আব্দুর রহমান
পাকিস্তান ও সৌদি আরব এক ঐতিহাসিক কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ‘স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা এসএমডিএ স্বাক্ষর করেছে। এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, এই দুই দেশের কোনো একটির বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসন হলে সেটিকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই অবস্থায় উভয় দেশ পরস্পরকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সৌদি আরব সফরকালে ‘স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’—নামে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। উভয় দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এই চুক্তি কয়েক দশক ধরে চলা নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করছে।
নতুন স্বাক্ষরিত চুক্তির লক্ষ্য হলো—দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজন, তথ্যবিনিময়, বিশেষ করে উভয় দেশের জন্য হুমকি মোকাবিলা করতে, যেমন—সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্তপারের বিদ্রোহ। এ ছাড়া, এতে প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই চুক্তিতে। এর আওতায় প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং সামরিক সরঞ্জামের যৌথ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়টিও রয়েছে, যা পাকিস্তানি সামরিক কর্মীদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যগত সৌদি সেনাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
এই উন্নত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের পেছনের কারণ হলো—গালফের আরব রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা’ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে, ইসরায়েলের গত সপ্তাহে কাতারে আক্রমণের পর বিষয়টি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নিয়ে এক জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা বলেন, ‘এই চুক্তি বছরের পর বছর চলা আলোচনার সমাপ্তি। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেওয়া পদক্ষেপ নয়, বরং আমাদের দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর সহযোগিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদক্ষেপ।’
সৌদি আরবের কর্মকর্তারা যাই বলুন না কেন যে, এটি নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেওয়া পদক্ষেপ নয়, বাস্তবে এই চুক্তির উপযোগিতা অনেক বেশি। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ হিসেবে সৌদি আরব কোনো পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশের সঙ্গে এই ধরনের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে গেল। আর এই বিষয়টিই পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সমীকরণের হিসাব পাল্টে দিতে বাধ্য।
এই চুক্তি সৌদি আরবের কৌশলগত অংশীদারত্ব বৈচিত্র্য করার দৃঢ় ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিয়াদ নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণে আরও স্বাধীনতা খোঁজার প্রয়াস পেয়েছে। আর শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, পারমাণবিক সক্ষমতা এবং ভৌগোলিক কৌশলগত নৈকট্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সৌদি আরবের কাছে ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এই চুক্তি থেকে সৌদি আরব এবং পাকিস্তান উপকৃত হলেও, এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ উলটপালট করে দিয়েছে। এ বিষয়ে পাকিস্তানে সৌদি দূতাবাসের মিডিয়া অ্যাটাশে ড. জামাল আল–হারবি বলেন, ‘এই চুক্তি উভয় অঞ্চলের নিরাপত্তা কৌশলকে পুনর্গঠন করতে পারে। আক্রমণের মুখে যৌথভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সৌদি আরব ও পাকিস্তান একটি স্পষ্ট প্রতিরোধী বার্তা পাঠাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতির ফলে এই দুই দেশের প্রতিপক্ষের জন্য শত্রুতার সম্ভাবনা কমতে পারে। কারণ তারা জানে যে প্রতিশোধের ক্ষেত্রে দুই শক্তিশালী দেশ একযোগে কাজ করবে।’
মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র থাকা দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা বিশ্ব তথা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও বিগত কয়েক মাসে ইসরায়েলের লাগামছাড়া আচরণ, বিভিন্ন দেশে নির্বিচারে হামলা আরব দেশগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে যে, ওয়াশিংটন তাদের আদৌ তেল আবিরের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে চায় কি না। এর আগে, সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্ক উন্নত করেছে। এখন আবার পাকিস্তানের সঙ্গে এই সামরিক চুক্তি! এটা থেকে স্পষ্ট যে, সৌদি আরব তার নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে নিজেদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র তালাশ করছে।
সৌদি–পাকিস্তান এই চুক্তির ফলে, ইসরায়েল এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হতে পারে। আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় করা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডের’ আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি আরবও সেই পথেই হাঁটছিল। একই পথে হাঁটছে সিরিয়াও। তবে গাজায় ইসরায়েলের দুই বছর চালানো বর্বরতার কারণে সৌদি আরব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এই অবস্থায়, পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের এই চুক্তি নিজেদের নতুন আত্মপরিচয় তৈরিরই প্রচেষ্টা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ভালো হলেও, এই চুক্তি ওয়াশিংটনকে বিরক্ত–বিব্রত করতে পারে। তারা এই চুক্তিকে ওয়াশিংটনের ওপর থেকে রিয়াদের আস্থা টলে যাওয়ার নিদর্শন হিসেবেই মনে করতে পারে।
আবার যখন, ওয়াশিংটন কাতারের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ার পরও দোহায় ইসরায়েলি হামলা ঠেকাননি—জানার পরও—তখন সৌদি আরবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। যদিও বাস্তবতা অনেকটাই কঠিন। কারণ, এখনো কাতারে মার্কিন সেনাঘাঁটি রয়ে গেছে। ফলে, বিষয়টি ওয়াশিংটনের অনুমোদন নাও পেতে পারে। কিন্তু এই সম্ভাবনা থেকেই যায় যে, আরব উপদ্বীপের দেশগুলো নিজেদের ইসরায়েলের সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে যেতে পারে। সেটি না হলেও নিদেন পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে সামরিক সহায়তার বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানের কথা ভাবতে পারে।
পাকিস্তানে ইরানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জাভিদ হুসাইন বলেন, ‘পাকিস্তান এবং সৌদি আরব ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।’ তিনি বলেন, এই চুক্তি দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করবে। তাঁর মতে, ‘বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তিতে যে ধারা রয়েছে—যার অধীনে এক দেশের ওপর হামলাকে অন্য দেশের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করা হবে। এই চুক্তি ভারত বা ইসরায়েলের মতো দেশগুলোকে একটি স্পষ্ট ও শক্তিশালী বার্তা দেবে এবং পাকিস্তান বা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত রাখবে।’
জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর এই চুক্তিকে ভারত ও দেশটির অন্যতম মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানের ‘কৌশলগত বিজয়’ হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, এই যৌথ বিবৃতি দেখাচ্ছে যে—এই চুক্তির গুরুত্ব রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায়, এই চুক্তি প্রমাণ করছে যে—পাকিস্তান নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, তাদের ভারত ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘আশা করা হচ্ছে আরও দুটি দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষর করবে।’ তবে তিনি দেশ দুটির নাম উল্লেখ করেননি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এমনকি আমেরিকান ঘাঁটিও ইসরায়েলের আক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়। তিনি বলেন, ‘এটি একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। আগে ধারণা ছিল যে, আমেরিকা তার মিত্রদের পাশে থাকে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পর আর তা সত্য নয়। ইসরায়েলও আমেরিকার মিত্রদের ওপর আক্রমণ করেছে।’
মীর যোগ করেন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের এই চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এটি পাকিস্তানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বন্ধু ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই। তাঁর মতে, ‘এটি পাকিস্তানের জন্য কৌশলগত বিজয় হলেও, একই সঙ্গে সৌদি আরবের প্রত্যাশা পূরণ করা পাকিস্তানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।’
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের এসএমডিএ স্বাক্ষর আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। তবে এর প্রভাব কেবল সামরিক নয়, বরং বিনিয়োগ প্রবাহ ও বাজার স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এটি। এই আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা চুক্তির ফলে, এক দেশের ওপর আক্রমণ অন্য দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হবে। এর মাধ্যমে সৌদি আরব ও পাকিস্তান কেবল নিজেদের কৌশলগত মিত্রতা দৃঢ় করেছে না, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে পুনর্গঠনের সংকেত দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য, এই চুক্তি নতুন সুযোগের পাশাপাশি ঝুঁকিও তৈরি করছে। কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক করিডর, প্রতিরক্ষা শিল্প এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে দ্য অ্যাডভোকেট পোস্ট। এটি বহিরাগত হুমকির বিরুদ্ধে একত্রিতভাবে কাজ করার এবং অস্থির অঞ্চলগুলোকে স্থিতিশীল করার এক যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যারা এমন বাজারে আগ্রহী যেখানে জিওপলিটিক্যাল ঝুঁকি কম।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চুক্তি সৌদি আরবের নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা মিত্রদের বাইরে বিস্তৃত করার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে, যখন মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন আঞ্চলিক অস্থিরতা কমাতে পারে এবং গালফ ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
এই প্রতিরক্ষা চুক্তি ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের রিয়াদ সফরের সময় সৌদি আরব পাকিস্তানের খনিজ, কৃষি, অবকাঠামো এবং বিমান খাতে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। এই প্রকল্পগুলো সৌদি ভিশন—২০৩০ এবং পাকিস্তানের বিদেশি মূলধন আকর্ষণের প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সৌদি বিনিয়োগ দেশের সবুজ শক্তিতে রূপান্তরকে দ্রুততর করতে পারে, আর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো ব্যবসা ও পর্যটন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়। এই চুক্তি পাকিস্তানকে সৌদি আরব ও চীনের মধ্যে একটি কৌশলগত সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, যা অবকাঠামো ও প্রযুক্তিতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার সুযোগ বাড়াবে। এটি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকে (সিপিইসি) আরও শক্তিশালী করতে পারে এবং নতুন বাণিজ্যিক রুট তৈরি করতে পারে, যা আঞ্চলিক বাজারের স্থিতিশীলতাকে সহায়তা করবে।
এসএমডিএ প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার নতুন সুযোগও তৈরি করেছে। পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা ও সামরিক দক্ষতা, সৌদি আরবের আর্থিক সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হলে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও প্রযুক্তিতে যৌথ উদ্যোগ সম্ভব হবে। আল–জাজিরা জানিয়েছে, এই চুক্তিতে গোয়েন্দা তথ্য শেয়ারিং ও যৌথ সামরিক মহড়ার বিধান রয়েছে, যা উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সাইবার সিকিউরিটি সমাধানের চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারে। এই খাতে বিনিয়োগ করা প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি উপকৃত হতে পারে।
যদিও এই চুক্তি সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, এটি অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে জটিলতা তৈরি করছে। সৌদি আরবের ভারতীয় সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে তেল রপ্তানি ও বাণিজ্য চুক্তি, প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে চাপের মুখে পড়তে পারে।
এই বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল আজ বৃহস্পতিবার এক্সে বলেন, ‘ভারত এই ঘটনার বিষয়ে অবগত। আমরা এর প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করব যে, এটি নয়াদিল্লির নিরাপত্তা ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।’
এক উচ্চপদস্থ সৌদি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ককে ভারসাম্য রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগে কখনো এত দৃঢ় ছিল না। আমরা এই সম্পর্ককে আরও গড়ে তুলতে চলেছি এবং যেভাবেই পারি, অঞ্চলে শান্তির জন্য অবদান রাখার চেষ্টা করব।’ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সতর্ক কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা এই চাপ হ্রাস করতে পারে। কারণ উভয় দেশেরই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করার স্বার্থ রয়েছে।
সৌদি-পাকিস্তান এসএমডিএ কেবল প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়—এটি অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক রূপান্তরের উদ্দীপক। এটি স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সংহতি গভীর করার মাধ্যমে, চুক্তি অবকাঠামো, শক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য আঞ্চলিক গতিবিধি ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ পর্যবেক্ষণ করা অপরিহার্য। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া যখন এই নতুন সহযোগিতার যুগে প্রবেশ করছে। এসএমডিএ দেখাচ্ছে কীভাবে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাজারের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করতে পারে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ব্লুমবার্গ, নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, জিও নিউজ, আরব নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান
লেখক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক
পাকিস্তান ও সৌদি আরব এক ঐতিহাসিক কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ‘স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা এসএমডিএ স্বাক্ষর করেছে। এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, এই দুই দেশের কোনো একটির বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসন হলে সেটিকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই অবস্থায় উভয় দেশ পরস্পরকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সৌদি আরব সফরকালে ‘স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’—নামে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। উভয় দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এই চুক্তি কয়েক দশক ধরে চলা নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করছে।
নতুন স্বাক্ষরিত চুক্তির লক্ষ্য হলো—দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজন, তথ্যবিনিময়, বিশেষ করে উভয় দেশের জন্য হুমকি মোকাবিলা করতে, যেমন—সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্তপারের বিদ্রোহ। এ ছাড়া, এতে প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই চুক্তিতে। এর আওতায় প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং সামরিক সরঞ্জামের যৌথ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়টিও রয়েছে, যা পাকিস্তানি সামরিক কর্মীদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যগত সৌদি সেনাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
এই উন্নত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের পেছনের কারণ হলো—গালফের আরব রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা’ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে, ইসরায়েলের গত সপ্তাহে কাতারে আক্রমণের পর বিষয়টি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নিয়ে এক জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা বলেন, ‘এই চুক্তি বছরের পর বছর চলা আলোচনার সমাপ্তি। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেওয়া পদক্ষেপ নয়, বরং আমাদের দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর সহযোগিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদক্ষেপ।’
সৌদি আরবের কর্মকর্তারা যাই বলুন না কেন যে, এটি নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেওয়া পদক্ষেপ নয়, বাস্তবে এই চুক্তির উপযোগিতা অনেক বেশি। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ হিসেবে সৌদি আরব কোনো পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশের সঙ্গে এই ধরনের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে গেল। আর এই বিষয়টিই পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সমীকরণের হিসাব পাল্টে দিতে বাধ্য।
এই চুক্তি সৌদি আরবের কৌশলগত অংশীদারত্ব বৈচিত্র্য করার দৃঢ় ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিয়াদ নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণে আরও স্বাধীনতা খোঁজার প্রয়াস পেয়েছে। আর শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, পারমাণবিক সক্ষমতা এবং ভৌগোলিক কৌশলগত নৈকট্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সৌদি আরবের কাছে ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এই চুক্তি থেকে সৌদি আরব এবং পাকিস্তান উপকৃত হলেও, এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ উলটপালট করে দিয়েছে। এ বিষয়ে পাকিস্তানে সৌদি দূতাবাসের মিডিয়া অ্যাটাশে ড. জামাল আল–হারবি বলেন, ‘এই চুক্তি উভয় অঞ্চলের নিরাপত্তা কৌশলকে পুনর্গঠন করতে পারে। আক্রমণের মুখে যৌথভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সৌদি আরব ও পাকিস্তান একটি স্পষ্ট প্রতিরোধী বার্তা পাঠাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতির ফলে এই দুই দেশের প্রতিপক্ষের জন্য শত্রুতার সম্ভাবনা কমতে পারে। কারণ তারা জানে যে প্রতিশোধের ক্ষেত্রে দুই শক্তিশালী দেশ একযোগে কাজ করবে।’
মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র থাকা দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা বিশ্ব তথা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও বিগত কয়েক মাসে ইসরায়েলের লাগামছাড়া আচরণ, বিভিন্ন দেশে নির্বিচারে হামলা আরব দেশগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে যে, ওয়াশিংটন তাদের আদৌ তেল আবিরের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে চায় কি না। এর আগে, সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্ক উন্নত করেছে। এখন আবার পাকিস্তানের সঙ্গে এই সামরিক চুক্তি! এটা থেকে স্পষ্ট যে, সৌদি আরব তার নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে নিজেদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র তালাশ করছে।
সৌদি–পাকিস্তান এই চুক্তির ফলে, ইসরায়েল এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হতে পারে। আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় করা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডের’ আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি আরবও সেই পথেই হাঁটছিল। একই পথে হাঁটছে সিরিয়াও। তবে গাজায় ইসরায়েলের দুই বছর চালানো বর্বরতার কারণে সৌদি আরব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এই অবস্থায়, পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের এই চুক্তি নিজেদের নতুন আত্মপরিচয় তৈরিরই প্রচেষ্টা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ভালো হলেও, এই চুক্তি ওয়াশিংটনকে বিরক্ত–বিব্রত করতে পারে। তারা এই চুক্তিকে ওয়াশিংটনের ওপর থেকে রিয়াদের আস্থা টলে যাওয়ার নিদর্শন হিসেবেই মনে করতে পারে।
আবার যখন, ওয়াশিংটন কাতারের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ার পরও দোহায় ইসরায়েলি হামলা ঠেকাননি—জানার পরও—তখন সৌদি আরবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। যদিও বাস্তবতা অনেকটাই কঠিন। কারণ, এখনো কাতারে মার্কিন সেনাঘাঁটি রয়ে গেছে। ফলে, বিষয়টি ওয়াশিংটনের অনুমোদন নাও পেতে পারে। কিন্তু এই সম্ভাবনা থেকেই যায় যে, আরব উপদ্বীপের দেশগুলো নিজেদের ইসরায়েলের সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে যেতে পারে। সেটি না হলেও নিদেন পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে সামরিক সহায়তার বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানের কথা ভাবতে পারে।
পাকিস্তানে ইরানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জাভিদ হুসাইন বলেন, ‘পাকিস্তান এবং সৌদি আরব ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।’ তিনি বলেন, এই চুক্তি দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করবে। তাঁর মতে, ‘বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তিতে যে ধারা রয়েছে—যার অধীনে এক দেশের ওপর হামলাকে অন্য দেশের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করা হবে। এই চুক্তি ভারত বা ইসরায়েলের মতো দেশগুলোকে একটি স্পষ্ট ও শক্তিশালী বার্তা দেবে এবং পাকিস্তান বা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত রাখবে।’
জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর এই চুক্তিকে ভারত ও দেশটির অন্যতম মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানের ‘কৌশলগত বিজয়’ হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, এই যৌথ বিবৃতি দেখাচ্ছে যে—এই চুক্তির গুরুত্ব রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায়, এই চুক্তি প্রমাণ করছে যে—পাকিস্তান নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, তাদের ভারত ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘আশা করা হচ্ছে আরও দুটি দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষর করবে।’ তবে তিনি দেশ দুটির নাম উল্লেখ করেননি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এমনকি আমেরিকান ঘাঁটিও ইসরায়েলের আক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়। তিনি বলেন, ‘এটি একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। আগে ধারণা ছিল যে, আমেরিকা তার মিত্রদের পাশে থাকে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পর আর তা সত্য নয়। ইসরায়েলও আমেরিকার মিত্রদের ওপর আক্রমণ করেছে।’
মীর যোগ করেন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের এই চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এটি পাকিস্তানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বন্ধু ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই। তাঁর মতে, ‘এটি পাকিস্তানের জন্য কৌশলগত বিজয় হলেও, একই সঙ্গে সৌদি আরবের প্রত্যাশা পূরণ করা পাকিস্তানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।’
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের এসএমডিএ স্বাক্ষর আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। তবে এর প্রভাব কেবল সামরিক নয়, বরং বিনিয়োগ প্রবাহ ও বাজার স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এটি। এই আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা চুক্তির ফলে, এক দেশের ওপর আক্রমণ অন্য দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হবে। এর মাধ্যমে সৌদি আরব ও পাকিস্তান কেবল নিজেদের কৌশলগত মিত্রতা দৃঢ় করেছে না, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে পুনর্গঠনের সংকেত দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য, এই চুক্তি নতুন সুযোগের পাশাপাশি ঝুঁকিও তৈরি করছে। কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক করিডর, প্রতিরক্ষা শিল্প এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে দ্য অ্যাডভোকেট পোস্ট। এটি বহিরাগত হুমকির বিরুদ্ধে একত্রিতভাবে কাজ করার এবং অস্থির অঞ্চলগুলোকে স্থিতিশীল করার এক যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যারা এমন বাজারে আগ্রহী যেখানে জিওপলিটিক্যাল ঝুঁকি কম।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চুক্তি সৌদি আরবের নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা মিত্রদের বাইরে বিস্তৃত করার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে, যখন মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন আঞ্চলিক অস্থিরতা কমাতে পারে এবং গালফ ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
এই প্রতিরক্ষা চুক্তি ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের রিয়াদ সফরের সময় সৌদি আরব পাকিস্তানের খনিজ, কৃষি, অবকাঠামো এবং বিমান খাতে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। এই প্রকল্পগুলো সৌদি ভিশন—২০৩০ এবং পাকিস্তানের বিদেশি মূলধন আকর্ষণের প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সৌদি বিনিয়োগ দেশের সবুজ শক্তিতে রূপান্তরকে দ্রুততর করতে পারে, আর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো ব্যবসা ও পর্যটন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়। এই চুক্তি পাকিস্তানকে সৌদি আরব ও চীনের মধ্যে একটি কৌশলগত সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, যা অবকাঠামো ও প্রযুক্তিতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার সুযোগ বাড়াবে। এটি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকে (সিপিইসি) আরও শক্তিশালী করতে পারে এবং নতুন বাণিজ্যিক রুট তৈরি করতে পারে, যা আঞ্চলিক বাজারের স্থিতিশীলতাকে সহায়তা করবে।
এসএমডিএ প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার নতুন সুযোগও তৈরি করেছে। পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা ও সামরিক দক্ষতা, সৌদি আরবের আর্থিক সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হলে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও প্রযুক্তিতে যৌথ উদ্যোগ সম্ভব হবে। আল–জাজিরা জানিয়েছে, এই চুক্তিতে গোয়েন্দা তথ্য শেয়ারিং ও যৌথ সামরিক মহড়ার বিধান রয়েছে, যা উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সাইবার সিকিউরিটি সমাধানের চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারে। এই খাতে বিনিয়োগ করা প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি উপকৃত হতে পারে।
যদিও এই চুক্তি সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, এটি অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে জটিলতা তৈরি করছে। সৌদি আরবের ভারতীয় সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে তেল রপ্তানি ও বাণিজ্য চুক্তি, প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে চাপের মুখে পড়তে পারে।
এই বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল আজ বৃহস্পতিবার এক্সে বলেন, ‘ভারত এই ঘটনার বিষয়ে অবগত। আমরা এর প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করব যে, এটি নয়াদিল্লির নিরাপত্তা ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।’
এক উচ্চপদস্থ সৌদি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ককে ভারসাম্য রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগে কখনো এত দৃঢ় ছিল না। আমরা এই সম্পর্ককে আরও গড়ে তুলতে চলেছি এবং যেভাবেই পারি, অঞ্চলে শান্তির জন্য অবদান রাখার চেষ্টা করব।’ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সতর্ক কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা এই চাপ হ্রাস করতে পারে। কারণ উভয় দেশেরই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করার স্বার্থ রয়েছে।
সৌদি-পাকিস্তান এসএমডিএ কেবল প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়—এটি অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক রূপান্তরের উদ্দীপক। এটি স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সংহতি গভীর করার মাধ্যমে, চুক্তি অবকাঠামো, শক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য আঞ্চলিক গতিবিধি ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ পর্যবেক্ষণ করা অপরিহার্য। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া যখন এই নতুন সহযোগিতার যুগে প্রবেশ করছে। এসএমডিএ দেখাচ্ছে কীভাবে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাজারের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করতে পারে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ব্লুমবার্গ, নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, জিও নিউজ, আরব নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান
লেখক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক
মার্কিন ইতিহাসবিদ ও ‘অ্যান্টিফা: দ্য অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট হ্যান্ডবুক’ বইয়ের লেখক মার্ক ব্রে বলেন, অ্যান্টিফা একটি রাজনৈতিক আদর্শ, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যেমন—নারীবাদী গোষ্ঠী আছে, কিন্তু নারীবাদ নিজে কোনো গোষ্ঠী নয়। যেকোনো গোষ্ঠী, যারা নিজেদের অ্যান্টিফা বলে এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী
৬ ঘণ্টা আগেদক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ‘বড় ভাই’ বা ‘আঞ্চলিক মোড়ল’ (হেজেমন) হিসেবে একটি ধারণা বিদ্যমান। তবে নেপালের সংকটময় পরিস্থিতিতে ভারতকে কূটনৈতিকভাবে সতর্ক হতে হবে। ভারতের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না, যা ‘বড় ভাই’ বা ‘আঞ্চলিক মোড়ল’ হিসেবে হস্তক্ষেপের ধারণাকে উসকে দেয়। অতীতে ভারতের এমন ‘দাদাগিরি’র কারণেই নেপ
১ দিন আগেট্রাম্প প্রশাসন এখন চীনের সঙ্গে সহাবস্থানের কৌশল খুঁজছে। এর একটি মূল দিক হলো, সাময়িক উত্তেজনার বদলে সম্পর্কের স্থিতিশীলতাকে কৌশলগত রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া।’ ব্রাজিয়া মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে উভয় দেশ পরস্পরের ওপর খবরদারি করার ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে এসেছে। তবে এখন বাস্তবতা পাল্টাচ্ছে এবং
১ দিন আগেনেপালে তরুণ বেকারত্বের হার অত্যন্ত বেশি ও মাথাপিছু জিডিপি কম। ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ কাজের খোঁজে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তবে মনে হচ্ছে, এই বিক্ষোভে বাইরের লোকজন ঢুকে পড়ে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
৩ দিন আগে