Ajker Patrika

বিবিসির প্রতিবেদন /চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য নিয়ে উভয়সংকটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৬: ২১
ভিয়েতনামের একটি তৈরি পোশাক কারখানা। ছবি: এএফপি
ভিয়েতনামের একটি তৈরি পোশাক কারখানা। ছবি: এএফপি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদে চীনের ওপর শুল্ক বসিয়েছিলেন। সে সময় ভিয়েতনামের ব্যবসায়ী হাও লে একটি সুযোগ দেখেছিলেন। কারণ, তাঁর কোম্পানি চীনা রপ্তানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছিল সে সময়। এবার যখন পশ্চিমা দেশগুলো ক্রমেই চীনা রপ্তানিতে বাধা দিচ্ছে, তখন হাও লের কোম্পানির মতো শত শত কোম্পানি সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।

লের কোম্পানির নাম এসএইচডিসি ইলেকট্রনিকস। তারা প্রতি মাসে ২০ লাখ ডলারের যন্ত্রাংশ আমেরিকায় রপ্তানি করে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের সরঞ্জাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ট্রাম্প ভিয়েতনামের পণ্যে ৪৬ শতাংশ শুল্ক বসালে সেই আয়ের পথ বন্ধ হতে পারে। এই পরিকল্পনা জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করেছেন ট্রাম্প। লে বলছেন, এটি তাঁর ব্যবসার জন্য খুবই খারাপ খবর। এটা তাঁর ব্যবসার জন্য ‘বিপর্যয়’ ডেকে আনবে।

তাঁর কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বিক্রি করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা চীনা পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি না। এটি কেবল আমাদের সমস্যা নয়। অনেক দেশীয় কোম্পানি অভ্যন্তরীণ বাজারে হিমশিম খাচ্ছে।’

২০১৬ সালে ট্রাম্প শুল্ক বসানোর পর সস্তা চীনা পণ্যে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বাজার ভরে যায়। এই পণ্যগুলো আসলে আমেরিকার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় অনেক চীনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অনেকগুলো দেশের স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তবে এই পরিস্থিতি অন্য ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগও তৈরি করে। অনেক কোম্পানি বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। বহু কোম্পানি চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে চাইছিল। কিন্তু এখন আবার ট্রাম্প নিজেই সেই দরজাগুলো বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছেন। তিনি এই সুযোগগুলোকে একটি অগ্রহণযোগ্য ফাঁক হিসেবে দেখছেন।

এটি ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য বিশাল এক ধাক্কা। এই দেশগুলো চিপস থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে হিস্যা দাবি করছে। কিন্তু তারা এখন বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকে পড়েছে। চীন তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশী ও সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। আর আমেরিকা তাদের প্রধান রপ্তানি বাজার। দেশগুলোর আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এমন চুক্তি করতে চাইতে পারে তাদের সঙ্গে, যার ফলে চীন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গত সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়া সফর করেছেন। এই সফর আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এর গুরুত্ব বেড়েছে। তিন দেশই সি–কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। তবে ট্রাম্প এটিকে দেখছেন আমেরিকাকে ‘বিপদে ফেলার’ ষড়যন্ত্র হিসেবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবরে এসেছে, হোয়াইট হাউস ছোট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। ওয়াশিংটন এই দেশগুলোকে বেইজিংয়ের সঙ্গে লেনদেন সীমিত করতে চাপ দেবে বলে জানা গেছে। কিন্তু চীন ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্যের পরিমাণ এতই বেশি যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হতে পারে।

সরকারি তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে চীন রপ্তানি থেকে রেকর্ড সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এর ১৬ শতাংশই এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশগুলো থেকে এবং এই অঞ্চলই চীনের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। বেইজিং এই অঞ্চলে অনেক প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। ভিয়েতনামে রেললাইন, কম্বোডিয়ায় বাঁধ এবং মালয়েশিয়ায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন। এগুলো দেশটির ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অংশ। এর উদ্দেশ্য, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করা।

মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী টেংকু জাফরুল আজিজ বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমরা চীন ও আমেরিকার মধ্যে কাউকে বেছে নিতে পারি না। যদি কোনো বিষয় আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে আমরা নিজেদের রক্ষা করব।’

ট্রাম্প নতুন করে বিশাল শুল্কের ঘোষণা দেওয়ার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলো নড়েচড়ে বসেছে। তারা দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে আলোচনা শুরু করেছে। ভিয়েতনামের নেতা তো লামের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ট্রাম্প। তিনি এটিকে ‘খুব ফলপ্রসূ’ আলাপ বলেছেন। তো লাম মার্কিন পণ্যের ওপর থেকে সব শুল্ক তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

আমেরিকার বাজার ভিয়েতনামের জন্য জরুরি। ভিয়েতনাম ইলেকট্রনিকস শিল্পে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। স্যামসাং, ইন্টেল ও ফক্সকনের মতো কোম্পানি দেশটিতে কারখানা স্থাপন করেছে। তাইওয়ানভিত্তিক কোম্পানি ফক্সকন টেক জায়ান্ট অ্যাপলের হয়ে আইফোন তৈরি করে।

এদিকে, থাই কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে গেছেন। তাঁদের পরিকল্পনা হলো, আমেরিকা থেকে আমদানি ও বিনিয়োগ বাড়ানো। আমেরিকা তাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। তাই তারা ৩৬ শতাংশ শুল্ক এড়াতে চাইছে। ট্রাম্প যেকোনো সময় এই শুল্ক আবার চালু করতে পারেন বলে ভয় তাদের। থাই প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রা বলেছেন, ‘আমরা আমেরিকাকে বলব, থাইল্যান্ড শুধু রপ্তানি করে না, আমরা তাদের বিশ্বস্ত মিত্র ও অর্থনৈতিক অংশীদার। আমেরিকা আমাদের ওপর দীর্ঘ মেয়াদে ভরসা রাখতে পারে।’

ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করলেও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান পাল্টা ব্যবস্থা নেবে না। তারা ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বরং, তারা আমেরিকার কাছে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরবে। টেংকু জাফরুল আজিজ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা আমেরিকার উদ্বেগ বুঝতে পারছি। আমাদের দেখাতে হবে, আসিয়ান এবং বিশেষ করে মালয়েশিয়া আমেরিকার জন্য একটি সংযোগ সেতু বা মধ্যস্থতাকারী হতে পারে।’

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। তারা এই ভূমিকা ভালোভাবেই পালন করেছে। চীন ও আমেরিকা—দুই পক্ষের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে তারা লাভবান হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের স্থগিত শুল্ক সেই ধারা ব্যাহত করতে পারে।

মালয়েশিয়ার কথাই ভাবা যাক। গত কয়েক বছরে আমেরিকা ও অন্য দেশ থেকে চিপ প্রস্তুতকারকেরা সেখানে বিনিয়োগ করেছে। ওয়াশিংটন চীনের কাছে উন্নত প্রযুক্তি বিক্রি বন্ধ করেছে বলেই মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের এই বাড়বাড়ন্ত। গত বছর চীন মালয়েশিয়া থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের চিপ আমদানি করেছে। এই চিপগুলো চীনে ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরিতে কাজে লাগে। যেমন আইফোন। এসব পণ্য সাধারণত আমেরিকায় রপ্তানি হয়।

মালয়েশিয়ার ওপর ট্রাম্প ২৪ শতাংশ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে মার্কিন বাজারে কয়েক শ কোটি ডলারের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে এখানেই শেষ নয়, জাফরুল আজিজ বলেন, ‘যদি এমন পরিস্থিতি থেকেই যায়, তাহলে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ নিয়ে নতুন করে ভাববে। এর প্রভাব কেবল মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতেও পড়বে।’

ইন্দোনেশিয়ার ওপরও ৩২ শতাংশ শুল্ক ধার্য করতে পারেন ট্রাম্প। ইন্দোনেশিয়ায় প্রচুর নিকেল আছে। এ কারণে দেশটি বৈদ্যুতিক গাড়ির সরবরাহ চেইনে বড় ভূমিকা নিতে চায়।

কম্বোডিয়াকে সবচেয়ে বেশি শুল্কের মুখে পড়তে হচ্ছে। তাদের ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্ক বসতে পারে। কম্বোডিয়াকে চীনের মিত্র ভাবা হয়। কম্বোডিয়া এই অঞ্চলের অন্যতম দরিদ্র দেশ। তবে দেশটি ট্রানজিট হাব হিসেবে বেশ উন্নতি করেছে। যেসব চীনা কোম্পানি আমেরিকার শুল্ক এড়াতে চায়, তারা ফ্রেন্ডশোরিংয়ের অংশ হিসেবে কম্বোডিয়াকে ব্যবহার করছে। কম্বোডিয়ায় পোশাক কারখানার ৯০ শতাংশই চীনাদের মালিকানাধীন বা তারাই চালায়। এই কারখানাগুলো মূলত আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি করে।

মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের অর্থনীতিবিদ ডরিস লিউ বলেছেন, ট্রাম্প শুল্কগুলো স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু ‘যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে! তিনি বলেন, এটি এই অঞ্চলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। শুধু আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কমালেই হবে না। কোনো একক বাণিজ্য অংশীদারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাও কমাতে হবে। এর জন্য ভারসাম্য আনা দরকার।

এই অনিশ্চিত সময়ে সি চিনপিং এক দৃঢ় বার্তা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘আসুন আমরা হাত মেলাই।’ আমেরিকার ‘ধমক’ প্রতিরোধ করি। তবে এটা সহজ হবে না। কারণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিংয়েরও বাণিজ্য বিরোধ আছে।

ইন্দোনেশিয়ার ব্যবসায়ী ইসমা সাবিত্রী চিন্তিত। চীনের ওপর ট্রাম্প ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। তিনি বলেন, এর মানে হলো—চীনা পণ্য এখন অন্য বাজারে যাবে। ইসমা মনে করেন, এতে চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা বাড়বে। কারণ, তারাও আর আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে পারছে না।

হেলোপপি নামের একটি পোশাক ব্র্যান্ডের মালিক ইসমা। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো ছোট ব্যবসাগুলো খুব চাপে পড়েছে। অত্যন্ত সস্তা চীনা পণ্যের কারণে আমরা টিকে থাকতে লড়াই করছি।’ হেলোপপির একটি জনপ্রিয় পায়জামার দাম ৭ দশমিক ১০ ডলার। ইন্দোনেশীয় রুপিতে এটা ১ লাখ ১৯ হাজার। ইসমা জানান, তিনি চীন থেকে আসা একই ডিজাইনের পায়জামা প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি হতে দেখেছেন।

সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস ইউসুফ-ইসহাক ইনস্টিটিউটের গবেষক নগুয়েন খ্যাক জিয়াং বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চীনের খুব কাছে। এখানকার বাণিজ্য ব্যবস্থা উন্মুক্ত। বাজারও দ্রুত বাড়ছে। তাই এটি চীনা পণ্যের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে অনেক দেশ চীনের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে চায় না। এতে তাদের দুর্বলতা আরও বাড়ে।

চীনা পণ্যের দাম কম, তাই ক্রেতারা খুশি। পোশাক, জুতা, ফোন—সবকিছুর দাম কম। কিন্তু হাজার হাজার স্থানীয় ব্যবসা এই কম দামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। থাইল্যান্ডের একটি গবেষণা সংস্থা বলছে, গত দুই বছরে প্রতি মাসে দেশটিতে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়েছে।

একই সময়ে ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় আড়াই লাখ টেক্সটাইল শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। সেখানকার বাণিজ্য সংস্থাগুলো জানিয়েছে, প্রায় ৬০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। স্রিটেক্স ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল কারখানা। সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে।

মুজিয়াতি নামে একজন স্রিটেক্সে ৩০ বছর কাজ করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি চাকরি হারান। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা যখন খবরে দেখছি, আমদানি করা পণ্যে বাজার ভরে গেছে। এটি আমাদের দেশের বাজার নষ্ট করছে।’ ৫০ বছর বয়সী মুজিয়াতি এখনো কাজ খুঁজছেন। তিনি বলেন, ‘হয়তো আমাদের ভাগ্যই খারাপ ছিল। আমরা কার কাছে অভিযোগ করব? কেউ নেই।’

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলো সুরক্ষানীতি নিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চীনা পণ্যের প্রভাব থেকে বাঁচতে সাহায্য চাওয়ায় সরকারগুলো পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত বছর ইন্দোনেশিয়া কিছু চীনা পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক বসানোর কথা ভেবেছিল। তারা একটি জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট তেমু বন্ধ করে দেয়। এটি চীনা ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।

থাইল্যান্ড আমদানি পণ্যে নজরদারি বাড়িয়েছে। দেড় হাজার থাই বাথের (প্রায় ৪৫ ডলার) কম দামের পণ্যে তারা অতিরিক্ত কর বসিয়েছে। এ বছর ভিয়েতনাম চীনা ইস্পাত পণ্যের ওপর দুই বার শুল্ক বসিয়েছে। ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণার পর খবর এসেছে, ভিয়েতনাম কড়াকড়ি করতে চলেছে। তাদের দেশ হয়ে আমেরিকায় পাঠানো চীনা পণ্যের ওপর এই কড়াকড়ি হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যে ভয় পাচ্ছে তা প্রশমিত করা সি’র সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। দ্য ইকোনমিস্টের সাবেক বেইজিং ব্যুরো চিফ ডেভিড রেনি বিবিসিকে বলেন, ‘চীনের একটা চিন্তা আছে। আমেরিকার জন্য তৈরি পণ্য অন্য দেশে পাঠালে সেই বাণিজ্য অংশীদাররা বিরক্ত হবে। তারা হয়তো চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীনা পণ্যের ঢল যদি এই বাজারগুলোকে ভাসিয়ে দেয়, চাকরির ক্ষতি করে—তবে তা চীনের জন্য বড় সমস্যা হবে। এটা তাদের কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক মাথাব্যথার কারণ হবে।’

চীনের সঙ্গে এই অঞ্চলের সম্পর্ক সব সময় সহজ ছিল না। লাওস, কম্বোডিয়া ও যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমার ছাড়া অন্য দেশগুলো চীনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সতর্ক। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধ ফিলিপাইনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেছে। ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার মতো দেশেরও একই সমস্যা আছে। তবে এত দিন বাণিজ্য এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সেই অবস্থা বদলে যেতে পারে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক চং জা-ইয়ান বলেন, ‘আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ভাবতে হতো চীনকে অসন্তুষ্ট করবে কিনা। এখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।’

চীনের ক্ষতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য লাভও বয়ে আনতে পারে। ভিয়েতনামের হাও লে আবারও সুযোগ দেখছেন। তিনি বলেন, আমেরিকান ক্রেতারা এখন চীনের বাইরে নতুন সরবরাহকারী খুঁজছে। খোঁজখবর অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আগে সরবরাহকারী বদলাতে মাস লাগত। এখন কয়েক দিনেই সিদ্ধান্ত হয়।’

মালয়েশিয়ায় বিশাল রাবার বাগান আছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেডিকেল রাবার গ্লাভস উৎপাদনকারী। রাবার গ্লাভসের প্রায় অর্ধেক বাজার তাদের দখলে। তারা তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছ থেকে আরও বড় বাজার দখল করতে প্রস্তুত। মালয়েশিয়ান রাবার গ্লাভস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উন কিম হং বলেন, এই অঞ্চলের পণ্যে ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক বসেছে। এটা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মতোই। এটা অবশ্যই খারাপ খবর।

তবে উন কিম হাং বলেন, ‘ট্রাম্পের স্থগিত শুল্ক ফের চালু হলেও মালয়েশিয়ার লাভ হবে। গ্রাহকেরা মালয়েশিয়ার গ্লাভসের জন্য অতিরিক্ত ২৪ শতাংশ শুল্ক দিতে রাজি হবে। কারণ চীনা গ্লাভসের জন্য ১৪৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ঠিক আনন্দে নাচছি না। কিন্তু এটি আমাদের উৎপাদকদের জন্য ভালো হতে পারে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার উৎপাদকরাও এতে লাভবান হতে পারে।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহ-সম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত