Ajker Patrika

তাঁকে পুরুষের ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল

মইনুল হাসান, ফ্রান্স
আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৬: ৩৩
তাঁকে পুরুষের ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল

প্যারিস। আঠারো শতকের শুরুর দিকের কোনো এক সময়। তখনো নাগরিক জীবন ব্যস্ততার অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েনি। যান্ত্রিক সভ্যতা তখনো মানুষের জীবন থেকে স্বাচ্ছন্দ্য কেড়ে নেয়নি। পড়ন্ত বিকেলে ক্যাফে ও পাবগুলো সম্ভ্রান্ত এবং সুসজ্জিত নারী-পুরুষের জমজমাট ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে। সেগুলোরই বিশেষ বিশেষ ক্যাফেতে ছিল সমাজের হাতে গোনা কিছু বিদগ্ধ ব্যক্তির আনাগোনা। সুবিদিত গুণীজনেরা আগে থেকে তারিখ ঠিক করে জড়ো হতেন সেখানে। বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা হতো, নিজেদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের কথা আলোচনা করতেন তাঁরা। বিজ্ঞান, গণিত, দর্শনশাস্ত্র, সাহিত্য—নানা বিষয়ে তর্কবিতর্কে মেতে উঠতেন।

মাঝে মাঝে উত্তেজিত হতেন। তবে তাঁদের উন্মাদনা যুক্তির সীমা লঙ্ঘন করত না। নিজেদের শাণিত করার এমন সুযোগ ছাড়তে চাইতেন না বলেই নিয়ম করে সেসব ক্যাফেতে উপস্থিত হতেন এই ঋষিতুল্য মানুষেরা। যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা সবাই ছিলেন সমাজের অভিজাত মানুষ, প্যারিস একাডেমি অব সায়েন্সেসের সদস্য।

তাঁদের পছন্দের ক্যাফে ছিল প্যারিসের ‘ক্যাফে গ্র্যাডো’। তাঁদের আড্ডায় সাধারণের, বিশেষ করে নারীদের প্রবেশ একেবারেই নিয়মবিরুদ্ধ ছিল।

১৭৩৪ সালের একটি দিন। নিয়মিত একটি জমজমাট আড্ডায় যখন সবাই মত্ত, ঠিক সে সময়ে রাস্তায় ঘোড়ার খুরের ছন্দময় আওয়াজ তুলে একটি জুড়িগাড়ি ক্যাফের সামনে এসে থামল। গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন সুবেশ, সুদর্শন তরুণ। স্নিগ্ধ অবয়বজুড়ে ব্যক্তিত্বের প্ৰখরতা, চোখমুখে দীপ্তির ছটা। আগে থেকে উপস্থিত আলাপরত বিদগ্ধজনেরা মুহূর্তের জন্য সচকিত হলেন। ভাবলেন, নগরীতে আগন্তুক, নিশ্চয়ই জ্ঞানভান্ডারে সমৃদ্ধ এক যুবক। তাই প্রশ্ন না তুলে তরুণকে সাদরে আহ্বান জানালেন তাঁদের আলোচনায় অংশ নিতে। নবাগত তরুণটি বিনা সংকোচে তাঁদের আলোচনায় অংশ নিলেন। তাঁর জ্ঞানের পরিধির পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হলেন উপস্থিত সুধীজনেরা। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো আলোচনায় তাঁর সঙ্গে তাঁরা যখন পেরে উঠছিলেন না, তখন আগন্তুকের ভাষাজ্ঞান পরখ করতে গিয়ে দেখলেন, বেশ কয়েকটি ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন। জ্ঞানের চোখধাঁধানো আলোকছটা যখন সবাইকে মোহিত করছিল, তখন প্রশ্ন ওঠে, কে এই তরুণ?

না, তিনি পুরুষ ছিলেন না, ছিলেন আপাদমস্তক একজন নারী। নাম এমিলি ডু সাতলে। তাঁকে পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছিল। না হলে জ্ঞানী-গুণীদের আড্ডায় যোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবই হতো না। জ্ঞানের অবাধ্য তৃষ্ণা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বলেই তিনি তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

ফ্রান্সের এক ধনাঢ্য পরিবারে এমিলি  জন্মেছিলেন ১৭ ডিসেম্বর ১৭০৬ সালে। পারিবারিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাঁর বাবা পুত্রদের মতো কন্যারও সমানভাবে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এমিলি সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন। অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী এমিলি বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হন। একাধিক ভাষায় ঈর্ষণীয় দক্ষতা ছিল তাঁর।

এমিলির সঙ্গে সখ্য ছিল ভলতেয়ারের এবং দুজনে একসঙ্গে অনেক বিষয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া এমিলি নিজেও অনেক মূল্যবান গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁর অনেক কাজের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় স্যার আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) বিশ্বনন্দিত গ্রন্থ ‘ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা’ লাতিন থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ। আজও তা ফরাসি ভাষায় এক অমূল্য সংযোজন হয়ে আছে।

মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৭৪৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মারা যান এমিলি। তিনি একজন নারী বলে জীবদ্দশায় প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্ধকার কখনোই আলোকে ঢেকে দিতে পারে না। তাই আড়াই শতাব্দী পরে হলেও তাঁকে তাঁর ন্যায্য স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ফরাসি নারী, যিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে স্বকীয় মহিমায় তুলে ধরতে পেরেছিলেন। ইতিহাসে তাঁকে এভাবেই সম্মান করা হয়েছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত