আজকের পত্রিকা ডেস্ক

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া যে পরিমাণ অর্থ আয় করেছে, তা এই তিন বছরে দেশগুলোর কাছ থেকে ইউক্রেনের পাওয়া সহায়তার তিন গুণ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই তথ্য।
পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে এখনো বিলিয়ন ডলার আয় করছে মস্কো।
কত আয় করছে রাশিয়া?
রাশিয়ার মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশই আসে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনের মিত্ররা রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করলেও গ্যাস আমদানি অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৯ মে পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া প্রায় ৮৮৩ বিলিয়ন ইউরো আয় করেছে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলো থেকেই এসেছে ২২৮ বিলিয়ন ইউরো।
এই বিপুল অর্থের সিংহভাগ—প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ইউরো—এসেছে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউক্রেন রাশিয়ার গ্যাস পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছিল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউক্রেন ট্রানজিট বিচ্ছিন্ন করার পর তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি। হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া তুরস্ক হয়ে এখনো রাশিয়ার পাইপলাইনে গ্যাস পাচ্ছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এই রুটে গ্যাস আমদানির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে।
সিআরইএর তথ্য আরও বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০২৪ সালে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আয় আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ কমেছে, আর রপ্তানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি থেকে রাশিয়ার আয় বরং ৬ শতাংশ বেড়েছে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ।
রাশিয়ার নিজস্ব হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিও রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার রপ্তানি করা এলএনজির অর্ধেকই যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর এখনো ‘সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হয়নি, কারণ কিছু সদস্য দেশ আশঙ্কা করছে, এতে সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে এবং স্বল্প মেয়াদে রাশিয়ার জ্বালানি কিনতে খরচও কম পড়ে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদিত ১৭তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে এলএনজি আমদানি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে সব ধরনের গ্যাস আমদানি বন্ধ করার একটি রোডম্যাপ নিয়েছে ইইউ।
তথ্য বলছে, রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করে যত অর্থ আয় করেছে, তা ইউক্রেনের মিত্ররা দেশটিকে যত সহায়তা দিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশিই।
জ্বালানি চাহিদাই যুদ্ধে রাশিয়ার অর্থায়নের সক্ষমতা কমানোর প্রচেষ্টায় পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেশার গ্রুপ গ্লোবাল উইটনেসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাই রোসনার বিবিসিকে বলেন, অনেক পশ্চিমা নীতিনির্ধারক আশঙ্কা করছেন, রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিলে জ্বালানির মূল্য অনেক বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিক্রি সীমিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সরকারেরই আন্তরিক ইচ্ছা নেই। কারণ, বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে শঙ্কিত। একটা সীমা টেনে রাখা হয়েছে—যেখানে বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে আর কেউ তেমন পদক্ষেপ নিতে চায় না।
পরিশোধনে ফাঁকফোকর
সরাসরি তেল বিক্রির পাশাপাশি তেল রপ্তানির আরও এক পরোক্ষ উপায় ব্যবহার করছে রাশিয়া—যেটি ‘রিফাইনিং লুপহোল’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল তৃতীয় কোনো দেশে পরিশোধন হয়ে জ্বালানি পণ্যে পরিণত হয়। এরপর তা নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। কখনো কখনো রাশিয়ার তেল অন্য দেশ থেকে আনা অপরিশোধিত তেলের সঙ্গে মিশিয়েও বাজারজাত করা হয়।
সিআরইএ জানিয়েছে, তারা তুরস্ক ও ভারতে তিনটি করে ‘লন্ড্রোম্যাট’ রিফাইনারির সন্ধান পেয়েছে, যেগুলো রাশিয়ার তেল পরিশোধন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলোতে রপ্তানি করছে। এই পরিশোধনাগারগুলো রাশিয়ার প্রায় ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের অপরিশোধিত তেল ব্যবহার করেছে।
ভারতের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় সিআরইএর এই প্রতিবেদনকে ‘ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, ‘এই দেশগুলো জানে যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলো এই কৌশলকে প্রশ্রয় নিচ্ছে। এটা একধরনের ফাঁকফোকর। বৈধভাবে সবকিছু হচ্ছে। সবাই জানে ব্যাপারটা, কিন্তু কার্যকরভাবে এটি ঠেকাতে কেউ বিশেষ কিছু করছে না।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাস থেকে রাজস্বপ্রবাহ বন্ধ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে যথেষ্ট উপায় ও সক্ষমতা রয়েছে। রাশিয়ার সাবেক জ্বালানি উপমন্ত্রী ও বর্তমানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠোর সমালোচক ভ্লাদিমির মিলভ মনে করেন, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞাগুলো রয়েছে—বিশেষ করে জি৭ গোষ্ঠী যে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে—তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক রদবদলের কারণে দেশটির ট্রেজারি বিভাগের মতো সংস্থাগুলোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার সক্ষমতা ব্যাহত হয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাশিয়ার ‘ছায়া ট্যাংকার বহর’। এগুলো নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করছে। মিলভ বলেন, এটি একধরনের জটিল অপারেশন। এখানে কয়েক সপ্তাহ পরপর নতুন করে কিছু জাহাজ, শেল কোম্পানি, ব্যবসায়ী, বিমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়।
তবে তিনি বলেন, এই খাতে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা বেশি সক্রিয় হয়েছে—বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যে নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো দিয়েছে, তা এই কৌশলকে উৎসাহিত করেছে।
উল্লেখ্য, ‘ছায়া ট্যাংকার’ বলতে এমন তেলবাহী জাহাজগুলোকে বোঝায়, যেগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করে। এই ধরনের জাহাজ সাধারণত তাদের অবস্থান শনাক্তে ডেটা সরবরাহকারী ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখে এবং কখনো কখনো বিভিন্ন দেশের পতাকা বদল করে বা ভুয়া মালিকানায় চলে। ফলে এগুলোকে শনাক্ত করা কঠিন হয়। এই কৌশলে সাগরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে তেল স্থানান্তর করার মাধ্যমে তেলের উৎস বা গন্তব্য গোপন রাখা হয়।
এ ছাড়া অনেক সময় শেল কোম্পানি বা ভুয়া নামধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এসব জাহাজ। রাশিয়া ও ইরান এই ছায়া ট্যাংকার ব্যবস্থার বড় ব্যবহারকারী। বিশেষ করে তাদের তেলের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বিস্তৃত ও কঠোর হলেই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে। এই জাহাজগুলোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বিক্রি করা সম্ভব হয়, ফলে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে ইউরোপে রাশিয়ার এলএনজি রপ্তানি বন্ধ করা এবং রিফাইনিং ফাঁকফোকর বন্ধ করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিআরইএর রঘুনন্দনের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে রাশিয়ার এলএনজি আমদানি বন্ধ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তিনি বিবিসিকে বলেন, রাশিয়ার এলএনজির ৫০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, অথচ ২০২৪ সালে ইউরোপের মোট এলএনজি চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। কাজেই ইউরোপ যদি রাশিয়ার গ্যাস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে রাশিয়ার ওপর আঘাতটা হবে অনেক বেশি। অন্যদিকে ইউরোপের ওপর এর প্রভাব হবে খুবই কম।
ট্রাম্পের তেলের দাম কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়
ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তেলের দাম কমানো উচিত—ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার সাবেক উপজ্বালানিমন্ত্রী ভ্লাদিমির মিলভ বলেন, ট্রাম্পের কথা শুনে মস্কোর মানুষ হাসছে, কারণ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকার শেল অয়েল শিল্প—যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও প্রতিযোগিতাহীন তেল উৎপাদন খাত।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের খরচ এমনকি সৌদি আরবের মতো ওপেকভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও কম। ফলে তেলের দাম কমলে রাশিয়ার আগে ওপেক দেশগুলোরই বড় ক্ষতি হবে। আর সৌদি আরব এটা কোনোভাবেই মানবে না। অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার কাছ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি কেনার মধ্যে নৈতিক ও বাস্তব সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছি যেখানে একদিকে যেই যুদ্ধের নিন্দা জানাচ্ছি, সেই যুদ্ধের আগ্রাসনকারীকে অর্থ দিচ্ছি, আবার সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পক্ষকেও সহায়তা করছি।’

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া যে পরিমাণ অর্থ আয় করেছে, তা এই তিন বছরে দেশগুলোর কাছ থেকে ইউক্রেনের পাওয়া সহায়তার তিন গুণ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই তথ্য।
পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে এখনো বিলিয়ন ডলার আয় করছে মস্কো।
কত আয় করছে রাশিয়া?
রাশিয়ার মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশই আসে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনের মিত্ররা রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করলেও গ্যাস আমদানি অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৯ মে পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া প্রায় ৮৮৩ বিলিয়ন ইউরো আয় করেছে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলো থেকেই এসেছে ২২৮ বিলিয়ন ইউরো।
এই বিপুল অর্থের সিংহভাগ—প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ইউরো—এসেছে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউক্রেন রাশিয়ার গ্যাস পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছিল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউক্রেন ট্রানজিট বিচ্ছিন্ন করার পর তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি। হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া তুরস্ক হয়ে এখনো রাশিয়ার পাইপলাইনে গ্যাস পাচ্ছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এই রুটে গ্যাস আমদানির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে।
সিআরইএর তথ্য আরও বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০২৪ সালে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আয় আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ কমেছে, আর রপ্তানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি থেকে রাশিয়ার আয় বরং ৬ শতাংশ বেড়েছে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ।
রাশিয়ার নিজস্ব হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিও রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার রপ্তানি করা এলএনজির অর্ধেকই যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর এখনো ‘সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হয়নি, কারণ কিছু সদস্য দেশ আশঙ্কা করছে, এতে সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে এবং স্বল্প মেয়াদে রাশিয়ার জ্বালানি কিনতে খরচও কম পড়ে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদিত ১৭তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে এলএনজি আমদানি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে সব ধরনের গ্যাস আমদানি বন্ধ করার একটি রোডম্যাপ নিয়েছে ইইউ।
তথ্য বলছে, রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করে যত অর্থ আয় করেছে, তা ইউক্রেনের মিত্ররা দেশটিকে যত সহায়তা দিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশিই।
জ্বালানি চাহিদাই যুদ্ধে রাশিয়ার অর্থায়নের সক্ষমতা কমানোর প্রচেষ্টায় পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেশার গ্রুপ গ্লোবাল উইটনেসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাই রোসনার বিবিসিকে বলেন, অনেক পশ্চিমা নীতিনির্ধারক আশঙ্কা করছেন, রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিলে জ্বালানির মূল্য অনেক বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিক্রি সীমিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সরকারেরই আন্তরিক ইচ্ছা নেই। কারণ, বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে শঙ্কিত। একটা সীমা টেনে রাখা হয়েছে—যেখানে বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে আর কেউ তেমন পদক্ষেপ নিতে চায় না।
পরিশোধনে ফাঁকফোকর
সরাসরি তেল বিক্রির পাশাপাশি তেল রপ্তানির আরও এক পরোক্ষ উপায় ব্যবহার করছে রাশিয়া—যেটি ‘রিফাইনিং লুপহোল’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল তৃতীয় কোনো দেশে পরিশোধন হয়ে জ্বালানি পণ্যে পরিণত হয়। এরপর তা নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। কখনো কখনো রাশিয়ার তেল অন্য দেশ থেকে আনা অপরিশোধিত তেলের সঙ্গে মিশিয়েও বাজারজাত করা হয়।
সিআরইএ জানিয়েছে, তারা তুরস্ক ও ভারতে তিনটি করে ‘লন্ড্রোম্যাট’ রিফাইনারির সন্ধান পেয়েছে, যেগুলো রাশিয়ার তেল পরিশোধন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলোতে রপ্তানি করছে। এই পরিশোধনাগারগুলো রাশিয়ার প্রায় ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের অপরিশোধিত তেল ব্যবহার করেছে।
ভারতের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় সিআরইএর এই প্রতিবেদনকে ‘ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, ‘এই দেশগুলো জানে যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলো এই কৌশলকে প্রশ্রয় নিচ্ছে। এটা একধরনের ফাঁকফোকর। বৈধভাবে সবকিছু হচ্ছে। সবাই জানে ব্যাপারটা, কিন্তু কার্যকরভাবে এটি ঠেকাতে কেউ বিশেষ কিছু করছে না।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাস থেকে রাজস্বপ্রবাহ বন্ধ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে যথেষ্ট উপায় ও সক্ষমতা রয়েছে। রাশিয়ার সাবেক জ্বালানি উপমন্ত্রী ও বর্তমানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠোর সমালোচক ভ্লাদিমির মিলভ মনে করেন, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞাগুলো রয়েছে—বিশেষ করে জি৭ গোষ্ঠী যে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে—তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক রদবদলের কারণে দেশটির ট্রেজারি বিভাগের মতো সংস্থাগুলোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার সক্ষমতা ব্যাহত হয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাশিয়ার ‘ছায়া ট্যাংকার বহর’। এগুলো নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করছে। মিলভ বলেন, এটি একধরনের জটিল অপারেশন। এখানে কয়েক সপ্তাহ পরপর নতুন করে কিছু জাহাজ, শেল কোম্পানি, ব্যবসায়ী, বিমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়।
তবে তিনি বলেন, এই খাতে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা বেশি সক্রিয় হয়েছে—বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যে নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো দিয়েছে, তা এই কৌশলকে উৎসাহিত করেছে।
উল্লেখ্য, ‘ছায়া ট্যাংকার’ বলতে এমন তেলবাহী জাহাজগুলোকে বোঝায়, যেগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করে। এই ধরনের জাহাজ সাধারণত তাদের অবস্থান শনাক্তে ডেটা সরবরাহকারী ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখে এবং কখনো কখনো বিভিন্ন দেশের পতাকা বদল করে বা ভুয়া মালিকানায় চলে। ফলে এগুলোকে শনাক্ত করা কঠিন হয়। এই কৌশলে সাগরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে তেল স্থানান্তর করার মাধ্যমে তেলের উৎস বা গন্তব্য গোপন রাখা হয়।
এ ছাড়া অনেক সময় শেল কোম্পানি বা ভুয়া নামধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এসব জাহাজ। রাশিয়া ও ইরান এই ছায়া ট্যাংকার ব্যবস্থার বড় ব্যবহারকারী। বিশেষ করে তাদের তেলের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বিস্তৃত ও কঠোর হলেই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে। এই জাহাজগুলোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বিক্রি করা সম্ভব হয়, ফলে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে ইউরোপে রাশিয়ার এলএনজি রপ্তানি বন্ধ করা এবং রিফাইনিং ফাঁকফোকর বন্ধ করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিআরইএর রঘুনন্দনের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে রাশিয়ার এলএনজি আমদানি বন্ধ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তিনি বিবিসিকে বলেন, রাশিয়ার এলএনজির ৫০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, অথচ ২০২৪ সালে ইউরোপের মোট এলএনজি চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। কাজেই ইউরোপ যদি রাশিয়ার গ্যাস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে রাশিয়ার ওপর আঘাতটা হবে অনেক বেশি। অন্যদিকে ইউরোপের ওপর এর প্রভাব হবে খুবই কম।
ট্রাম্পের তেলের দাম কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়
ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তেলের দাম কমানো উচিত—ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার সাবেক উপজ্বালানিমন্ত্রী ভ্লাদিমির মিলভ বলেন, ট্রাম্পের কথা শুনে মস্কোর মানুষ হাসছে, কারণ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকার শেল অয়েল শিল্প—যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও প্রতিযোগিতাহীন তেল উৎপাদন খাত।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের খরচ এমনকি সৌদি আরবের মতো ওপেকভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও কম। ফলে তেলের দাম কমলে রাশিয়ার আগে ওপেক দেশগুলোরই বড় ক্ষতি হবে। আর সৌদি আরব এটা কোনোভাবেই মানবে না। অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার কাছ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি কেনার মধ্যে নৈতিক ও বাস্তব সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছি যেখানে একদিকে যেই যুদ্ধের নিন্দা জানাচ্ছি, সেই যুদ্ধের আগ্রাসনকারীকে অর্থ দিচ্ছি, আবার সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পক্ষকেও সহায়তা করছি।’
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া যে পরিমাণ অর্থ আয় করেছে, তা এই তিন বছরে দেশগুলোর কাছ থেকে ইউক্রেনের পাওয়া সহায়তার তিন গুণ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই তথ্য।
পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে এখনো বিলিয়ন ডলার আয় করছে মস্কো।
কত আয় করছে রাশিয়া?
রাশিয়ার মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশই আসে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনের মিত্ররা রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করলেও গ্যাস আমদানি অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৯ মে পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া প্রায় ৮৮৩ বিলিয়ন ইউরো আয় করেছে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলো থেকেই এসেছে ২২৮ বিলিয়ন ইউরো।
এই বিপুল অর্থের সিংহভাগ—প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ইউরো—এসেছে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউক্রেন রাশিয়ার গ্যাস পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছিল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউক্রেন ট্রানজিট বিচ্ছিন্ন করার পর তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি। হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া তুরস্ক হয়ে এখনো রাশিয়ার পাইপলাইনে গ্যাস পাচ্ছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এই রুটে গ্যাস আমদানির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে।
সিআরইএর তথ্য আরও বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০২৪ সালে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আয় আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ কমেছে, আর রপ্তানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি থেকে রাশিয়ার আয় বরং ৬ শতাংশ বেড়েছে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ।
রাশিয়ার নিজস্ব হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিও রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার রপ্তানি করা এলএনজির অর্ধেকই যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর এখনো ‘সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হয়নি, কারণ কিছু সদস্য দেশ আশঙ্কা করছে, এতে সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে এবং স্বল্প মেয়াদে রাশিয়ার জ্বালানি কিনতে খরচও কম পড়ে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদিত ১৭তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে এলএনজি আমদানি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে সব ধরনের গ্যাস আমদানি বন্ধ করার একটি রোডম্যাপ নিয়েছে ইইউ।
তথ্য বলছে, রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করে যত অর্থ আয় করেছে, তা ইউক্রেনের মিত্ররা দেশটিকে যত সহায়তা দিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশিই।
জ্বালানি চাহিদাই যুদ্ধে রাশিয়ার অর্থায়নের সক্ষমতা কমানোর প্রচেষ্টায় পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেশার গ্রুপ গ্লোবাল উইটনেসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাই রোসনার বিবিসিকে বলেন, অনেক পশ্চিমা নীতিনির্ধারক আশঙ্কা করছেন, রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিলে জ্বালানির মূল্য অনেক বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিক্রি সীমিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সরকারেরই আন্তরিক ইচ্ছা নেই। কারণ, বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে শঙ্কিত। একটা সীমা টেনে রাখা হয়েছে—যেখানে বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে আর কেউ তেমন পদক্ষেপ নিতে চায় না।
পরিশোধনে ফাঁকফোকর
সরাসরি তেল বিক্রির পাশাপাশি তেল রপ্তানির আরও এক পরোক্ষ উপায় ব্যবহার করছে রাশিয়া—যেটি ‘রিফাইনিং লুপহোল’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল তৃতীয় কোনো দেশে পরিশোধন হয়ে জ্বালানি পণ্যে পরিণত হয়। এরপর তা নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। কখনো কখনো রাশিয়ার তেল অন্য দেশ থেকে আনা অপরিশোধিত তেলের সঙ্গে মিশিয়েও বাজারজাত করা হয়।
সিআরইএ জানিয়েছে, তারা তুরস্ক ও ভারতে তিনটি করে ‘লন্ড্রোম্যাট’ রিফাইনারির সন্ধান পেয়েছে, যেগুলো রাশিয়ার তেল পরিশোধন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলোতে রপ্তানি করছে। এই পরিশোধনাগারগুলো রাশিয়ার প্রায় ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের অপরিশোধিত তেল ব্যবহার করেছে।
ভারতের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় সিআরইএর এই প্রতিবেদনকে ‘ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, ‘এই দেশগুলো জানে যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলো এই কৌশলকে প্রশ্রয় নিচ্ছে। এটা একধরনের ফাঁকফোকর। বৈধভাবে সবকিছু হচ্ছে। সবাই জানে ব্যাপারটা, কিন্তু কার্যকরভাবে এটি ঠেকাতে কেউ বিশেষ কিছু করছে না।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাস থেকে রাজস্বপ্রবাহ বন্ধ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে যথেষ্ট উপায় ও সক্ষমতা রয়েছে। রাশিয়ার সাবেক জ্বালানি উপমন্ত্রী ও বর্তমানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠোর সমালোচক ভ্লাদিমির মিলভ মনে করেন, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞাগুলো রয়েছে—বিশেষ করে জি৭ গোষ্ঠী যে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে—তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক রদবদলের কারণে দেশটির ট্রেজারি বিভাগের মতো সংস্থাগুলোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার সক্ষমতা ব্যাহত হয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাশিয়ার ‘ছায়া ট্যাংকার বহর’। এগুলো নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করছে। মিলভ বলেন, এটি একধরনের জটিল অপারেশন। এখানে কয়েক সপ্তাহ পরপর নতুন করে কিছু জাহাজ, শেল কোম্পানি, ব্যবসায়ী, বিমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়।
তবে তিনি বলেন, এই খাতে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা বেশি সক্রিয় হয়েছে—বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যে নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো দিয়েছে, তা এই কৌশলকে উৎসাহিত করেছে।
উল্লেখ্য, ‘ছায়া ট্যাংকার’ বলতে এমন তেলবাহী জাহাজগুলোকে বোঝায়, যেগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করে। এই ধরনের জাহাজ সাধারণত তাদের অবস্থান শনাক্তে ডেটা সরবরাহকারী ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখে এবং কখনো কখনো বিভিন্ন দেশের পতাকা বদল করে বা ভুয়া মালিকানায় চলে। ফলে এগুলোকে শনাক্ত করা কঠিন হয়। এই কৌশলে সাগরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে তেল স্থানান্তর করার মাধ্যমে তেলের উৎস বা গন্তব্য গোপন রাখা হয়।
এ ছাড়া অনেক সময় শেল কোম্পানি বা ভুয়া নামধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এসব জাহাজ। রাশিয়া ও ইরান এই ছায়া ট্যাংকার ব্যবস্থার বড় ব্যবহারকারী। বিশেষ করে তাদের তেলের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বিস্তৃত ও কঠোর হলেই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে। এই জাহাজগুলোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বিক্রি করা সম্ভব হয়, ফলে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে ইউরোপে রাশিয়ার এলএনজি রপ্তানি বন্ধ করা এবং রিফাইনিং ফাঁকফোকর বন্ধ করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিআরইএর রঘুনন্দনের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে রাশিয়ার এলএনজি আমদানি বন্ধ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তিনি বিবিসিকে বলেন, রাশিয়ার এলএনজির ৫০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, অথচ ২০২৪ সালে ইউরোপের মোট এলএনজি চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। কাজেই ইউরোপ যদি রাশিয়ার গ্যাস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে রাশিয়ার ওপর আঘাতটা হবে অনেক বেশি। অন্যদিকে ইউরোপের ওপর এর প্রভাব হবে খুবই কম।
ট্রাম্পের তেলের দাম কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়
ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তেলের দাম কমানো উচিত—ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার সাবেক উপজ্বালানিমন্ত্রী ভ্লাদিমির মিলভ বলেন, ট্রাম্পের কথা শুনে মস্কোর মানুষ হাসছে, কারণ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকার শেল অয়েল শিল্প—যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও প্রতিযোগিতাহীন তেল উৎপাদন খাত।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের খরচ এমনকি সৌদি আরবের মতো ওপেকভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও কম। ফলে তেলের দাম কমলে রাশিয়ার আগে ওপেক দেশগুলোরই বড় ক্ষতি হবে। আর সৌদি আরব এটা কোনোভাবেই মানবে না। অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার কাছ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি কেনার মধ্যে নৈতিক ও বাস্তব সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছি যেখানে একদিকে যেই যুদ্ধের নিন্দা জানাচ্ছি, সেই যুদ্ধের আগ্রাসনকারীকে অর্থ দিচ্ছি, আবার সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পক্ষকেও সহায়তা করছি।’

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া যে পরিমাণ অর্থ আয় করেছে, তা এই তিন বছরে দেশগুলোর কাছ থেকে ইউক্রেনের পাওয়া সহায়তার তিন গুণ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই তথ্য।
পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে এখনো বিলিয়ন ডলার আয় করছে মস্কো।
কত আয় করছে রাশিয়া?
রাশিয়ার মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশই আসে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনের মিত্ররা রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করলেও গ্যাস আমদানি অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৯ মে পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া প্রায় ৮৮৩ বিলিয়ন ইউরো আয় করেছে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলো থেকেই এসেছে ২২৮ বিলিয়ন ইউরো।
এই বিপুল অর্থের সিংহভাগ—প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ইউরো—এসেছে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউক্রেন রাশিয়ার গ্যাস পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছিল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউক্রেন ট্রানজিট বিচ্ছিন্ন করার পর তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি। হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া তুরস্ক হয়ে এখনো রাশিয়ার পাইপলাইনে গ্যাস পাচ্ছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এই রুটে গ্যাস আমদানির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে।
সিআরইএর তথ্য আরও বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০২৪ সালে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আয় আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ কমেছে, আর রপ্তানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি থেকে রাশিয়ার আয় বরং ৬ শতাংশ বেড়েছে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ।
রাশিয়ার নিজস্ব হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিও রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিআরইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার রপ্তানি করা এলএনজির অর্ধেকই যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর এখনো ‘সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হয়নি, কারণ কিছু সদস্য দেশ আশঙ্কা করছে, এতে সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে এবং স্বল্প মেয়াদে রাশিয়ার জ্বালানি কিনতে খরচও কম পড়ে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদিত ১৭তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে এলএনজি আমদানি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে সব ধরনের গ্যাস আমদানি বন্ধ করার একটি রোডম্যাপ নিয়েছে ইইউ।
তথ্য বলছে, রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করে যত অর্থ আয় করেছে, তা ইউক্রেনের মিত্ররা দেশটিকে যত সহায়তা দিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশিই।
জ্বালানি চাহিদাই যুদ্ধে রাশিয়ার অর্থায়নের সক্ষমতা কমানোর প্রচেষ্টায় পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেশার গ্রুপ গ্লোবাল উইটনেসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাই রোসনার বিবিসিকে বলেন, অনেক পশ্চিমা নীতিনির্ধারক আশঙ্কা করছেন, রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিলে জ্বালানির মূল্য অনেক বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিক্রি সীমিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সরকারেরই আন্তরিক ইচ্ছা নেই। কারণ, বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে তাঁরা ভীষণভাবে শঙ্কিত। একটা সীমা টেনে রাখা হয়েছে—যেখানে বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে আর কেউ তেমন পদক্ষেপ নিতে চায় না।
পরিশোধনে ফাঁকফোকর
সরাসরি তেল বিক্রির পাশাপাশি তেল রপ্তানির আরও এক পরোক্ষ উপায় ব্যবহার করছে রাশিয়া—যেটি ‘রিফাইনিং লুপহোল’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল তৃতীয় কোনো দেশে পরিশোধন হয়ে জ্বালানি পণ্যে পরিণত হয়। এরপর তা নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। কখনো কখনো রাশিয়ার তেল অন্য দেশ থেকে আনা অপরিশোধিত তেলের সঙ্গে মিশিয়েও বাজারজাত করা হয়।
সিআরইএ জানিয়েছে, তারা তুরস্ক ও ভারতে তিনটি করে ‘লন্ড্রোম্যাট’ রিফাইনারির সন্ধান পেয়েছে, যেগুলো রাশিয়ার তেল পরিশোধন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলোতে রপ্তানি করছে। এই পরিশোধনাগারগুলো রাশিয়ার প্রায় ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের অপরিশোধিত তেল ব্যবহার করেছে।
ভারতের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় সিআরইএর এই প্রতিবেদনকে ‘ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, ‘এই দেশগুলো জানে যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলো এই কৌশলকে প্রশ্রয় নিচ্ছে। এটা একধরনের ফাঁকফোকর। বৈধভাবে সবকিছু হচ্ছে। সবাই জানে ব্যাপারটা, কিন্তু কার্যকরভাবে এটি ঠেকাতে কেউ বিশেষ কিছু করছে না।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার তেল ও গ্যাস থেকে রাজস্বপ্রবাহ বন্ধ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে যথেষ্ট উপায় ও সক্ষমতা রয়েছে। রাশিয়ার সাবেক জ্বালানি উপমন্ত্রী ও বর্তমানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠোর সমালোচক ভ্লাদিমির মিলভ মনে করেন, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞাগুলো রয়েছে—বিশেষ করে জি৭ গোষ্ঠী যে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে—তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক রদবদলের কারণে দেশটির ট্রেজারি বিভাগের মতো সংস্থাগুলোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার সক্ষমতা ব্যাহত হয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাশিয়ার ‘ছায়া ট্যাংকার বহর’। এগুলো নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করছে। মিলভ বলেন, এটি একধরনের জটিল অপারেশন। এখানে কয়েক সপ্তাহ পরপর নতুন করে কিছু জাহাজ, শেল কোম্পানি, ব্যবসায়ী, বিমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়।
তবে তিনি বলেন, এই খাতে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা বেশি সক্রিয় হয়েছে—বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যে নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো দিয়েছে, তা এই কৌশলকে উৎসাহিত করেছে।
উল্লেখ্য, ‘ছায়া ট্যাংকার’ বলতে এমন তেলবাহী জাহাজগুলোকে বোঝায়, যেগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহন করে। এই ধরনের জাহাজ সাধারণত তাদের অবস্থান শনাক্তে ডেটা সরবরাহকারী ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখে এবং কখনো কখনো বিভিন্ন দেশের পতাকা বদল করে বা ভুয়া মালিকানায় চলে। ফলে এগুলোকে শনাক্ত করা কঠিন হয়। এই কৌশলে সাগরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে তেল স্থানান্তর করার মাধ্যমে তেলের উৎস বা গন্তব্য গোপন রাখা হয়।
এ ছাড়া অনেক সময় শেল কোম্পানি বা ভুয়া নামধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এসব জাহাজ। রাশিয়া ও ইরান এই ছায়া ট্যাংকার ব্যবস্থার বড় ব্যবহারকারী। বিশেষ করে তাদের তেলের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বিস্তৃত ও কঠোর হলেই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে। এই জাহাজগুলোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বিক্রি করা সম্ভব হয়, ফলে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে ইউরোপে রাশিয়ার এলএনজি রপ্তানি বন্ধ করা এবং রিফাইনিং ফাঁকফোকর বন্ধ করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিআরইএর রঘুনন্দনের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে রাশিয়ার এলএনজি আমদানি বন্ধ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তিনি বিবিসিকে বলেন, রাশিয়ার এলএনজির ৫০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, অথচ ২০২৪ সালে ইউরোপের মোট এলএনজি চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। কাজেই ইউরোপ যদি রাশিয়ার গ্যাস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে রাশিয়ার ওপর আঘাতটা হবে অনেক বেশি। অন্যদিকে ইউরোপের ওপর এর প্রভাব হবে খুবই কম।
ট্রাম্পের তেলের দাম কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়
ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তেলের দাম কমানো উচিত—ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার সাবেক উপজ্বালানিমন্ত্রী ভ্লাদিমির মিলভ বলেন, ট্রাম্পের কথা শুনে মস্কোর মানুষ হাসছে, কারণ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকার শেল অয়েল শিল্প—যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও প্রতিযোগিতাহীন তেল উৎপাদন খাত।
সিআরইএর বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন বলেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের খরচ এমনকি সৌদি আরবের মতো ওপেকভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও কম। ফলে তেলের দাম কমলে রাশিয়ার আগে ওপেক দেশগুলোরই বড় ক্ষতি হবে। আর সৌদি আরব এটা কোনোভাবেই মানবে না। অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
গ্লোবাল উইটনেসের মাই রোসনার বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার কাছ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি কেনার মধ্যে নৈতিক ও বাস্তব সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছি যেখানে একদিকে যেই যুদ্ধের নিন্দা জানাচ্ছি, সেই যুদ্ধের আগ্রাসনকারীকে অর্থ দিচ্ছি, আবার সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পক্ষকেও সহায়তা করছি।’

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
২ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
১ দিন আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
১ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
ভারতের বিহার রাজ্যে ভোটার তালিকা যাচাইয়ের বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য—প্রতিটি নিবন্ধিত ভোটারের পরিচয় যাচাই করা এবং রাজ্যের বাইরে থাকা ও মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ক্লেরেন্স টপ্পো এই যাচাই অভিযানের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে কেউ কোনো নথি দেখতে আসেনি, নাগরিকদেরও কেউ নিজ গরজে কাগজপত্র জমা দিতে যায়নি।
টপ্পোর জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি জানতে পারেন, যে বিহারে যিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানেই নাকি তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, নথিপত্র দেখাচ্ছে তিনি নাকি রাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। তাঁর দুই ভাইয়ের নামও অনুপস্থিতদের তালিকায়। অথচ, তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল একজন অন্য রাজ্যে গেছেন। টপ্পো বলেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি ভারতে থাকার পরও যদি আমার ভোটার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়—তাহলে সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার।’
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনেক সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, টপ্পো এই ধর্মের মানুষ। পাশাপাশি তিনি দলিত, অর্থাৎ ভারতের বর্ণ প্রথায় ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছে—এমনটা ভেবে টপ্পো চেয়েছিলেন নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিতে’। কিন্তু পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শোনার পর তাঁর সেই আশাও শেষ! টপ্পো বলেন, ‘ভোট আমাদের দেশের লাগাম ধরার অধিকার। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’
বিহারে চলমান ভোটার যাচাই প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ কার্যত ভোটাধিকার হারিয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেওয়ার নতুন কৌশল। বিহারের প্রায় ৬৮ লাখ ভোটারের নাম, অর্থাৎ মোট ৭ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ, এই যাচাই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে— স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। এই প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। রায় এলে নতুন ভোটার তালিকা বাতিলও হতে পারে।
এসআইআর-এর প্রথম ধাপে নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) কর্মীদের এক মাসের মধ্যে বিহারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহ করে একটি খসড়া তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় এবং হয়ওনি। বিহার পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) সাধারণ সম্পাদক সরফরাজ উদ্দিন বলেন, ‘এক মাসে প্রতিটি ঘরে যাওয়া, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করা, ফরম নেওয়া এবং নথি সংযুক্ত করা—একেবারেই অসম্ভব।’
সরফরাজ জানান, ২০০৩ সালে এসআইআর সম্পূর্ণ করতে এক বছর লেগেছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তবু প্রত্যেককে এক মাসে প্রায় ৯০০ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই শর্টকাটে কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মাঠকর্মীরা কাউকে খুঁজে পেতেন না, তখন নিজেরাই ফরম পূরণ করে সেখানে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন। ফলে অনেক প্রকৃত ভোটার বাদ পড়েছেন, আবার যারা বিহারে নেই তাদের অনেকের নাম তালিকায় থেকে গেছে।’
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া কেবল অসতর্কতার ফল নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। দিল্লির আইনজীবী ও এই প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘যদি তারা সচেতনভাবে সেই সব মানুষকে ভোটের বাইরে রাখে, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দেয় না, তাহলে এর প্রভাব বিশাল হবে। সাধারণত নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোটে।’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমনমূলক নীতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আর খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝাড়খণ্ডের আলাদা হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্য হয়। বিহারকে বলা হয় জাতপাতভিত্তিক অস্থির রাজনীতির এক ফুটন্ত কড়াই। একই নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করছেন—একবার এই জোটে, আরেকবার প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে যোগ দিয়ে। বিহারের সংবাদমাধ্যম ডেমোক্রেটিক চরখার সম্পাদক আমির আব্বাস বলেন, এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো বিহারকে বলা হয় ‘ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগার’।
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়লেও ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজ্য হিসেবে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজন করে বিহার। ফলে রাজনীতিকেরা দেশজুড়ে তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও মুখে মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মেনেই বিশাল জনসভা করেন। দুই বছর পর, বিহার আবারও প্রথম রাজ্য হিসেবে জনগণনার সময় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এই তথ্য পরে সর্বভারতীয় জনগণনায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আমির আব্বাসের আশঙ্কা, এবার যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ভোটারদের বঞ্চিত করার এক নতুন পরীক্ষা। সমালোচকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে—যাঁরা সাধারণত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী জোটকে সমর্থন করেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১ ধরনের কাগজপত্রের যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বিহারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা, সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত পরিচয়পত্র আধার কার্ড ওই তালিকায় ছিল না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, বরং যে নথিগুলো এসআইআর প্রক্রিয়ায় চাওয়া হয়েছিল—যেমন দশম শ্রেণির ভর্তি ফর্ম বা জমির দলিল—সেগুলো রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছেই নেই।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এসআইআর–এর দ্বিতীয় ধাপে, যাঁরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা আপত্তি জানিয়ে পুনরায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০ শতাংশ। ফলে অনেকে নিজের নাম বাদ পড়েছে কিনা, সেটিই যাচাই করতে পারেননি। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ পায় আরও দুই সপ্তাহ পর—১৭ আগস্ট।
এই খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটনার মুসলিম অধ্যুষিত ফুলওয়ারি শরিফ এলাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে লোকজনকে জানান দিচ্ছিলেন সমাজকর্মী জাহিব আজমল। তিনি তাঁদের জানাচ্ছিলেন—তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। আজমল বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন, ‘আমরা তো জানিই না কীভাবে তালিকা দেখতে হয়। আমাদের নাম কখনো বাদ পড়েনি। তাহলে কেন বাদ যাবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
সরকারি এই এসআইআর তালিকায় অস্পষ্ট ঠিকানা আর ভুল তথ্যের কারণে কর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আজমল বলেন, ‘তথ্য এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না। কোনো একটি এলাকায় যদি আপনার কেউ পরিচিত না থাকে তাহলে সেখানে কেবল তালিকা ধরে কাউকে খুঁজে পাবেন না।’
প্রথম ধাপের নির্বাচনী নিবন্ধন যাচাই (এসআইআর) শেষে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ভোটার নিবন্ধন করেন। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই নতুন ভোটার। তারা আগের তালিকায় ছিলেন না। অন্যদিকে, শুধু বিহারেই প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নির্দেশনাও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রশান্ত ভূষণ। তাঁর অভিযোগ, কমিশন ‘আসলে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা যদি ইচ্ছা করে সংখ্যালঘু ও দলিতদের মতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে, আর এমন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—যারা বিজেপিকে ভোট দেয়, তাহলে তারা অবশ্যই সেটা করবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী টপ্পো মনে করেন, তাঁর পরিবারের দ্বৈত সংখ্যালঘু পরিচয়ই (দলিত ও খ্রিষ্টান) হয়তো তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘একে আমি তফসিলি জাতির মানুষ, আবার খ্রিষ্টানও। এ কারণে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ অবশ্য পরে, স্থানীয় এক সাংবাদিক টপ্পোর ঘটনা প্রকাশ করার পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা এসে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের নাম পুনরায় নিবন্ধন করেন।
ভোটার যাচাই অভিযানের প্রভাব শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহারের এই যাচাই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মোদি সরকার এমন এক উদ্যোগ চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে বৈধ কাগজপত্রবিহীন মুসলমানদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিহারেও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এই যাচাই প্রক্রিয়া অবৈধ বিদেশিদের ভোট দেওয়া ঠেকাবে।
তবে বিরোধী দল ও অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, ভবিষ্যতে তাদের একইভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) মুখপাত্র কুমার পারভেজ বলেন, ‘যদি তাদের নাম ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে আগামী দিনে তারা নাগরিক হিসেবেও থাকবেন না।’
ভোটার নিবন্ধনকে নাগরিকত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা মোদির বিজেপির এক পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯ সাল থেকে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সারা দেশে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান চালাবে। এখন পর্যন্ত একমাত্র যে রাজ্যে যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দেখাতে হয়েছিল—১৯৭১ সালের আগে পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ভোটার তালিকায় ছিল কি না।
বিহারের অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা তাদের পরিবারের নাগরিকত্বই বিপন্ন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী কৃষ্ণ দয়াল সিংকে টপ্পোর মায়ের মতো ‘মেরে ফেলেছিল’ ভারত সরকার। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার সন্তানেরা হয়তো এমন প্রশ্নের মুখে পড়বে যে, “তোমার দাদু তো ভোটার ছিলেন না, নাগরিকও ছিলেন না, তাহলে তুমি এ দেশে এলে কীভাবে?”’
দয়াল সিং জানান, তাঁর অবশ্য কপাল ভালো। কারণ, প্রথম ধাপের এসআইআর–এ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটার হিসেবে পুনর্নিবন্ধনের আবেদন করান।
অনেকের কাছে এই ভোটার নিবন্ধন লাইফলাইন বা জীবনরেখার মতো। ৯২ বছর বয়সী জিতনি দেবী তাঁর মাসিক সরকারি পেনশন ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে খাবার এবং ওষুধের খরচ চালাতেন। এসআইআর চলাকালে, দেবীর পরিবারের ৭ জনের মধ্যে মাত্র দুজন তাদের গণনা ফর্ম জমা দিয়েছিলেন। নিরক্ষর জিতনি দেবী প্রথমে এই প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেননি। অবশ্য দেওয়ার কোনো কারণও ছিল না। কারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে আলমপুরে গ্রামে যাননি।
কিন্তু আগস্টে দেবী ব্যাংকে পেনশন নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, তিনি আর নিবন্ধিত নন। যেহেতু নিবন্ধন নেই, তাই তাঁর পেনশনও নেই। পরে, স্থানীয় এনজিও মানথনের এক কর্মী তাঁকে জানান যে, এসআইআর–এ তাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে।
জিতনি দেবী বলেন, ‘আমি জানি না আমি কী করব। আমি জানি না, সরকারই বা আমার সঙ্গে কী করবে। আমি জানি না আমি কীভাবে বাঁচব।’
এসআইআর-এর প্রভাব কতটা, তার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পেতে মাস কয়েক লাগবে। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অক্টোবর পর্যন্ত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চালিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত এসআইআর-এর ফলাফল বাতিল করতে পারে। ফলে বিহার রাজ্যে বিজেপি কি শাসক জোটের নেতৃত্বে থাকবে না কি থাকবে না—তা ১৪ নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে।
কিন্তু যা কিছু বিহারে ঘটছে, শিগগিরই দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে। রাজ্যের ভোটার যাচাই অভিযান শেষের পথে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্য-স্তরের সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সারা দেশে এসআইআর-এর প্রস্তুতি নিতে। গত ২৭ অক্টোবর আরও ১২টি অতিরিক্ত রাজ্য ও অঞ্চলে এসআইআর শুরু হয়েছে। এসব রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি ভোটার আছে।
১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব যাচাই করার বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ৯ কোটি ভারতীয় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। আর এ কারণেই মূলত বিহারের ঘটনা জাতীয় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত আগস্টে বিরোধীদলীয় সাংসদ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিহারে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর নেতারাও সেখানে অংশ নেন।
বিহারের ভোটার যাচাই অভিযান এখন নাগরিক সমাজ কর্মী ও বিরোধীদলীয় দলগুলোর চোখে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈধতা রক্ষার নতুন সংগ্রাম। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের ভাইস–প্রেসিডেন্ট পুষ্পেন্দ্র বলেন, ‘এখন এটা একজাতীয় অভিযান। এই এসআইআর অন্য রাজ্যেও যাচ্ছে এবং তারা (বিরোধী দল) জানে যে, তাদের এমন ক্যাম্পেইন গড়ে তুলতে হবে যাতে এই প্রক্রিয়াকে পরাস্ত করা যায়।’
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
ভারতের বিহার রাজ্যে ভোটার তালিকা যাচাইয়ের বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য—প্রতিটি নিবন্ধিত ভোটারের পরিচয় যাচাই করা এবং রাজ্যের বাইরে থাকা ও মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ক্লেরেন্স টপ্পো এই যাচাই অভিযানের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে কেউ কোনো নথি দেখতে আসেনি, নাগরিকদেরও কেউ নিজ গরজে কাগজপত্র জমা দিতে যায়নি।
টপ্পোর জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি জানতে পারেন, যে বিহারে যিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানেই নাকি তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, নথিপত্র দেখাচ্ছে তিনি নাকি রাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। তাঁর দুই ভাইয়ের নামও অনুপস্থিতদের তালিকায়। অথচ, তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল একজন অন্য রাজ্যে গেছেন। টপ্পো বলেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি ভারতে থাকার পরও যদি আমার ভোটার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়—তাহলে সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার।’
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনেক সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, টপ্পো এই ধর্মের মানুষ। পাশাপাশি তিনি দলিত, অর্থাৎ ভারতের বর্ণ প্রথায় ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছে—এমনটা ভেবে টপ্পো চেয়েছিলেন নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিতে’। কিন্তু পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শোনার পর তাঁর সেই আশাও শেষ! টপ্পো বলেন, ‘ভোট আমাদের দেশের লাগাম ধরার অধিকার। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’
বিহারে চলমান ভোটার যাচাই প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ কার্যত ভোটাধিকার হারিয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেওয়ার নতুন কৌশল। বিহারের প্রায় ৬৮ লাখ ভোটারের নাম, অর্থাৎ মোট ৭ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ, এই যাচাই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে— স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। এই প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। রায় এলে নতুন ভোটার তালিকা বাতিলও হতে পারে।
এসআইআর-এর প্রথম ধাপে নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) কর্মীদের এক মাসের মধ্যে বিহারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহ করে একটি খসড়া তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় এবং হয়ওনি। বিহার পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) সাধারণ সম্পাদক সরফরাজ উদ্দিন বলেন, ‘এক মাসে প্রতিটি ঘরে যাওয়া, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করা, ফরম নেওয়া এবং নথি সংযুক্ত করা—একেবারেই অসম্ভব।’
সরফরাজ জানান, ২০০৩ সালে এসআইআর সম্পূর্ণ করতে এক বছর লেগেছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তবু প্রত্যেককে এক মাসে প্রায় ৯০০ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই শর্টকাটে কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মাঠকর্মীরা কাউকে খুঁজে পেতেন না, তখন নিজেরাই ফরম পূরণ করে সেখানে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন। ফলে অনেক প্রকৃত ভোটার বাদ পড়েছেন, আবার যারা বিহারে নেই তাদের অনেকের নাম তালিকায় থেকে গেছে।’
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া কেবল অসতর্কতার ফল নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। দিল্লির আইনজীবী ও এই প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘যদি তারা সচেতনভাবে সেই সব মানুষকে ভোটের বাইরে রাখে, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দেয় না, তাহলে এর প্রভাব বিশাল হবে। সাধারণত নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোটে।’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমনমূলক নীতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আর খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝাড়খণ্ডের আলাদা হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্য হয়। বিহারকে বলা হয় জাতপাতভিত্তিক অস্থির রাজনীতির এক ফুটন্ত কড়াই। একই নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করছেন—একবার এই জোটে, আরেকবার প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে যোগ দিয়ে। বিহারের সংবাদমাধ্যম ডেমোক্রেটিক চরখার সম্পাদক আমির আব্বাস বলেন, এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো বিহারকে বলা হয় ‘ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগার’।
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়লেও ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজ্য হিসেবে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজন করে বিহার। ফলে রাজনীতিকেরা দেশজুড়ে তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও মুখে মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মেনেই বিশাল জনসভা করেন। দুই বছর পর, বিহার আবারও প্রথম রাজ্য হিসেবে জনগণনার সময় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এই তথ্য পরে সর্বভারতীয় জনগণনায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আমির আব্বাসের আশঙ্কা, এবার যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ভোটারদের বঞ্চিত করার এক নতুন পরীক্ষা। সমালোচকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে—যাঁরা সাধারণত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী জোটকে সমর্থন করেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১ ধরনের কাগজপত্রের যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বিহারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা, সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত পরিচয়পত্র আধার কার্ড ওই তালিকায় ছিল না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, বরং যে নথিগুলো এসআইআর প্রক্রিয়ায় চাওয়া হয়েছিল—যেমন দশম শ্রেণির ভর্তি ফর্ম বা জমির দলিল—সেগুলো রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছেই নেই।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এসআইআর–এর দ্বিতীয় ধাপে, যাঁরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা আপত্তি জানিয়ে পুনরায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০ শতাংশ। ফলে অনেকে নিজের নাম বাদ পড়েছে কিনা, সেটিই যাচাই করতে পারেননি। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ পায় আরও দুই সপ্তাহ পর—১৭ আগস্ট।
এই খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটনার মুসলিম অধ্যুষিত ফুলওয়ারি শরিফ এলাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে লোকজনকে জানান দিচ্ছিলেন সমাজকর্মী জাহিব আজমল। তিনি তাঁদের জানাচ্ছিলেন—তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। আজমল বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন, ‘আমরা তো জানিই না কীভাবে তালিকা দেখতে হয়। আমাদের নাম কখনো বাদ পড়েনি। তাহলে কেন বাদ যাবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
সরকারি এই এসআইআর তালিকায় অস্পষ্ট ঠিকানা আর ভুল তথ্যের কারণে কর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আজমল বলেন, ‘তথ্য এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না। কোনো একটি এলাকায় যদি আপনার কেউ পরিচিত না থাকে তাহলে সেখানে কেবল তালিকা ধরে কাউকে খুঁজে পাবেন না।’
প্রথম ধাপের নির্বাচনী নিবন্ধন যাচাই (এসআইআর) শেষে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ভোটার নিবন্ধন করেন। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই নতুন ভোটার। তারা আগের তালিকায় ছিলেন না। অন্যদিকে, শুধু বিহারেই প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নির্দেশনাও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রশান্ত ভূষণ। তাঁর অভিযোগ, কমিশন ‘আসলে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা যদি ইচ্ছা করে সংখ্যালঘু ও দলিতদের মতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে, আর এমন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—যারা বিজেপিকে ভোট দেয়, তাহলে তারা অবশ্যই সেটা করবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী টপ্পো মনে করেন, তাঁর পরিবারের দ্বৈত সংখ্যালঘু পরিচয়ই (দলিত ও খ্রিষ্টান) হয়তো তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘একে আমি তফসিলি জাতির মানুষ, আবার খ্রিষ্টানও। এ কারণে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ অবশ্য পরে, স্থানীয় এক সাংবাদিক টপ্পোর ঘটনা প্রকাশ করার পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা এসে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের নাম পুনরায় নিবন্ধন করেন।
ভোটার যাচাই অভিযানের প্রভাব শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহারের এই যাচাই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মোদি সরকার এমন এক উদ্যোগ চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে বৈধ কাগজপত্রবিহীন মুসলমানদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিহারেও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এই যাচাই প্রক্রিয়া অবৈধ বিদেশিদের ভোট দেওয়া ঠেকাবে।
তবে বিরোধী দল ও অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, ভবিষ্যতে তাদের একইভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) মুখপাত্র কুমার পারভেজ বলেন, ‘যদি তাদের নাম ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে আগামী দিনে তারা নাগরিক হিসেবেও থাকবেন না।’
ভোটার নিবন্ধনকে নাগরিকত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা মোদির বিজেপির এক পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯ সাল থেকে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সারা দেশে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান চালাবে। এখন পর্যন্ত একমাত্র যে রাজ্যে যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দেখাতে হয়েছিল—১৯৭১ সালের আগে পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ভোটার তালিকায় ছিল কি না।
বিহারের অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা তাদের পরিবারের নাগরিকত্বই বিপন্ন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী কৃষ্ণ দয়াল সিংকে টপ্পোর মায়ের মতো ‘মেরে ফেলেছিল’ ভারত সরকার। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার সন্তানেরা হয়তো এমন প্রশ্নের মুখে পড়বে যে, “তোমার দাদু তো ভোটার ছিলেন না, নাগরিকও ছিলেন না, তাহলে তুমি এ দেশে এলে কীভাবে?”’
দয়াল সিং জানান, তাঁর অবশ্য কপাল ভালো। কারণ, প্রথম ধাপের এসআইআর–এ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটার হিসেবে পুনর্নিবন্ধনের আবেদন করান।
অনেকের কাছে এই ভোটার নিবন্ধন লাইফলাইন বা জীবনরেখার মতো। ৯২ বছর বয়সী জিতনি দেবী তাঁর মাসিক সরকারি পেনশন ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে খাবার এবং ওষুধের খরচ চালাতেন। এসআইআর চলাকালে, দেবীর পরিবারের ৭ জনের মধ্যে মাত্র দুজন তাদের গণনা ফর্ম জমা দিয়েছিলেন। নিরক্ষর জিতনি দেবী প্রথমে এই প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেননি। অবশ্য দেওয়ার কোনো কারণও ছিল না। কারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে আলমপুরে গ্রামে যাননি।
কিন্তু আগস্টে দেবী ব্যাংকে পেনশন নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, তিনি আর নিবন্ধিত নন। যেহেতু নিবন্ধন নেই, তাই তাঁর পেনশনও নেই। পরে, স্থানীয় এনজিও মানথনের এক কর্মী তাঁকে জানান যে, এসআইআর–এ তাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে।
জিতনি দেবী বলেন, ‘আমি জানি না আমি কী করব। আমি জানি না, সরকারই বা আমার সঙ্গে কী করবে। আমি জানি না আমি কীভাবে বাঁচব।’
এসআইআর-এর প্রভাব কতটা, তার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পেতে মাস কয়েক লাগবে। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অক্টোবর পর্যন্ত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চালিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত এসআইআর-এর ফলাফল বাতিল করতে পারে। ফলে বিহার রাজ্যে বিজেপি কি শাসক জোটের নেতৃত্বে থাকবে না কি থাকবে না—তা ১৪ নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে।
কিন্তু যা কিছু বিহারে ঘটছে, শিগগিরই দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে। রাজ্যের ভোটার যাচাই অভিযান শেষের পথে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্য-স্তরের সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সারা দেশে এসআইআর-এর প্রস্তুতি নিতে। গত ২৭ অক্টোবর আরও ১২টি অতিরিক্ত রাজ্য ও অঞ্চলে এসআইআর শুরু হয়েছে। এসব রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি ভোটার আছে।
১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব যাচাই করার বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ৯ কোটি ভারতীয় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। আর এ কারণেই মূলত বিহারের ঘটনা জাতীয় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত আগস্টে বিরোধীদলীয় সাংসদ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিহারে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর নেতারাও সেখানে অংশ নেন।
বিহারের ভোটার যাচাই অভিযান এখন নাগরিক সমাজ কর্মী ও বিরোধীদলীয় দলগুলোর চোখে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈধতা রক্ষার নতুন সংগ্রাম। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের ভাইস–প্রেসিডেন্ট পুষ্পেন্দ্র বলেন, ‘এখন এটা একজাতীয় অভিযান। এই এসআইআর অন্য রাজ্যেও যাচ্ছে এবং তারা (বিরোধী দল) জানে যে, তাদের এমন ক্যাম্পেইন গড়ে তুলতে হবে যাতে এই প্রক্রিয়াকে পরাস্ত করা যায়।’
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা...
৩০ মে ২০২৫
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
১ দিন আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
১ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র এই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাদের এই উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাসে নয়, রাজনীতির মানসেও এক ধারণা গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্মগত অধিকারও হতে পারে। এই চিন্তাই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতির প্রতিটি দলে, প্রতিটি প্রদেশে, আর প্রতিটি স্তরে।
কেবল নেহরু–গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধেই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হলেও, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি আসলে ভারতের প্রায় সব দলেই দেখা যায়। জনতা দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় বাবার খালি আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন বাবার নাম অনুসারে ‘বিজু জনতা দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজুর পথ অনুসরণ করে নবীন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করেন।
মহারাষ্ট্রের দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মৃত্যুর আগে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরেও এখন রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। একই ধারা দেখা যায় সমাজবাদী পার্টিতেও। দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবও সেই পদে আসেন। এখন তিনি দলের সভাপতি ও এমপি। বিহারের লোক জনশক্তি পার্টিতেও একই চিত্র। প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসওয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও এই বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। জম্মু–কাশ্মীরে তিন প্রজন্ম ধরে আবদুল্লাহ পরিবার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বিরোধী শিবিরে নেতৃত্বে আছে মুফতি পরিবারের দুই প্রজন্ম। পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন শিরোমণি আকালি দল পরিচালনা করেছেন প্রকাশ সিং বাদল। এখন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল দলের প্রধান। তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই এখন উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবার এখনো ক্ষমতাসীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ছেলে এমকে স্ট্যালিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, আর তাঁর নাতিকে ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এটি শুধু কিছু বিখ্যাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থার গাঁথুনিতেই এই পারিবারিক রাজনীতি বীজ গভীরভাবে বোনা। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার থেকে একাধিক সদস্য রাজ্যের আইনসভায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ও ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীরও পারিবারিক রাজনৈতিক সংযোগ আছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ না কেউ রাজনীতিতে ছিলেন। তরুণ সাংসদদের প্রায় সবাই কোনো আত্মীয়—সাধারণত বাবা বা মা—থেকে আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নারী সাংসদদের ৭০ শতাংশ বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফল। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিকের সরাসরি উত্তরসূরি নেই, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুমারী মায়াবতী, তাঁরাও তাঁদের ভাতিজাদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তুলছেন।
ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি গোটা উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষে পরিবার। তবে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এই প্রবণতা কিছুটা বেমানান বলেই মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন ভারত এত গভীরভাবে এই পারিবারিক রাজনীতি মেনে নিয়েছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—পরিবার একটি কার্যকর রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের মনোযোগ পেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে একসময় গ্রহণ করে থাকেন, তবে তাঁরা সম্ভবত একই পরিবারের নতুন প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এভাবে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় না। ভারতের অতীত প্রেক্ষাপটে, যখন সাক্ষরতার হার ও গণমাধ্যমের প্রভাব কম ছিল, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু সাক্ষরতার হার যখন ৮১ শতাংশের কাছাকাছি এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন বোঝা যায় অন্য আরও কিছু কারণ আছে এর পেছনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো—দলীয় রাজনীতির ভেতরকার চর্চা ও গতিপ্রকৃতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রায় অস্বচ্ছ। প্রায় সব দলেই সিদ্ধান্ত নেয় একদল ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কখনো বা একক কোনো নেতা, যাদের আবার পরিবর্তন আনাতে আগ্রহ কম। ফলে, যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কই সাধারণত বেশি মূল্য পায়।
এ অবস্থায় প্রার্থী হতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নতুনদের জন্য বাধা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলোর হাতে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক পুঁজি, যা তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে জমিয়েছে। তাদের আছে তৈরি নির্বাচনী কাঠামো—দাতা, কর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক। এতে করে নতুন রাজনীতিকদের তুলনায় তাদের সুবিধা অনেক বেশি।
ভারতের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পেছনে সাংস্কৃতিক কারণও আছে। আধুনিকায়নের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজে এখনো জমিদারি মানসিকতা টিকে আছে। আগের দিনে যেভাবে স্থানীয় জমিদার বা রাজাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো, এখন সেই শ্রদ্ধা দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এতে মনে হয় রাজনৈতিক অভিজাতরা যেন অন্য শ্রেণির মানুষ, যাদের পরিবারই ক্ষমতার উপযুক্ত। এই অহংবোধ এতটাই গভীর যে দুর্বল কর্মক্ষমতাও তাদের নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারে না। বারবার নির্বাচনে হারলেও তারা দলীয় নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এ ধরনের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বংশপরম্পরায়, যোগ্যতা, নিষ্ঠা বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদলে, তখন শাসনব্যবস্থার মান নেমে যায়। সীমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া কখনোই সুবিধাজনক নয়। আরও খারাপ হয় যখন প্রার্থীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তার পদবি। এমন নেতারা সাধারণ মানুষের বাস্তব চ্যালেঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে জনগণের প্রয়োজন বুঝে কাজ করার সক্ষমতাও কম থাকে। তবুও তাদের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এখন সময় এসেছে ভারতকে ‘রাজবংশের’ রাজনীতি ছাড়িয়ে যোগ্যতাভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সংস্কার—আইন করে মেয়াদসীমা নির্ধারণ, দলীয় পর্যায়ে প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ভোটারদের সচেতন করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা বাছাইয়ের প্রেরণা জাগানো। যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক থাকবে, তত দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য—‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র এই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাদের এই উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাসে নয়, রাজনীতির মানসেও এক ধারণা গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্মগত অধিকারও হতে পারে। এই চিন্তাই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতির প্রতিটি দলে, প্রতিটি প্রদেশে, আর প্রতিটি স্তরে।
কেবল নেহরু–গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধেই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হলেও, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি আসলে ভারতের প্রায় সব দলেই দেখা যায়। জনতা দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় বাবার খালি আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন বাবার নাম অনুসারে ‘বিজু জনতা দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজুর পথ অনুসরণ করে নবীন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করেন।
মহারাষ্ট্রের দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মৃত্যুর আগে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরেও এখন রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। একই ধারা দেখা যায় সমাজবাদী পার্টিতেও। দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবও সেই পদে আসেন। এখন তিনি দলের সভাপতি ও এমপি। বিহারের লোক জনশক্তি পার্টিতেও একই চিত্র। প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসওয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও এই বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। জম্মু–কাশ্মীরে তিন প্রজন্ম ধরে আবদুল্লাহ পরিবার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বিরোধী শিবিরে নেতৃত্বে আছে মুফতি পরিবারের দুই প্রজন্ম। পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন শিরোমণি আকালি দল পরিচালনা করেছেন প্রকাশ সিং বাদল। এখন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল দলের প্রধান। তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই এখন উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবার এখনো ক্ষমতাসীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ছেলে এমকে স্ট্যালিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, আর তাঁর নাতিকে ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এটি শুধু কিছু বিখ্যাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থার গাঁথুনিতেই এই পারিবারিক রাজনীতি বীজ গভীরভাবে বোনা। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার থেকে একাধিক সদস্য রাজ্যের আইনসভায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ও ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীরও পারিবারিক রাজনৈতিক সংযোগ আছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ না কেউ রাজনীতিতে ছিলেন। তরুণ সাংসদদের প্রায় সবাই কোনো আত্মীয়—সাধারণত বাবা বা মা—থেকে আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নারী সাংসদদের ৭০ শতাংশ বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফল। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিকের সরাসরি উত্তরসূরি নেই, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুমারী মায়াবতী, তাঁরাও তাঁদের ভাতিজাদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তুলছেন।
ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি গোটা উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষে পরিবার। তবে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এই প্রবণতা কিছুটা বেমানান বলেই মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন ভারত এত গভীরভাবে এই পারিবারিক রাজনীতি মেনে নিয়েছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—পরিবার একটি কার্যকর রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের মনোযোগ পেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে একসময় গ্রহণ করে থাকেন, তবে তাঁরা সম্ভবত একই পরিবারের নতুন প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এভাবে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় না। ভারতের অতীত প্রেক্ষাপটে, যখন সাক্ষরতার হার ও গণমাধ্যমের প্রভাব কম ছিল, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু সাক্ষরতার হার যখন ৮১ শতাংশের কাছাকাছি এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন বোঝা যায় অন্য আরও কিছু কারণ আছে এর পেছনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো—দলীয় রাজনীতির ভেতরকার চর্চা ও গতিপ্রকৃতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রায় অস্বচ্ছ। প্রায় সব দলেই সিদ্ধান্ত নেয় একদল ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কখনো বা একক কোনো নেতা, যাদের আবার পরিবর্তন আনাতে আগ্রহ কম। ফলে, যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কই সাধারণত বেশি মূল্য পায়।
এ অবস্থায় প্রার্থী হতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নতুনদের জন্য বাধা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলোর হাতে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক পুঁজি, যা তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে জমিয়েছে। তাদের আছে তৈরি নির্বাচনী কাঠামো—দাতা, কর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক। এতে করে নতুন রাজনীতিকদের তুলনায় তাদের সুবিধা অনেক বেশি।
ভারতের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পেছনে সাংস্কৃতিক কারণও আছে। আধুনিকায়নের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজে এখনো জমিদারি মানসিকতা টিকে আছে। আগের দিনে যেভাবে স্থানীয় জমিদার বা রাজাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো, এখন সেই শ্রদ্ধা দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এতে মনে হয় রাজনৈতিক অভিজাতরা যেন অন্য শ্রেণির মানুষ, যাদের পরিবারই ক্ষমতার উপযুক্ত। এই অহংবোধ এতটাই গভীর যে দুর্বল কর্মক্ষমতাও তাদের নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারে না। বারবার নির্বাচনে হারলেও তারা দলীয় নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এ ধরনের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বংশপরম্পরায়, যোগ্যতা, নিষ্ঠা বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদলে, তখন শাসনব্যবস্থার মান নেমে যায়। সীমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া কখনোই সুবিধাজনক নয়। আরও খারাপ হয় যখন প্রার্থীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তার পদবি। এমন নেতারা সাধারণ মানুষের বাস্তব চ্যালেঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে জনগণের প্রয়োজন বুঝে কাজ করার সক্ষমতাও কম থাকে। তবুও তাদের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এখন সময় এসেছে ভারতকে ‘রাজবংশের’ রাজনীতি ছাড়িয়ে যোগ্যতাভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সংস্কার—আইন করে মেয়াদসীমা নির্ধারণ, দলীয় পর্যায়ে প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ভোটারদের সচেতন করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা বাছাইয়ের প্রেরণা জাগানো। যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক থাকবে, তত দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য—‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা...
৩০ মে ২০২৫
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
২ ঘণ্টা আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
১ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো সুদানি আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সমর্থন দিয়েছে।
আরব আমিরাত এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রিম কেতায়েত বলেছেন, এটি ‘নোংরা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা।’ তাঁর দাবি, সুদানের সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই দুই বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লড়াইরত আরএসএফ।
বিষয়টি সত্যি যে, সুদানি সেনাবাহিনীও যুদ্ধাপরাধ করেছে। কিন্তু আরএসএফ–এর প্রতি আমিরাতের সমর্থন নিয়ে কারও তেমন সন্দেহ নেই। তবে তারপরও আইনি জটিলতার কারণে মামলাটির সামনে এগোনোর সম্ভাবনা কম। তবে এই ঘটনা একটি প্রবণতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আমিরাত এমন সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা হয়—রাষ্ট্র দখল করতে চায়, নয়তো সেটিকে ভাঙতে চায়।
আধুনিক আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু এখন সৌদি আরব ও আমিরাত। দুই দেশই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও প্রভাবশালী কূটনৈতিক শক্তি। উভয়ই নিজেদের বহু মেরু বিশ্বের স্বাধীন শক্তি হিসেবে দেখে। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের পথ আলাদা। সৌদি আরব স্থিতিশীলতাকে মূল স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে এবং (যদিও সব সময় নয়) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, সাতটি আমিরাত নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (যার মধ্যে দুবাই আছে এবং সবচেয়ে ধনী আবুধাবি) নীতিনির্ধারণ ভিন্ন ধাঁচের। লিবিয়ায় তারা বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। হাফতারই লিবিয়ায় জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। ইয়েমেনে আমিরাত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে সমর্থন দিচ্ছে। সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চল—পুন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ডের নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে দেশটি।
এসব নীতির অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। সুদানে আরএসএফ–কে সমর্থন দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তো বটেই, চীন ও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করেছে। ফলে বিষয়টি সামান্য কিছু নয়।
আঞ্চলিক ইস্যুতে নিজেদের নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমিরাতের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘এই নীতি আমাদের নয়।’ আর এর ধারাবাহিকতায় দেশটি আরএসএফ–কে অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে জাতিসংঘের তদন্ত ও স্যাটেলাইট চিত্র প্রমাণ করেছে, তারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দেশটি আরএসএফকে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল।
আমিরাতের এক কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, হাফতারের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল ‘মিত্রদের পূর্ণ সম্মতি সাপেক্ষেই।’ যদিও লিবিয়ার বেশির ভাগ মিত্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, হাফতারের বিরোধী ছিল।
আবুধাবিতে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, এই নীতির পেছনে আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, সুদানের স্বর্ণ খনির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেতেই হয়তো আমিরাত আগ্রহী। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। কারণ সুদানের বেশির ভাগ স্বর্ণ এরই মধ্যে আমিরাতে রপ্তানি হচ্ছে। আবার অনেকে মনে করেন, খাদ্য নিরাপত্তা উদ্যোগে অগ্রগতি আনতে আমিরাত সুদানে কৃষিজমি ও সমুদ্রবন্দরে প্রবেশাধিকার চায়; কারণ দেশটির ৯০ শতাংশ খাদ্য আমদানিনির্ভর।
তবে কেবল বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা ভুল হবে। আমিরাতের প্রধান প্রেরণা আদর্শিক। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর তীব্র বিরোধী। তিনি এবং তাঁর পরিবার চান আরব বিশ্বে কাতার ও তুরস্কের প্রভাব কমাতে। কারণ, এই দুই দেশই মুসলিম বিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সমর্থক। একই সঙ্গে আরব আমিরাত সৌদি আরবের প্রভাবের বাইরে নিজেদের আলাদা প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে চায়।
ইয়েমেনে নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই আমিরাত ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। সে সময় রিয়াদ হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। হুতি ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠী। রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বড় একটি অংশ তাদের দখলে। সৌদি ও আমিরাত কেউই চায়নি—ইরানের মদদপুষ্ট কোনো গোষ্ঠী আরব উপদ্বীপে শক্ত ঘাঁটি পাক। তবে আমিরাত চেয়েছিল নিজেদের অনুগত মিত্র তৈরি করতে। কারণ, তাদের কাছে সৌদি আরবও বিশ্বাসযোগ্য মিত্র নয়। কারণ, সৌদিরা ইসলামি রাজনৈতিক দল ইসলাহের বেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র, যা আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা।
ইয়েমেন ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে আমিরাতের নীতি বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই জোট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সুফলও বয়ে আনতে পারে। আবুধাবিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় শিপিং জায়ান্ট এডি পোর্টস আশা করছে, তারা দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেন বন্দরের পরিচালনার অধিকার পাবে। আমিরাতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে তারা আঞ্চলিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, তবে এটাই দেশটির মূল উদ্দেশ্য নয়।
২০১৯ সালে ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুদানে কয়েক দশকের ইসলামপন্থী শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে এখনো ইসলামপন্থী কর্মকর্তাদের প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান দ্রুত সমর্থন দেন আরএসএফ–কে। আরেকটি কারণ ছিল, মিলিশিয়া নেতা মুহাম্মদ হামদান দাগালো—যিনি ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত—ইয়েমেনে যুদ্ধের সময় আরব আমিরাতকে সহায়তা দিতে হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন। শেখ মুহাম্মদ হয়তো সেই সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মনে হয়, তিনি এই লোকদের প্রতি একধরনের আনুগত্য অনুভব করেন।’
আমিরাতের দাবি—তারা শুধু বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোচ্ছে। যুক্তিটা কিছুটা গ্রহণযোগ্যও। ইয়েমেনে তাদের মিত্ররা সৌদি সমর্থিত বাহিনীর চেয়ে দক্ষ যোদ্ধা প্রমাণিত হয়েছিল। লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারও যতটা বৈধ বলে শোনা যায়, বাস্তবে তা নয়—সেখানে প্রভাবশালী হলো মিলিশিয়ারা।
তবু এসব শক্তির প্রতি সমর্থন খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৮ সালে আমিরাত দামেস্কে দূতাবাস পুনরায় চালু করে এবং অন্যান্য দেশকেও বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহ্বান জানায়। শেখ মুহাম্মদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, ‘দশ বছরের হতাশা থেকেই এই যোগাযোগ শুরু হয়েছিল।’ তাঁর মতে, সিরিয়ার একনায়ককে একঘরে করে রাখা কাজে আসেনি; তাই তাঁকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা উচিত ছিল। সেই চেষ্টা করে অবশ্য কোনো ফল পায়নি আমিরাত।
আসাদ গত ডিসেম্বরে মস্কো পালিয়ে যান। সিরিয়ার ইসলামপন্থী নতুন সরকারের প্রতি আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সন্দেহ প্রবণ। এমনকি অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায়ও অনেক বেশি। তবে এখনো নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আমিরাত।
এর আগে, হাফতার ত্রিপোলি দখলের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। আরএসএফও গত মাসে সুদানের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বলা যায়, দুই ক্ষেত্রেই আমিরাতের ভূমিকা উল্টো ফল দিয়েছে। এতে তুরস্ক সুদানি সেনাবাহিনী ও ত্রিপোলির সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে। ওই দুই পক্ষই এখন তুর্কি ড্রোনের ওপর নির্ভর করছে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে।
এসব নীতি আমিরাতের সুনামেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত মাসে ওয়াশিংটনে কয়েক দফা বৈঠকে তিন কংগ্রেস সদস্যের সহযোগী আমিরাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা উত্থাপন করেছেন। যদিও তা আপাতত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রচলিত আছে যে, আরএসএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা শুধু অপরাধ নয়, বরং এক ভয়াবহ ভুল।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো সুদানি আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সমর্থন দিয়েছে।
আরব আমিরাত এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রিম কেতায়েত বলেছেন, এটি ‘নোংরা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা।’ তাঁর দাবি, সুদানের সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই দুই বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লড়াইরত আরএসএফ।
বিষয়টি সত্যি যে, সুদানি সেনাবাহিনীও যুদ্ধাপরাধ করেছে। কিন্তু আরএসএফ–এর প্রতি আমিরাতের সমর্থন নিয়ে কারও তেমন সন্দেহ নেই। তবে তারপরও আইনি জটিলতার কারণে মামলাটির সামনে এগোনোর সম্ভাবনা কম। তবে এই ঘটনা একটি প্রবণতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আমিরাত এমন সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা হয়—রাষ্ট্র দখল করতে চায়, নয়তো সেটিকে ভাঙতে চায়।
আধুনিক আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু এখন সৌদি আরব ও আমিরাত। দুই দেশই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও প্রভাবশালী কূটনৈতিক শক্তি। উভয়ই নিজেদের বহু মেরু বিশ্বের স্বাধীন শক্তি হিসেবে দেখে। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের পথ আলাদা। সৌদি আরব স্থিতিশীলতাকে মূল স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে এবং (যদিও সব সময় নয়) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, সাতটি আমিরাত নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (যার মধ্যে দুবাই আছে এবং সবচেয়ে ধনী আবুধাবি) নীতিনির্ধারণ ভিন্ন ধাঁচের। লিবিয়ায় তারা বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। হাফতারই লিবিয়ায় জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। ইয়েমেনে আমিরাত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে সমর্থন দিচ্ছে। সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চল—পুন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ডের নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে দেশটি।
এসব নীতির অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। সুদানে আরএসএফ–কে সমর্থন দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তো বটেই, চীন ও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করেছে। ফলে বিষয়টি সামান্য কিছু নয়।
আঞ্চলিক ইস্যুতে নিজেদের নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমিরাতের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘এই নীতি আমাদের নয়।’ আর এর ধারাবাহিকতায় দেশটি আরএসএফ–কে অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে জাতিসংঘের তদন্ত ও স্যাটেলাইট চিত্র প্রমাণ করেছে, তারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দেশটি আরএসএফকে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল।
আমিরাতের এক কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, হাফতারের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল ‘মিত্রদের পূর্ণ সম্মতি সাপেক্ষেই।’ যদিও লিবিয়ার বেশির ভাগ মিত্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, হাফতারের বিরোধী ছিল।
আবুধাবিতে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, এই নীতির পেছনে আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, সুদানের স্বর্ণ খনির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেতেই হয়তো আমিরাত আগ্রহী। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। কারণ সুদানের বেশির ভাগ স্বর্ণ এরই মধ্যে আমিরাতে রপ্তানি হচ্ছে। আবার অনেকে মনে করেন, খাদ্য নিরাপত্তা উদ্যোগে অগ্রগতি আনতে আমিরাত সুদানে কৃষিজমি ও সমুদ্রবন্দরে প্রবেশাধিকার চায়; কারণ দেশটির ৯০ শতাংশ খাদ্য আমদানিনির্ভর।
তবে কেবল বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা ভুল হবে। আমিরাতের প্রধান প্রেরণা আদর্শিক। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর তীব্র বিরোধী। তিনি এবং তাঁর পরিবার চান আরব বিশ্বে কাতার ও তুরস্কের প্রভাব কমাতে। কারণ, এই দুই দেশই মুসলিম বিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সমর্থক। একই সঙ্গে আরব আমিরাত সৌদি আরবের প্রভাবের বাইরে নিজেদের আলাদা প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে চায়।
ইয়েমেনে নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই আমিরাত ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। সে সময় রিয়াদ হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। হুতি ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠী। রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বড় একটি অংশ তাদের দখলে। সৌদি ও আমিরাত কেউই চায়নি—ইরানের মদদপুষ্ট কোনো গোষ্ঠী আরব উপদ্বীপে শক্ত ঘাঁটি পাক। তবে আমিরাত চেয়েছিল নিজেদের অনুগত মিত্র তৈরি করতে। কারণ, তাদের কাছে সৌদি আরবও বিশ্বাসযোগ্য মিত্র নয়। কারণ, সৌদিরা ইসলামি রাজনৈতিক দল ইসলাহের বেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র, যা আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা।
ইয়েমেন ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে আমিরাতের নীতি বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই জোট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সুফলও বয়ে আনতে পারে। আবুধাবিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় শিপিং জায়ান্ট এডি পোর্টস আশা করছে, তারা দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেন বন্দরের পরিচালনার অধিকার পাবে। আমিরাতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে তারা আঞ্চলিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, তবে এটাই দেশটির মূল উদ্দেশ্য নয়।
২০১৯ সালে ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুদানে কয়েক দশকের ইসলামপন্থী শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে এখনো ইসলামপন্থী কর্মকর্তাদের প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান দ্রুত সমর্থন দেন আরএসএফ–কে। আরেকটি কারণ ছিল, মিলিশিয়া নেতা মুহাম্মদ হামদান দাগালো—যিনি ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত—ইয়েমেনে যুদ্ধের সময় আরব আমিরাতকে সহায়তা দিতে হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন। শেখ মুহাম্মদ হয়তো সেই সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মনে হয়, তিনি এই লোকদের প্রতি একধরনের আনুগত্য অনুভব করেন।’
আমিরাতের দাবি—তারা শুধু বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোচ্ছে। যুক্তিটা কিছুটা গ্রহণযোগ্যও। ইয়েমেনে তাদের মিত্ররা সৌদি সমর্থিত বাহিনীর চেয়ে দক্ষ যোদ্ধা প্রমাণিত হয়েছিল। লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারও যতটা বৈধ বলে শোনা যায়, বাস্তবে তা নয়—সেখানে প্রভাবশালী হলো মিলিশিয়ারা।
তবু এসব শক্তির প্রতি সমর্থন খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৮ সালে আমিরাত দামেস্কে দূতাবাস পুনরায় চালু করে এবং অন্যান্য দেশকেও বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহ্বান জানায়। শেখ মুহাম্মদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, ‘দশ বছরের হতাশা থেকেই এই যোগাযোগ শুরু হয়েছিল।’ তাঁর মতে, সিরিয়ার একনায়ককে একঘরে করে রাখা কাজে আসেনি; তাই তাঁকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা উচিত ছিল। সেই চেষ্টা করে অবশ্য কোনো ফল পায়নি আমিরাত।
আসাদ গত ডিসেম্বরে মস্কো পালিয়ে যান। সিরিয়ার ইসলামপন্থী নতুন সরকারের প্রতি আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সন্দেহ প্রবণ। এমনকি অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায়ও অনেক বেশি। তবে এখনো নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আমিরাত।
এর আগে, হাফতার ত্রিপোলি দখলের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। আরএসএফও গত মাসে সুদানের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বলা যায়, দুই ক্ষেত্রেই আমিরাতের ভূমিকা উল্টো ফল দিয়েছে। এতে তুরস্ক সুদানি সেনাবাহিনী ও ত্রিপোলির সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে। ওই দুই পক্ষই এখন তুর্কি ড্রোনের ওপর নির্ভর করছে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে।
এসব নীতি আমিরাতের সুনামেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত মাসে ওয়াশিংটনে কয়েক দফা বৈঠকে তিন কংগ্রেস সদস্যের সহযোগী আমিরাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা উত্থাপন করেছেন। যদিও তা আপাতত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রচলিত আছে যে, আরএসএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা শুধু অপরাধ নয়, বরং এক ভয়াবহ ভুল।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা...
৩০ মে ২০২৫
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
২ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
১ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আফ্রিকা মহাদেশে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং চলমান সংঘাতকে উসকে দেওয়ার এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর বিরুদ্ধে। সোমালিয়ার পুনটল্যান্ড রাজ্যের বোসাসো বিমানবন্দরকে একটি গোপন ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করে আমিরাত সুদানের বিতর্কিত আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। সরবরাহ করা হচ্ছে কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনা।
মিডল ইস্ট আই-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা, স্যাটেলাইট চিত্র, স্থানীয় সূত্র এবং মার্কিন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।

ভারী কার্গো বিমানের রহস্যময় যাতায়াত
বোসাসো বিমানবন্দরে আজকাল ভারী কার্গো পরিবহনকারী আইএফ-৭৬ বিমানের ঘন ঘন অবতরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এখন নিয়মিত ঘটনা। পুনটল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্সের (পিএমপিএফ) একজন কমান্ডার (আবদুল্লাহি) মিডল ইস্ট মনিটরকে জানিয়েছেন, এই বিমানগুলো ঘন ঘন আসে এবং এগুলোর মাধ্যমে আসা সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ দ্রুত অপেক্ষমাণ অন্য বিমানে তুলে সুদানে আরএসএফ-এর জন্য পাঠানো হয়।
সূত্রের বরাত দিয়ে মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিমানগুলোর উৎস হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিমানবন্দর ব্যবহারের সময়সূচি ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয় এবং বিমানগুলো সাধারণত বিমানবন্দরের কর্মচাঞ্চল্য কম থাকার সময় বোসাসোতে পৌঁছায়। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, এই চালানগুলোর মধ্যে চীনা-নির্মিত ড্রোনসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে।
বোসাসো বন্দরের একজন সিনিয়র ম্যানেজার প্রথমবারের মতো মিডল ইস্ট আই-কে নিশ্চিত করেছেন, গত দুই বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি ‘বিপজ্জনক’ চিহ্নিত কন্টেইনার আমিরাত বোসাসো বন্দরের মাধ্যমে পাঠিয়েছে। সাধারণ কার্গোর বিপরীতে, এই আমিরাতি চালানগুলোতে ভেতরের মালপত্র বা গন্তব্যের কোনো বিস্তারিত বিবরণ নথিভুক্ত করা হয় না। বন্দরে একটি জাহাজ ভিড়লে পিএমপিএফ বাহিনীকে মোতায়েন করে এলাকা ঘিরে ফেলা হয় এবং ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে।
কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনাদের গোপন নেটওয়ার্ক
বোসাসো বিমানবন্দরের উত্তর দিকে একটি সামরিক স্থাপনা রয়েছে, এটি কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনাদের আশ্রয়স্থল। মিডল ইস্ট আই-এর হাতে আসা ছবিতে দেখা গেছে, ব্যাকপ্যাক বহনকারী ডজন ডজন কলম্বিয়ান বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি সামরিক ক্যাম্পে যাচ্ছে। পিএমপিএফ কমান্ডার আব্দুল্লাহি নিশ্চিত করেছেন, এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনা আরএসএফ-এর পক্ষে সুদানে যুদ্ধ পরিচালনার কাজ করছে।
এই ভাড়াটে সেনারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ফ্লাইটে বোসাসোতে আসে এবং এরপর প্রায় প্রতিদিনই ট্রানজিট হয়ে সুদানে পাড়ি জমায়। এই ভাড়াটে সেনারা তাদের ক্যাম্পের ভেতরে একটি নতুন হাসপাতালও নির্মাণ করেছে। সেখানে সুদানে আহত হওয়া আরএসএফ সৈন্যদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহি রক্তমাখা বিমান দেখার কথা স্মরণ করে বলেন, এই ক্যাম্প আহত আরএসএফ যোদ্ধাদের জন্য একটি চিকিৎসা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বোসাসো বিমানবন্দরকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত সেখানে একটি ফরাসি-নির্মিত সামরিক রাডার সিস্টেমও স্থাপন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০২৩ সালেই ঘোষণা করেছিল, আরএসএফ এবং তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা সুদানে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আরএসএফ-কে সোমালিয়ার মাটি ব্যবহার করে সাহায্য করার বিষয়টি স্থানীয় পিএমপিএফ সৈন্যদের মধ্যে তীব্র নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। অনেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, দীর্ঘদিনের মিত্র সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভাড়াটে সেনাদের সহায়তা করা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
হর্ন অব আফ্রিকার সংঘাত বিশেষজ্ঞ মার্টিন প্লট সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সুদানের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করছে এবং পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এই অপরাধে সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে গৃহযুদ্ধে সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে সমর্থন করার অভিযোগে সুদান সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। খার্তুম অভিযোগ করে, আরব আমিরাত পশ্চিম দারফুরে মাসালিত সম্প্রদায়ের ‘গণহত্যায় জড়িত’, তারা আরএসএফকে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে এ অপরাধ সংঘটিত করছে।
যদিও ২০২৩ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, আরএসএফ এবং সুদানি সেনাবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মোগাদিসুর নীরবতা ও আমিরাতের কৌশলগত ঘাঁটি
সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার মোগাদিসুর আকাশপথ নিয়ন্ত্রণ করলেও, তাদের বোসাসোর বন্দর ও বিমানবন্দরের ওপর কোনো কর্তৃত্ব নেই। বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার (প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ-এর নেতৃত্বাধীন) আমিরাতের ক্রমবর্ধমান ও প্রসারমান প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না থাকায় সামরিক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে বাধা দিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমিরাতের এই কার্যকলাপের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুদানের স্বর্ণখনি দখল এবং লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার। আমিরাত এই অঞ্চলে মায়ুন, আবদ আল-কুরি, সামহা, সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা এবং ইয়েমেনের মোচা বন্দরে ঘাঁটি নির্মাণ বা সম্প্রসারণের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
প্লট আরও বলেন, পুনটল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান এবং নজরদারির অভাব এটিকে আমিরাতের জন্য আদর্শ অপারেশনাল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। কারণ এখানে তাদের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে না।
আমিরাত সরকার একাধিকবার আরএসএফকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও, এ বিষয়ে মির বা পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষের কেউই কখনো গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।

আফ্রিকা মহাদেশে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং চলমান সংঘাতকে উসকে দেওয়ার এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর বিরুদ্ধে। সোমালিয়ার পুনটল্যান্ড রাজ্যের বোসাসো বিমানবন্দরকে একটি গোপন ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করে আমিরাত সুদানের বিতর্কিত আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। সরবরাহ করা হচ্ছে কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনা।
মিডল ইস্ট আই-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা, স্যাটেলাইট চিত্র, স্থানীয় সূত্র এবং মার্কিন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।

ভারী কার্গো বিমানের রহস্যময় যাতায়াত
বোসাসো বিমানবন্দরে আজকাল ভারী কার্গো পরিবহনকারী আইএফ-৭৬ বিমানের ঘন ঘন অবতরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এখন নিয়মিত ঘটনা। পুনটল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্সের (পিএমপিএফ) একজন কমান্ডার (আবদুল্লাহি) মিডল ইস্ট মনিটরকে জানিয়েছেন, এই বিমানগুলো ঘন ঘন আসে এবং এগুলোর মাধ্যমে আসা সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ দ্রুত অপেক্ষমাণ অন্য বিমানে তুলে সুদানে আরএসএফ-এর জন্য পাঠানো হয়।
সূত্রের বরাত দিয়ে মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিমানগুলোর উৎস হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিমানবন্দর ব্যবহারের সময়সূচি ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয় এবং বিমানগুলো সাধারণত বিমানবন্দরের কর্মচাঞ্চল্য কম থাকার সময় বোসাসোতে পৌঁছায়। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, এই চালানগুলোর মধ্যে চীনা-নির্মিত ড্রোনসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে।
বোসাসো বন্দরের একজন সিনিয়র ম্যানেজার প্রথমবারের মতো মিডল ইস্ট আই-কে নিশ্চিত করেছেন, গত দুই বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি ‘বিপজ্জনক’ চিহ্নিত কন্টেইনার আমিরাত বোসাসো বন্দরের মাধ্যমে পাঠিয়েছে। সাধারণ কার্গোর বিপরীতে, এই আমিরাতি চালানগুলোতে ভেতরের মালপত্র বা গন্তব্যের কোনো বিস্তারিত বিবরণ নথিভুক্ত করা হয় না। বন্দরে একটি জাহাজ ভিড়লে পিএমপিএফ বাহিনীকে মোতায়েন করে এলাকা ঘিরে ফেলা হয় এবং ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে।
কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনাদের গোপন নেটওয়ার্ক
বোসাসো বিমানবন্দরের উত্তর দিকে একটি সামরিক স্থাপনা রয়েছে, এটি কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনাদের আশ্রয়স্থল। মিডল ইস্ট আই-এর হাতে আসা ছবিতে দেখা গেছে, ব্যাকপ্যাক বহনকারী ডজন ডজন কলম্বিয়ান বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি সামরিক ক্যাম্পে যাচ্ছে। পিএমপিএফ কমান্ডার আব্দুল্লাহি নিশ্চিত করেছেন, এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনা আরএসএফ-এর পক্ষে সুদানে যুদ্ধ পরিচালনার কাজ করছে।
এই ভাড়াটে সেনারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ফ্লাইটে বোসাসোতে আসে এবং এরপর প্রায় প্রতিদিনই ট্রানজিট হয়ে সুদানে পাড়ি জমায়। এই ভাড়াটে সেনারা তাদের ক্যাম্পের ভেতরে একটি নতুন হাসপাতালও নির্মাণ করেছে। সেখানে সুদানে আহত হওয়া আরএসএফ সৈন্যদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহি রক্তমাখা বিমান দেখার কথা স্মরণ করে বলেন, এই ক্যাম্প আহত আরএসএফ যোদ্ধাদের জন্য একটি চিকিৎসা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বোসাসো বিমানবন্দরকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত সেখানে একটি ফরাসি-নির্মিত সামরিক রাডার সিস্টেমও স্থাপন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০২৩ সালেই ঘোষণা করেছিল, আরএসএফ এবং তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা সুদানে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আরএসএফ-কে সোমালিয়ার মাটি ব্যবহার করে সাহায্য করার বিষয়টি স্থানীয় পিএমপিএফ সৈন্যদের মধ্যে তীব্র নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। অনেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, দীর্ঘদিনের মিত্র সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভাড়াটে সেনাদের সহায়তা করা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
হর্ন অব আফ্রিকার সংঘাত বিশেষজ্ঞ মার্টিন প্লট সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সুদানের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করছে এবং পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এই অপরাধে সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে গৃহযুদ্ধে সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে সমর্থন করার অভিযোগে সুদান সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। খার্তুম অভিযোগ করে, আরব আমিরাত পশ্চিম দারফুরে মাসালিত সম্প্রদায়ের ‘গণহত্যায় জড়িত’, তারা আরএসএফকে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে এ অপরাধ সংঘটিত করছে।
যদিও ২০২৩ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, আরএসএফ এবং সুদানি সেনাবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মোগাদিসুর নীরবতা ও আমিরাতের কৌশলগত ঘাঁটি
সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার মোগাদিসুর আকাশপথ নিয়ন্ত্রণ করলেও, তাদের বোসাসোর বন্দর ও বিমানবন্দরের ওপর কোনো কর্তৃত্ব নেই। বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার (প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ-এর নেতৃত্বাধীন) আমিরাতের ক্রমবর্ধমান ও প্রসারমান প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না থাকায় সামরিক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে বাধা দিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমিরাতের এই কার্যকলাপের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুদানের স্বর্ণখনি দখল এবং লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার। আমিরাত এই অঞ্চলে মায়ুন, আবদ আল-কুরি, সামহা, সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা এবং ইয়েমেনের মোচা বন্দরে ঘাঁটি নির্মাণ বা সম্প্রসারণের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
প্লট আরও বলেন, পুনটল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান এবং নজরদারির অভাব এটিকে আমিরাতের জন্য আদর্শ অপারেশনাল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। কারণ এখানে তাদের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে না।
আমিরাত সরকার একাধিকবার আরএসএফকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও, এ বিষয়ে মির বা পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষের কেউই কখনো গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।

পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির অর্থই ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখলেও এখনো দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি। তথ্য বলছে, পশ্চিমা...
৩০ মে ২০২৫
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
২ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
১ দিন আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
১ দিন আগে