Ajker Patrika

তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে নওয়াজের রাজনীতিতে ফেরার পথের যত বাধা

আব্দুর রহমান
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৭: ২০
তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে নওয়াজের রাজনীতিতে ফেরার পথের যত বাধা

চার বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে দিন কয়েক আগেই পাকিস্তানে ফিরেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তাঁর ভাগ্যের বৃহস্পতি যেন তুঙ্গে। দণ্ডিত হলেও দেশে ফেরার আগেই তাঁকে আগাম জামিন দিয়েছিলেন আদালত। বিশ্লেষকেরা যা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে যে পাকিস্তানের কলকাঠির নিয়ন্ত্রক সেনাবাহিনী তুলনামূলক নিরাপদ বিকল্প হিসেবে নওয়াজ শরিফকে বেছে নিয়েছে। সম্ভবত আগামী নির্বাচনে তাঁকে সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ হিসেবে তুলে ধরা হবে।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার নওয়াজ শরিফ ইসলামাবাদ হাইকোর্ট থেকে আল-আজিজিয়া ও অ্যাভেনফিল্ড অ্যাপার্টমেন্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন পেয়েছেন। মজার বিষয় হলো, এরই মধ্যে আরও এক মামলায় (তোশাখানা) তাঁর সাজা স্থগিতের কথা জানিয়েছে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার। তারা জানিয়েছে, আল-আজিজিয়া মামলায় নওয়াজের দণ্ড বাতিল করা হবে পাকিস্তানি দণ্ডবিধির ধারা-৪০১ অনুসারে। তার আগে এই মামলায় নওয়াজের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তুলে নিয়েছেন পাকিস্তানের অ্যাকাউন্টিবিলিটি কোর্ট। তাঁকে ১০ লাখ পাকিস্তানি রুপি মুচলেকায় জামিন দেওয়ার পাশাপাশি এই মামলার সব কার্যক্রম স্থগিত করেছে আগামী ২০ নভেম্বর পর্যন্ত।

গতকাল মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে নওয়াজের মামলার শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি আমির ফারুক ও জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মিয়া গুল হাসান আওরঙ্গজেব বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, পাকিস্তানের দুর্নীতি কর্তৃপক্ষ বলে পরিচিত ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো (ন্যাব) কেন নওয়াজ শরিফের মামলার ব্যাপারে আগের অবস্থান বদল করছে। এ সময় আদালত ন্যাবকে সময় বেঁধে দেন, এক দিনের মধ্যে নওয়াজের তোশাখানা মামলার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে।

গত ২১ অক্টোবর দেশে ফেরেন নওয়াজ শরিফ। দেশে ফেরার আগেই তাঁর হয়ে আগাম জামিন আবেদন করা হয় ইসলামাবাদ হাইকোর্টে। সেখানেও ন্যাবের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি জানানো হয়নি। গতকাল মঙ্গলবারও হাইকোর্টে শুনানির সময় ন্যাবের আইনজীবী আগের অবস্থান বজায় রাখেন। ন্যাবের আইনজীবীরা আদালতকে জানান, ন্যাব সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে আগ্রহী নয়। এই বিষয়টি বিচারপতি আওরঙ্গজেবকে বিস্মিত করে। তিনি জানতে চান, কেন হঠাৎ পাঁচ বছর পর ন্যাব এই ইউ-টার্ন নিচ্ছে।

বিচারপতি আওরঙ্গজেব জানান, তিনি পাঁচ বছর আগে নওয়াজ শরিফের এই মামলায় ডিভিশন বেঞ্চের সদস্য ছিলেন। সে সময় ন্যাবের আইনজীবীরা—তৎকালীন বিশেষ কৌঁসুলি ও অতিরিক্ত কৌঁসুলি তীব্রভাবে নওয়াজের জামিনের বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ তখন নওয়াজ শরিফ চিকিৎসার জন্য জামিন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এবার কী এমন হলো যে জামিন আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মেনে নিলেন?

বিচারপতি আওরঙ্গজেব আরও জানান, ন্যাবের কৌঁসুলিরা বিভিন্ন সময় আদালতের নির্দেশ থাকার পরও আদালতে আসেননি। কিন্তু এই মামলায় যখন প্রথমবারের মতো আগাম জামিনের শুনানি হচ্ছে, তখনই ন্যাবের কৌঁসুলিরা হাজির হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে ন্যাবের কৌঁসুলিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল নওয়াজকে দোষী প্রমাণ করতে, কিন্তু এখন তাঁরা সে রকম চেষ্টার ধারে কাছেও যাচ্ছে না।

নওয়াজের দল থেকে নির্বাচিত ও সাবেক আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার জানান, ইসলামাবাদ হাইকোর্ট এরই মধ্যে অ্যাভেনফিল্ড অ্যাপার্টমেন্ট মামলার প্রমাণ পরীক্ষা করে দেখেছে। তাঁর মতে, হাইকোর্ট নওয়াজ শরিফকে এই মামলার অভিযোগ থেকে একপ্রকার মুক্তিই দিয়েছেন। তিনি এ সময় নওয়াজের এই মামলার আপিলের বিষয়টি নিয়ে বলেন, যেকোনো মামলার আপিলকারীর সাংবিধানিক অধিকার হলো—মামলা বস্তুনিষ্ঠ শুনানি হওয়া। যেহেতু নওয়াজ শরিফ একজন জননেতা তাই যেকোনো অভিযোগ যখন তাঁর বিরুদ্ধে উঠবে, তখন তার প্রয়োজনীয় শুনানি শেষেই সেই অভিযোগের ফয়সালা হতে হবে।

এ তো গেল অ্যাভেনফিল্ড অ্যাপার্টমেন্ট ও আল-আজিজিয়া দুর্নীতি মামলার কথা। তোশাখানা মামলা নামে নওয়াজের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে সেটিও স্থগিত করছে পাঞ্জাবের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পাঞ্জাবের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথ্যমন্ত্রী আমির মির দ্য ডনকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান ফৌজদারি অপরাধ দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা অনুসারে প্রাদেশিক সরকার নওয়াজের দণ্ডাদেশ স্থগিত করছে। এ সময় তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ২০১৯ সালেও পাঞ্জাবের উসমান বাজদার সরকার নওয়াজকে সাজা স্থগিত করে জামিন দিয়েছিল।

মোটা দাগে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো ছিল এবং যেগুলোতে তাঁর সাজা হয়েছিল তার সবগুলোতেই তিনি কোনো না কোনোভাবে গ্রেপ্তারের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। শিগগিরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে—এমনটাও আশঙ্কা নেই। ফলত, দেশে ফেরার মাত্র তিন দিনের মধ্যেই যেন নওয়াজের বিরুদ্ধে থাকা আইনি বাধাগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল।

এমনটা হওয়ার কারণও রয়েছে। ২০১৮ সালে ইমরান খান যখন ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফকে হারিয়ে তখন তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনীতির সবচেয়ে বড় অংশীদার বা নিয়ন্ত্রণকর্তা যা-ই বলি না কেন—পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু সময়ের স্রোতে ইমরান সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়েছেন। একসময়ের জনপ্রিয় এই নেতা এখন জেলে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী। বিপরীতে মাত্র বছর পাঁচেক আগে সেনাবাহিনীর রোষের শিকার হয়ে ক্ষমতা হারা হন নওয়াজ। সেই তিনিই দেশে ফিরেছেন চার বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে।

এ বিষয়ে ভারতীয় থিংক ট্যাংক এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো ড. ঋষি গুপ্তা দ্য ডিপ্লোম্যাটে লিখিত এক নিবন্ধে বলেছেন, ইমরান খানকে জেলে রেখে নওয়াজ ফিরে আসছেন—এর মানে হলো নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর কাছ থেকেই সবুজ সংকেত পেয়েই দেশে ফিরেছেন। সম্ভবত আগামী নির্বাচনে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ হিসেবে উপস্থিত হবে পাকিস্তানের জনগণের সামনে।

নওয়াজের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিষয়ে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন, মার্কিন থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সম্মতি ছাড়া নওয়াজ ফিরে এসেছেন—এটি কেউ ভাবতেও পারে না। নিশ্চয়ই সেনাবাহিনীর সঙ্গে এমন কিছু বোঝাপড়া হয়েছে, যেখানে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে নওয়াজকে গ্রেপ্তার করা হবে না।

বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে মনে হচ্ছে, নওয়াজকে গ্রেপ্তার করা হবে না। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে যত আইনি বাধা ছিল, তা প্রায় একপ্রকার নিষ্ক্রিয়ই করে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় বলা যায়, নওয়াজ সেনাবাহিনীর সম্মতিতেই দেশে ফিরেছেন এবং তিনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগকে (নওয়াজ) নেতৃত্ব দেবেন। যাতে তিনি আবারও ক্ষমতায় ফিরতে পারেন।

কিন্তু সরাসরি ক্ষমতায় ফেরা বোধ হয় খুব একটা সহজ হবে না নওয়াজের জন্য। কারণ, মামলাগুলো স্থগিত হলেও বা তিনি জামিন পেলেও সেগুলো নিষ্পত্তি কিন্তু এখনো হয়নি। তবে তিনি ক্ষমতায় না ফিরতে পারলেও সেনাবাহিনীর সহায়তায় হয়তো তাঁর দল আবারও ক্ষমতায় ফিরবে। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে তাঁর পরিবার কিংবা দলের আস্থাভাজন কেউ ক্ষমতার মূল ব্যক্তি বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অন্তত যত দিন না নওয়াজ আজম নাজির তাঁরার ভাষায় শুনানির মাধ্যমে সব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়ে নির্দোষ হয়ে ফেরেন। তবে ৭৩ বছরের এই পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রীর জন্য বয়স একটি বড় বাধা হিসেবে হাজির হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত