনাপূর্ণ চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন।

ট্রাম্পের সীমিত বোমাবর্ষণ অভিযানের বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার বড় কারণ। যুদ্ধ চলতে থাকায় ইসরায়েল গুরুতর ক্ষতির মুখে পড়ে, দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইরান ক্রমশ দক্ষতার সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তা ভেদ করে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি যুদ্ধে অংশ নিলে ইসরায়েল লড়াই চালিয়ে যেত, কিন্তু যখন স্পষ্ট হলো ট্রাম্পের হামলা কেবল এককালীন, তখন পরিস্থিতি বদলে যায়। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টানতে সফল হয়েছিল, তবে ধরে রাখতে পারেনি।

ইসরায়েলের বাকি দুইটি লক্ষ্য স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। গোয়েন্দা অভিযানে শুরুর দিকে কিছু সাফল্য মিলেছিল। যেমন, ইসরায়েল ইরানের ৩০ জ্যেষ্ঠ কমান্ডার এবং ১৯ পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করতে পেরেছিল। কিন্তু এসব কেবল অস্থায়ীভাবে ইরানের কমান্ড ও কন্ট্রোল ব্যবস্থাকে ব্যাহত করেছিল। মাত্র ১৮ ঘণ্টার মধ্যেই ইরান বেশির ভাগ কমান্ডারকেই প্রতিস্থাপন করে এবং ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে প্রমাণিত হয়, বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ইরান শক্তিশালী আঘাত হানার মতো সক্ষমতা ধরে রেখেছে।

ইসরায়েল আশা করেছিল, প্রথম দিকের হামলায় ইরানের শাসকগোষ্ঠীর ভেতর ভীতি ছড়িয়ে পড়বে এবং তাতে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হবে। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ফারসি ভাষায় দক্ষ মোসাদের এজেন্টরা ইরানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মোবাইলে হুমকি দিয়েছিল। মোসাদ এজেন্টেরা হুমকি দিয়েছিল যে, তাদের ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হবে, যদি না তারা ভিডিও করে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের শুরুর সময়, এমন ২০ টিরও বেশি ফোন কল করা হয়েছিল। কিন্তু এর প্রমাণ নেই যে, একজন ইরানি জেনারেলও এই হুমকিতে নতি স্বীকার করেছিলেন। বরং শাসকগোষ্ঠীর সংহতি অটুট ছিল।

ইসরায়েলের প্রত্যাশার বিপরীতে, ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস বা বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের হত্যার পরও দেশটিতে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো গণবিক্ষোভ বা বিদ্রোহ দেখা যায়নি। উল্টো, রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে ইরানিরা দেশকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়। জাতীয়তাবাদের ঢেউ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েল ইরান সরকারের তথাকথিত অ-জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে পারেনি। প্রায় দুই বছর ধরে গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং পারমাণবিক আলোচনার সময় ইরানের ওপর প্রতারণামূলক হামলা করার পর কেবলমাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ—মূলত প্রবাসী ইরানিরাই—ইসরায়েলের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।

বরং ইরানি জনগণকে শাসকগোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড় করানোর পরিবর্তে ইসরায়েল ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বয়ানকে নতুন জীবন দিয়েছে। আগে ইরানিদের একাংশ অভিযোগ করত, সরকারের বিনিয়োগ পরমাণু কর্মসূচি, ক্ষেপণাস্ত্র ও মিত্র অ-রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী গুলোতে কেন করা হচ্ছে। এখন অনেকে ক্ষুব্ধ যে, এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না।

তেহরানের এক শিল্পী জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নারগেস বাজোগলিকে বলেন, ‘আগে আমি বিক্ষোভে অংশ নিয়ে স্লোগান দিতাম—ইরানের অর্থ লেবানন বা ফিলিস্তিনে পাঠিও না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমাদের যে বোমার মুখোমুখি হতে হয়, তা আসলে একটাই। আর যদি আমাদের পুরো অঞ্চলে শক্ত প্রতিরক্ষা না থাকে, তবে যুদ্ধ আমাদের ঘরে চলে আসবে।’

এই পরিবর্তিত মনোভাব কত দিন স্থায়ী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আপাতত ইসরায়েলের হামলা উল্টো ইরানের শাসনব্যবস্থাকেই শক্তিশালী করেছে—অভ্যন্তরীণ সংহতি জোরদার করেছে এবং রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে। ইসরায়েল ইরানকে সিরিয়ার মতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতেও ব্যর্থ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া টেকসই আকাশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। যুদ্ধ চলাকালীন ইসরায়েল ইরানের আকাশসীমার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করলেও তা ছিল না নির্বিঘ্ন। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবং তা ইসরায়েলের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল হয়তো যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হতো না। যেমন, শুধু ১২ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে যেসব থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছিল তার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করে ফেলেছে তেল আবিব। বাকি যা আছে, তার জোরে নতুন করে ইসরায়েলের ইরানে হামলা শুরুর সম্ভাবনা জোরদার হয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এবং সেনাপ্রধান ইয়াল জামির এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন। জামির বলেছেন, জুনের যুদ্ধ ছিল প্রথম ধাপ, আর এখন ইসরায়েল ‘সংঘাতের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।’

ইরান পুনরায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করুক বা না করুক, ইসরায়েল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে—তারা ইরানকে ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার পুনরায় গড়ে তোলা, আকাশ প্রতিরক্ষা পুনর্গঠন বা উন্নত ব্যবস্থা মোতায়েনের সময় দেবে না। এই যুক্তিই ইসরায়েলের তথাকথিত ‘ঘাস কাটা’ কৌশলের মূল। এই কৌশলে প্রতিপক্ষকে বারবার ও আগেভাগেই আঘাত করা হয়, যাতে তারা এমন সামরিক সক্ষমতা তৈরি করতে না পারে যা ইসরায়েলের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।

অর্থাৎ, ইরান যখন নতুন করে সামরিক সম্পদ গড়ে তুলছে, তখন সেটিই হয়ে উঠছে ইসরায়েলের কাছে দ্রুত হামলা চালানোর অজুহাত। এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যবর্তী নির্বাচনী মৌসুমে প্রবেশ করবে, তখন আরেকটি আক্রমণ দেশটির রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকেও আরও জটিল করে তুলবে। তাই আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে এই ধরনের ফলাফল যাতে ইসরায়েল অর্জন করতে না পারে, তা ইরানি নেতারা ঠেকাতে চাইছেন। ইসরায়েলের ‘ঘাস কাটা’ কৌশল কার্যকর—এমন কোনো ধারণা ভাঙতে ইরান সম্ভবত পরবর্তী যুদ্ধে শুরুতেই ইসরায়েলে প্রচণ্ড ও দ্রুত আঘাত হানবে। এক্সে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি লিখেছেন, ‘আবার আগ্রাসন হলে আমরা আরও দৃঢ় প্রতিক্রিয়া জানাতে দ্বিধা করব না, আর তা আড়াল করা হবে অসম্ভব।’ ইরানি নেতাদের বিশ্বাস, ইসরায়েলের জন্য পরবর্তী যুদ্ধের ব্যয় এতটাই ভয়াবহ হতে হবে যে ধীরে ধীরে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ক্ষয়ে যাবে এবং পুরো দেশ অরক্ষিত হয়ে পড়বে।

জুনের যুদ্ধ নিষ্পত্তিহীনভাবে শেষ হলেও, পরবর্তী যুদ্ধের ফল নির্ভর করবে কোন পক্ষ বেশি শিখেছে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে তার ওপর। ইসরায়েল কি ইরানের তুলনায় দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজুত করতে পারবে? মোসাদ কি এখনো ইরানের ভেতরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে, নাকি প্রথম দফার যুদ্ধে শাসন পরিবর্তনের চেষ্টায় তাদের বেশির ভাগ এসেটস ব্যয় হয়ে গেছে? ইরান কি ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ভেদ করার ক্ষেত্রে বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে, নাকি ইসরায়েল তাদের দুর্বলতা পূরণে বেশি সফল হয়েছে? আপাতত, কোনো পক্ষই এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবে দিতে পারছে না।

এ কারণেই ইরান নিশ্চিত হতে পারছে না যে, আরও শক্ত প্রতিক্রিয়া জানালেই ইসরায়েলের কৌশল ব্যর্থ হবে। তাই দেশটি তার পারমাণবিক অবস্থান নতুন করে বিবেচনা করতে পারে—বিশেষ করে যখন তাদের তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষ এবং পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে অস্পষ্টতাসহ অন্য উপায়গুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়াতে তিনি অনিচ্ছুক বলেই মনে হয়। রাজনৈতিকভাবে, তাঁর প্রাথমিক হামলাই তাঁর মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইনে গৃহযুদ্ধ ডেকে এনেছিল। সামরিকভাবে, মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র মজুতে ভয়াবহ ঘাটতি ধরা পড়েছে। ট্রাম্প এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উভয়েই এমন এক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য অংশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবহার করেছেন, যেটিকে কোনো পক্ষই যুক্তরাষ্ট্রের মূল স্বার্থের জন্য অপরিহার্য মনে করে না।

কিন্তু প্রথম আঘাতের অনুমোদন দিয়ে ট্রাম্প আসলে ইসরায়েলের পাতা ফাঁদেই পা দিয়েছেন—এবং এখন তিনি সেখান থেকে বের হতে পারবেন কি না তা স্পষ্ট নয়। বিশেষত, যদি তিনি ইরানের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে শূন্য সমৃদ্ধকরণকেই শর্ত মানতে থাকেন। সীমিত সম্পৃক্ততা এখন আর সম্ভব নয়। ট্রাম্পকে হয় পুরোপুরি যুদ্ধে নামতে হবে, নয়তো সম্পূর্ণ সরে দাঁড়াতে হবে। আর সরে দাঁড়ানো মানে শুধু একবার অস্বীকার করা নয়—বরং ইসরায়েলের চাপের মুখেও ধারাবাহিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এখন পর্যন্ত তিনি সে ধরনের ইচ্ছাশক্তি বা দৃঢ়তা কোনোটি-ই দেখাননি।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকা'র সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শশী থারুরের নিবন্ধ

অস্তিত্বসংকটে জাতিসংঘ: আঞ্চলিক জোটের কাছে কি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
অস্তিত্বসংকটে জাতিসংঘ: আঞ্চলিক জোটের কাছে কি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।

লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।

যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’

বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।

জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’

তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।

কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।

তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।

চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।

ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।

অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।

আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।

এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।

জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।

বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /প্রতিবেশীদের ছাড়াই পরাশক্তি হওয়ার উচ্চাভিলাষ ভারতের, পারবে কি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ০৩
ভারত পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখলেও নিজ অঞ্চলেই এখন দেশটির প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু। ছবি: সংগৃহীত
ভারত পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখলেও নিজ অঞ্চলেই এখন দেশটির প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একধরনের অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। জেনারেশন-জেড বা জেন-জি বিক্ষোভে গত সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এটি অনেকটা গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর মতো। সে সময় শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। আবার ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া বা সংগ্রাম’ আন্দোলনও একই ধারায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদত্যাগে বাধ্য করে।

এ ধরনের একের পর এক গণ-আন্দোলন ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও জনসংখ্যাগত চাপের মতো মৌলিক সংকটে ভুগছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া। নেপালের কথাই ধরা যাক—রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর ২০০৮ থেকে গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছিল ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামে। নেপালের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশির বয়স ১৫ বছরের নিচে, দেশের জনগণের গড় বয়স মাত্র ২৫ বছর, আর প্রতি পাঁচজন তরুণের একজন বেকার।

এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের চারপাশে যেন এক অস্থিরতার বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তায় চলছে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমার কার্যত ব্যর্থ বা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর চীন ও পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশীই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িত, তাদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ এবং দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় পরস্পরের সঙ্গে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ সালে।

গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এসেছে বেশি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের মতো শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। কিন্তু ভারতের মধ্যে এই আলোচনায় নিকট প্রতিবেশীরা যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

এটার একটা কারণ, নয়াদিল্লির নিজস্ব প্রবণতা—বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পুরো অঞ্চলকে আলাদা নজরে দেখা। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে সব দক্ষিণ এশীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং প্রথম দফায় তিনি ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সরকার ভারতকে আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।

এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে চলতি বছরের ‘রাইসিনা ডায়ালগে’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রধান কূটনৈতিক সম্মেলনে ইউক্রেন ও গাজা সংঘাত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মহাকাশে আধিপত্য—সব বিষয়ই সেখানে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ, মাত্র ছয় মাস আগে বাংলাদেশের মনসুন রেভল্যুশনে ক্ষমতাচ্যুত হয় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকারগুলোর একটি।

রাইসিনা ডায়ালগের ঠিক এক মাস পর চলতি বছরের এপ্রিলে কাশ্মীরে প্রাণঘাতী হামলা হয়। এ হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় পর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ডায়ালগে ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ভারতীয় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করলেও আফগানিস্তান বা মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এটিই ইঙ্গিত দেয় যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি একধরনের ‘উদাসীনতা’ ধীরে ধীরে নীতি-কৌশলে পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার ভারতীয় সংসদ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার আলোচনায় এক সদস্য বলেন, ভারত তার প্রতিবেশীকে ভৌগোলিক দূরত্বে নয়, বরং ‘পারস্পরিক স্বার্থ’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। যদিও সত্য এই যে কোয়াড বা ব্রিকসের মতো ‘সমভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর’ জোট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গতি পেয়েছে, কিন্তু এসব উদ্যোগ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্ততার বিকল্প হতে পারে না।

ভারতের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সংকটের দায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনকে দেন। পাকিস্তান সার্কের সদস্যদেশ—এটি হয়তো সার্কের অচলাবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এতে ব্যাখ্যা মেলে না, কেন অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনও প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন ‘বিমসটেক’-এর কথা। পাকিস্তান এর সদস্য নয়, তবু ১৯৯৭ সালে গঠনের পর থেকে সংগঠনটি মাত্র ছয়বার শীর্ষ সম্মেলন করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতার সঙ্গে আঞ্চলিক ঘটনাবলিকে নয়াদিল্লির গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা—গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় এমন বিশ্লেষণ প্রায় অনুপস্থিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাইরের নিরাপত্তা হুমকি আসে তাদের সীমান্ত বা আশপাশের অঞ্চল থেকেই; যেমন ইউরোপের জন্য রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এক অস্তিত্বের হুমকি বা স্নায়ুযুদ্ধকালে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হুমকি এসেছিল নিজের ‘পেছনের উঠান’ থেকেই। আবার অনুপ্রবেশের মতো বিষয়ও বহু দেশের রাজনীতিতে তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যদি নিজেকে কেবল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে—তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে না।

এই ‘উদাসীনতা’ ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেও স্পষ্ট। সম্প্রতি লাদাখ (যা চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বিতর্কিত অঞ্চল) ও মণিপুরে অস্থিরতার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। মণিপুর রাজ্যটি মিয়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত। দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্র সরকার ধীর প্রতিক্রিয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মণিপুরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার দুই বছরের বেশি সময় পর নরেন্দ্র মোদি সেখানে সফরে যান।

নয়াদিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। পূর্বমুখী নীতি বা ‘লুক ইস্ট’ নীতি মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নামে নতুনভাবে প্রচারে আনে, যা আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশে ভারতের প্রতি কম সহানুভূতিশীল সরকার ক্ষমতায় থাকায় ওই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে।

ভারতের পশ্চিমমুখী নীতিও (যা নয়াদিল্লি ‘ওয়েস্ট এশিয়া’ বলে উল্লেখ করে) জটিল। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক ও আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতা এতে বাধা সৃষ্টি করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

ভারত এই অঞ্চলের (পাকিস্তানের পর পশ্চিম দিকে) সঙ্গে যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে নানা বাধা কাটিয়ে উঠেছে। আকাশপথ, নৌপথ এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়াতে দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে ইরানে নয়াদিল্লি পরিচালিত চাবাহার বন্দর এবং ২০২৩ সালে জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে। পাশাপাশি কাবুলের তালেবান সরকারের সঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের সম্পৃক্ততা এখনো নড়বড়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঘোষিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বিবেচনায় নিলে সেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, চীন বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আগে আঞ্চলিকভাবে নিজেদের অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একীভূত করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও আন্তর্দেশীয় উৎপাদন নেটওয়ার্কে নিজেদের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতকেও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে, যদি দেশটি বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্র হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।

পশ্চিমা দেশগুলোও অনেক সময় ভারতকে একা একটি দেশ হিসেবে দেখে—দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নয়। এর পেছনে আংশিক কারণ প্রশাসনিক জটিলতা; যেমন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান ডিরেক্টরেট’ আলাদা বিভাগ, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ে কাজ করে আরেকটি বিভাগ— ‘আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান ডিরেক্টরেট।’

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরে (ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স) ভারত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’-এর অধীনে, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’-এর অধীনে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গরকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নয়াদিল্লিতে নিয়োগ দেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদিও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই নিয়োগ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে এবং ভারতকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি হিসেবেই দেখবে।

সর্বোপরি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতনীতি আরও নিবিড়ভাবে দক্ষিণ এশিয়া নীতির সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারতকে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পশ্চিমা দেশগুলোও এই অঞ্চলের অভিন্ন সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে এগোতে পারবে।

এই সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার চাপ—দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স এখনো ১৮ বছরের নিচে। রয়েছে জলবায়ু ঝুঁকি—এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপর্যয়-সংবেদনশীল এলাকার একটি। আছে অভিবাসন সংকটও—অনেক পশ্চিমা দেশে অবৈধ অভিবাসীর বড় অংশ দক্ষিণ এশীয়।

এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোরও ভাবতে হবে—কীভাবে তারা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে সাজাবে। কারণ, এখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার ও গোষ্ঠীকে সরিয়ে জনগণের শক্তিতে নতুন প্রজন্মের নেতারা উঠে আসছেন।

এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে পরাজিত হয়েছেন পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারের প্রার্থীরা। বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী জোটের নেতা অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে, যার দল জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা একসময় দেশজুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফল শ্রীলঙ্কার অস্থির রাজনীতিকে যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি দেশের মূলধারার রাজনীতির প্রতি জনগণের গভীর হতাশাও স্পষ্ট করেছে।

বাংলাদেশ ও নেপালে একই ধরনের কিছু রাজনৈতিক প্রবণতা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। দুই দেশই বর্তমানে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আছে। বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। ছাত্র ও যুবা নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে—বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং নেপালের হামি নেপাল-এর মতো সংগঠনগুলো এখন প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

এই প্রবণতা দুই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির প্রভাবকে দুর্বল করার সম্ভাবনা তৈরি করছে। ‘ব্যাটলিং বেগমস’-এর যুগে বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হতো এবং নেপালের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলে (নেপালি কংগ্রেস ও দুটি কমিউনিস্ট পার্টি) ছিল পুরুষ নেতাদের আধিপত্য।

এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রায়ই চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য উভয় রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে, পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতাও রক্ষা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে—দেশটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎস এবং দেশগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

অন্যদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক বজায় রাখে। যেখানে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা প্রায়ই নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দেওয়ার প্রতিযোগিতা করেন। এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে, যেখানে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রচারে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

তবে বাস্তবতা হলো, প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নয়াদিল্লির কার্যক্রম; যেমন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে সাম্প্রতিক আর্থিক সংকটের সময় অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া—ভারতকে ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।

যা হোক, এখন এমন এক সময় যখন বৈশ্বিক নীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে—ঠিক তখনই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো নতুন করে গতি পাচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার তাগিদ আরও বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই নিবন্ধের লেখক এই প্রস্তাব ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে তুলে ধরেন। সে সময় জয়শঙ্কর উদাহরণ দেন ভারত কীভাবে আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে—অবকাঠামোগত প্রকল্প, আর্থিক সহায়তা, টিকা বিতরণ এবং খাদ্যশস্য সরবরাহের মাধ্যমে। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেননি যে কেন ভারতের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আঞ্চলিক সংহতি ও আস্থা এখনো দুর্বল।

এটি পশ্চিমাদের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিবাসন, জলবায়ু ও চীনের বৈশ্বিক ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যা হোক, এই অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করতে না পারলেও সমমনা দেশগুলো তাদের শক্তি ও সংযুক্তি সক্ষমতা ব্যবহার করে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সহজতর করতে পারে; যেমন জলবায়ু সহনশীলতা, অভিবাসন এবং শারীরিক ও ডিজিটাল সংযোগের উন্নতি।

তবে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না। কারণ, বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা কমছে, বৈদেশিক নীতি এখন ‘অগ্রাধিকার’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে এবং আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল। তাই এই অঞ্চলে যা ঘটে, তার প্রভাব গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিবিসির নিবন্ধ /ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি: প্রলোভনে কাজ হয়নি, এবার ‘চাবুক’ তুলে নিলেন ট্রাম্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৪৬
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপকূলে সাবমেরিন পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আরও একটি স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ছবি: দ্য আটলান্টিকের সৌজন্যে
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপকূলে সাবমেরিন পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আরও একটি স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ছবি: দ্য আটলান্টিকের সৌজন্যে

ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় পুতিন সাক্ষাৎ করেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে। ফলাফল আলাস্কায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণা।

এ যেন একধরনের ‘দেজাভ্যু’। তবে এবার মনে হচ্ছে পুনরাবৃত্তির দিন শেষ। কারণ, ন্যূনতম প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত আলাস্কার বৈঠকটি ছিল ফলশূন্য। অন্যদিকে বুদাপেস্ট সম্মেলন বাতিল। বলা ভালো, এটি কার্যত ‘চালু’ হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাম্প নিজেই তা বাতিল করেছেন।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের যেখানে পৌঁছানোর কথা, সেখানে পৌঁছাতে পারব বলে আমার মনে হচ্ছিল না।’ তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এর আগে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর হুমকি দিয়েও ট্রাম্প কখনো তা বাস্তবায়ন করেননি। বরং তিনি কূটনীতিতে ‘গাজর’ তথা প্রলুব্ধ করার কৌশল ব্যবহার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

তবে এবার তিনি সেই গাজর সরিয়ে রেখেছেন। রাশিয়ার দুই বড় তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এই পদক্ষেপ পুতিনকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে না। তবে এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্প ক্রেমলিনের অনমনীয় অবস্থানে ক্ষুব্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধ সমাধানের জন্য রাশিয়া কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।

কিন্তু আবার রুশরা ‘লাঠির রাজনীতি’ও পছন্দ করে না। বৃহস্পতিবার পুতিন সাংবাদিকদের বললেন, নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একটি ‘অবন্ধুত্বসুলভ পদক্ষেপ’ এবং রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা। তিনি বলেন, ‘কোনো আত্মসম্মান বোধবিশিষ্ট দেশ বা জনগণ কখনো চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় না।’

তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের ভাষা ছিল আরও কড়া। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রু, আর তাদের বাচাল শান্তির দূত (ট্রাম্প) এখন পুরোপুরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পথে নেমেছে। এই সিদ্ধান্তগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই সমান।’

তাহলে কী বদলেছে? প্রথম সম্মেলনের সময় যেমন হঠাৎ করে আলাস্কায় উড়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প, এবার তিনি কিছুটা সতর্ক ছিলেন। বুদাপেস্ট বৈঠকের আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে নির্দেশ দেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করতে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় এই শীর্ষ বৈঠকে সত্যিই কোনো সুফল আসবে কি না।

শিগগির স্পষ্ট হয়, কোনো ফল আসবে না। তাই বুদাপেস্টে নতুন বৈঠকের পরিকল্পনা বাতিল হয়। রাশিয়া ট্রাম্পের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি বা বর্তমান ফ্রন্টলাইন বা যুদ্ধ রেখা ‘ফ্রিজ বা স্থগিত’ করার ভাবনায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। ক্রেমলিন পুরো দোনবাস অঞ্চল দখলে নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে তারা এর বড় অংশ দখল করেছে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অটল—ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা দনবাসের অংশে রাশিয়াকে ছাড় দেবেন না। মস্কো অবশ্য দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্মেলনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল। আলাস্কার প্রথম বৈঠকটি ক্রেমলিনের জন্য ছিল এক বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। অ্যাঙ্কোরেজে পুতিনকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা রাশিয়ার আন্তর্জাতিক মঞ্চে পুনরাবির্ভাবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এবং রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।

গত এক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বুদাপেস্টে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনায় উচ্ছ্বসিত ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে টেবিলের বাইরে রেখে ইউরোপে এই বৈঠককে তারা ব্রাসেলসের মুখে চপেটাঘাত হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। তবে বেশির ভাগ রাশিয়ান বিশ্লেষক বিশ্বাস করছিলেন না যে বুদাপেস্ট সম্মেলন বাস্তবায়িত হলেও রাশিয়া কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে।

রাশিয়ার কিছু পত্রিকা সরাসরি বলেছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছে, ‘মস্কোর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার মতো একটি কারণও নেই।’ তবে এর মানে এই নয় যে ক্রেমলিন শান্তি চায় না। চায়, কিন্তু তাদের নিজস্ব শর্তে। আর সেই শর্তগুলো এখন কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের কাছে অগ্রহণযোগ্য।

রাশিয়ার দাবিগুলো কেবল ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা দাবি করছে যুদ্ধের ‘মূল কারণগুলো’ সমাধান করতে হবে। এসব শব্দগুচ্ছের আড়ালে রাশিয়া কার্যত ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আরও গভীরভাবে ভাবলে বলা যায়, মস্কো এখনো ইউক্রেনকে নিজের প্রভাববলয়ে টেনে আনার লক্ষ্য ত্যাগ করেনি। তাহলে, ট্রাম্প কি রাশিয়ার ওপর আরও চাপ বাড়াতে প্রস্তুত? সম্ভবত। তবে আবারও সেই পুরোনো ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখতে হতে পারে।

বুদাপেস্ট সম্মেলন ঘোষণা হওয়ার পর মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছিল, ‘ট্রাম্পের রশি টানাটানির খেলায় এখন আবার রাশিয়াই এগিয়ে। বৈঠকের আগের কয়েক সপ্তাহে ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোর ফোনকল ও সফরের মাধ্যমে ট্রাম্প কিছুটা রাশি নিজের দিকে টেনে নেবেন, তারপর পুতিন আবার তাকে নিজের দিকে টেনে নেবেন।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইইউ-ট্রাম্পের নতুন নিষেধাজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করছেন পুতিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সিএনএন
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সিএনএন

এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ।

এর পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার বিরুদ্ধে ১৯তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। যেখানে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এলএনজি রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস বলে বিবেচিত।

তবে রুশ বিশ্লেষকদের মতে, এ পদক্ষেপ পুতিনের যুদ্ধনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনবে না। রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলছেন, রুশ কোম্পানিগুলো অনেক আগেই এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাঁর ভাষায়, পুতিন যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরনের ক্ষতিও মেনে নিতে প্রস্তুত, আর ট্রাম্পের অবস্থানও সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে পারে।

রুশ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্তানোভায়া বলেন, রাশিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, ঠিক আছে, তিন মাস পর ট্রাম্প নিজেই নরম হয়ে যাবে। আর পুতিনের কাছে এই যুদ্ধ অস্তিত্বের প্রশ্ন, তাই তিনি সহ্য করেই যাবেন।

গতকাল বুধবার তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, যা নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত। তবে এর কার্যকারিতা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর। নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুক অয়েল এবং সারা বিশ্বে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করা যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর আরোপ করেছে।

রাশিয়ার মোট বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে। তবে ইউক্রেনের উন্নত ড্রোন ও দীর্ঘপাল্লার হামলায় তেল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্প খাত এরই মধ্যে চাপে রয়েছে। তবুও রুশ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিতই থাকবে।

তাঁরা উল্লেখ করেন, রাশিয়া এরই মধ্যে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে। দেশটি শত শত পুরোনো জাহাজ ব্যবহার করে, যেগুলোর কোনো পশ্চিমা বিমা নেই এবং তৃতীয় দেশের ছদ্ম কোম্পানির মাধ্যমে লেনদেন চালায়। তা ছাড়া বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারের প্রায় ৯ শতাংশ রাশিয়ার। ফলে রুশ তেল বিশ্ববাজারে রপ্তানি না হলে সরবরাহও কমবে এবং দাম বাড়বে। এতে নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়বে।

কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সের্গেই ভাকুলেনকো বলেন, লুকওয়েল সমস্যায় পড়বে বটে, কিন্তু সেটি লুকওয়েলের সমস্যা, রাশিয়ার নয়।

পুতিন প্রশাসন বহু আগেই জানত নিষেধাজ্ঞা আসছে। তাই রাশিয়া এখন বিকল্প রুট, পুরোনো জাহাজ বহর ও ফাটকা কোম্পানির জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তেল রপ্তানি চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও রাশিয়া তার প্রভাব আংশিকভাবে অকার্যকর করে দিতে পারবে, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত