Ajker Patrika

অভিমান করেছিলেন আহমদ রফিক

জাহীদ রেজা নূর
অভিমান করেছিলেন আহমদ রফিক

রাত সাড়ে ১০টায় অফিসের সামনের ছাপড়িগুলোর একটিতে চা খেতে খেতে ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম আহমদ রফিককে। ২০১৭ সাল চলছে তখন। বইমেলার কিছুদিন আগের ঘটনা। ‘ভয়ে ভয়ে’ ফোন করার কারণ হলো, তিনি আগের দুদিন আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি সাড়া দিইনি। কী নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, মনে নেই, কিন্তু কাজটা যে অন্যায় হয়েছে, সেটা কবুল করে নিচ্ছি। তাই, অফিসের কাজ সেরে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে ফোন করলাম তাঁকে। প্রথমে সাড়া নেই। ফোন বেজেই চলল। ধরলেন না। কয়েক মিনিট পর আবার চেষ্টা করলাম। এবার সফল হলাম। ‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আমি জাহীদ বলছিলাম।’

‘কোন জাহীদ?’

তাঁর এই প্রশ্নটিই বলে দেয়, তিনি অভিমান করেছেন। আমার কণ্ঠ কিংবা আমার নাম তাঁর কাছে অপরিচিত থাকার কথা নয়।

‘আমি প্রথম আলোর জাহীদ।’ ইচ্ছে করেই বুঝতে দিই না, তাঁর অভিমানটা আমি ধরতে পেরেছি।

‘ও আপনি! আপনাকে মনে হয় দুদিন ধরে অনবরত ফোন করেছিলাম। আপনি ধরেননি।’

‘আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আসলে ফোন তো সাইলেন্ট করা থাকে, তাই কখন ফোন করেছিলেন বুঝতে পারিনি। তারপরও ক্ষমা চাইছি।’

এবার অবশ্য ‘তুমি’তে নামলেন। ‘তোমাকে একটা খবর দিতে চাইছি, অথচ তুমি ফোন ধরছ না। তুমি নিজেকে কী মনে করো?’

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই চুপ করে থাকি।

একটু বুঝি শান্ত হন। বলেন, ‘বলো তো কেন তোমাকে খুঁজছি?’

‘সে তো বলতে পারব না। নিশ্চয়ই কোনো দরকার আছে। আপনি বললে এখনই চলে আসতে পারি।’

‘শোনো, আমি আর একটু পর ঘুমাতে যাব। আজ আমার এখানে আসার দরকার নেই। কাল সময় করে এসো।’

‘নিশ্চয়ই আসব।’ বলে ফোন রাখলাম।

এরপর কী হয়েছিল, সে কথা বলব শেষে। এখানে শুধু বলে রাখি, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে গিয়েই প্রথম তাঁর সংস্পর্শে আসা। সে সময় প্রথম আলোতে কাজ করি। ২০০৬ সালের দিকে সম্পাদক আমাকে দায়িত্ব দিলেন পত্রিকার প্রথম পাতায় টানা ২১ দিন ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখার জন্য। আমি বইপত্র খুলে বসলাম। যতদিকে যত তথ্য-উপাত্তের উৎস আছে, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঠিক আগের বছর সম্পাদকের নির্দেশে জাতীয় মহাফেজখানা ঘেটে চারটি বড় প্রবন্ধ লিখেছিলাম সম্পাদকীয় পাতায়। তারই জের হিসেবে আমার এই দায়িত্ব প্রাপ্তি। বার্তা বিভাগের সেলিম খানের ওপর দায়িত্ব ছিল লেখাগুলো ঠিকভাবে পাতায় তোলার। তিনি প্রতিটি লেখার আকর্ষণীয় শিরোনাম তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই লেখাগুলো যখন ছাপা হচ্ছে, তখন একদিন একটি ফোন পেলাম। ফোনটি ছিল অপ্রত্যাশিত। কারণ ওপারে ছিলেন আহমদ রফিক। তিনি ফোন করে বললেন, ‘আপনি কি জাহীদ?’

‘জ্বি।’

‘আপনাদের সম্পাদকের কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বরটা নিলাম। আমার নাম আহমদ রফিক।’

আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম। আহমদ রফিক ফোন করেছেন, তার মানে নিশ্চয়ই প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া আমার লেখাগুলো নিয়ে কিছু বলবেন।

কথা শুরু হওয়ার পরই আমার মন প্রশান্ত হয়ে উঠল। তিনি যা বললেন, তার নির্যাস হলো, সব পত্রিকাতেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় এক কলামে একটি করে প্রতিবেদন যায়। তাতে অনেক ভুল থাকে। কিন্তু আমি যে কাজটি করছি, তা তিনি খুবই আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন এবং তাতে এখন পর্যন্ত কোনো ভুল নেই। আমাকে উৎসাহিত করে তিনি ফোন রাখলেন।

এই কথোপকথনটি আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। এ সময় বেঁচে থাকা ভাষা সংগ্রামীদের ব্যাপারে আমার মনে আগ্রহ জন্ম নেয়। যতদূর মনে পড়ে এ সময় কাজী গোলাম মাহবুব, গাজীউল হক, সাঈদ হায়দার, রফিকুল ইসলাম, হালিমা খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, আবদুল মতিন, মুর্তজা বশীর প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

এরপর থেকে প্রতি বছর একুশের কাছাকাছি হলেই আহমদ রফিকের শরণাপন্ন হয়েছি। কখনো ভাষা সংগ্রামীদের নিয়ে গেছি শহীদ মিনারে, সেখানে শুনেছি তাদের স্মৃতিচারণ। কখনো কিশোর বয়সীদের নিয়ে গেছি তাঁর বাড়িতে, তিনি শুনিয়েছেন একুশের গল্প। কখনও চলে গেছি একা তাঁর কাছে। নিয়েছি সাক্ষাৎকার। আর এই চলাচলের কারণেই আমাকে তিনি বেঁধেছিলেন স্নেহের বন্ধনে। আমার ওপর তাঁর একটা অধিকার বোধও জন্মেছিল।

মনে আছে, প্রথম আলো ছেড়ে আসার কিছুকাল আগে হঠাৎ মনে হলো, বায়ান্নর ঐতিহাসিক জায়গাগুলো এখন কী অবস্থায় আছে, তার ছবি তুলে ঘটনার বর্ণনা করা হলে নতুনভাবে একুশকে দেখা যাবে। কোথায় বরকত, রফিক গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, কোথায় গড়ে উঠেছিল শহীদ মিনার, কোথায় বসেছিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের বৈঠক—এই সব ছবি তোলা হচ্ছিল। ছবি তুলছিলেন স্বনামধন্য ফটোশিল্পী লতিফ ভাই। জগন্নাথ হলের যে জায়গাটায় প্রাদেশিক পরিষদের বৈঠক বসত, সেটি এখন আর নেই। আছে শুধু কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সেখানেই একটি ফলকে লেখা আছে ইতিহাস।

সব তো হলো, এখন সবচেয়ে জরুরি যে জায়গাটা, অর্থাৎ যেখান থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল মিছিল, সে জায়গাটা চেনা বড্ড কঠিন হয়ে পড়েছিল। মুশকিল আসানের জন্য ফোন করলাম আহমদ রফিককে। পরিকল্পনা যখন করেছিলাম, তখনই তাঁকে জানিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ ছিলেন না বলে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেননি। এখনও মনে আছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে ফোন করে বার বার এ জায়গা থেকে ও জায়গা করতে করতে সভাটি কোথায় বসেছিল, সে জায়গাটা চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম। এখনও মনে আছে ২২ মিনিট ধরে তিনি শুধু বুঝিয়েছেন, ‘এখানে নয়, আরেকটু এগিয়ে যাও। এবার বাঁয়ে তাকিয়ে দেখ। কী দেখছ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই ঠিক জায়গা।’

২২ মিনিট কথা হয়েছিল, সেটা মনে আছে, কারণ ২১শে ফেব্রুয়ারির বিষয়ে ২২ মিনিট কথা বলেছি, এ রকমভাবে সময়টা মনে রেখেছিলাম।

বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। বাড়ির কাজগুলো ঠিকঠাক করে রাখার জন্য সহযোগী আছেন। ছবি তোলার কাজ শেষ হলে প্রথম আলোর গ্রাফিকস বিভাগের মুনির ভাই সুন্দর একটি ডামি তৈরি করে আমাকে দিয়েছিলেন। ভোরবেলায় চলে গিয়েছিলাম আহমদ রফিকের বাড়িতে। একটা হাল্কা চাদর গায়ে বসে ছিলেন তিনি। অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। বায়ান্নর ছবির সঙ্গে এখনকার ছবিগুলো মিলিয়ে দেওয়ার সময় আপ্লুত হয়েছিলেন। সেদিন তাঁর বাড়িতে ছবি তুলেছিলাম আমরা। এরপর সম্ভবত আর তাঁর বাড়িতে যাওয়া হয়নি। টেলিফোনে কুশল সংবাদ নিয়েছি বটে, কিন্তু সেটাই পর্যাপ্ত ছিল না। তিনি সঙ্গপ্রিয় মানুষ। এখন তিনি অসুস্থ, সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন। আজ তাঁর জন্মদিন। এই দিনে তাঁকে নিয়ে খানিক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কষ্টও হচ্ছে। তাঁর গুরুগম্ভীর মুখে শিশুর মতো হাসির কথা স্মরণে আনছি।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তা দিয়েই শেষ করি।

তিনি আমাকে যেতে বলেছেন তাঁর বাড়িতে। নিউ ইস্কাটনের সেই চেনা বাড়ির ড্রইংরুমে গিয়ে বসে আছি। বেশ অনকক্ষণ বসে থাকার পর তিনি এলেন সেই ঘরে। কুশল বিনিময়ের পর বসলেন সামনের সোফায়। তারপর বাড়িয়ে দিলেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বইটি। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বইটি হাতে নিলাম। ভাবলাম, নতুন বই বেরিয়েছে, তার একটি কপি আমাকে উপহার দিতে চাইছেন, কিন্তু আমি ফোন ধরিনি। তাই অভিমান করেছেন।

আমার হাতে বইটি দিয়ে আহমদ রফিক মিটিমিটি হাসছেন। ‘বইটি হাতে নিয়ে বসে আছ কেন? একটু উল্টে-পাল্টে দেখ!’

বইটির নাম সংঘাতময় বিশ্বরাজনীতি’। অনিন্দ্য প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে। বর্তমান সময়ের বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে আহমদ রফিকের মূল্যায়ন নিয়েই বইটি।

একটু পর প্লেটে করে চমচম এলো। ‘খাও।’ বললেন তিনি। চোখে মুখে তখনও কৌতুক।

চমচম আর চা খেয়ে ‘আবার দেখা হবে’ বলে ফিরে আসার চেষ্টা করতেই আহমদ রফিকের মুখ আলোয় উদ্ভাসিত হলো। বললেন, ‘সূচিপত্র দেখলে, উল্টে-পাল্টে দু’একটা প্রবন্ধের দিকেও চোখ রাখলে, কিন্তু উৎসর্গপত্রটার দিকে চোখ গেল না তোমার?’

হ্যাঁ, এবার দুরুদুরু বুকে উৎসর্গপত্রটি দেখলাম।

‘প্রগতিবাদী বিশ্বের আগ্রহী পদাতিক,

জাহীদ রেজা নূর,

প্রীতিভাজনেষু।’

আমার মতো এক অকিঞ্চিৎকর মানুষকে বইটি উৎসর্গ করেছেন তিনি! স্নেহ যে নিম্নগামী, সে কথা কে না জানে। কিন্তু কখনো কখনো স্নেহের ভার যে গুরুভার হয়ে দাঁড়ায়, তা আমি আজও টের পাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশসহ ৫ প্রতিবেশীকেই নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে ভারত

পাসপোর্ট ছাড়াই ফ্লাইটে ক্যাপ্টেন মুনতাসির, জেদ্দায় আটক

হইচই ফেলেছে ন্যানো ব্যানানা, চ্যাটজিপিটিকে টপকাল জেমিনি

বিজিবির একজন আর্মি অফিসারকে এখনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না: নাহিদ

জুলাই সনদ কার্যকরে সংবিধান আদেশ জারি ও বৈধতায় গণভোটের সুপারিশ আইন বিশেষজ্ঞদের

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত