Ajker Patrika

নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বান্দরবানের থানচিতে ৫ মে সকালে পাহাড়ের জুমখেতে ধান রোপণ করতে গিয়েছিলেন এক খেয়াং নারী। দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাত খাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি আর ফিরে না আসায় পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা বিকেলে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। একপর্যায়ে নির্মাণাধীন থানচি-রেমাক্রি-লেইক্রি সড়কের পাশের একটি নালায় তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, লাশটি বিবস্ত্র ছিল এবং তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। এই ঘটনার আট দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দোষীদের শনাক্ত করা যায়নি।

এদিকে ৯ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক যুবক এক নারী যাত্রীকে বেল্ট দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাচ্ছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে, তাঁদের আশপাশে থাকা বিভিন্ন বয়সের মানুষ সে ঘটনা মোবাইলে ধারণ করে স্লোগান দিচ্ছেন।

আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত শারীরিক আঘাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই ধরনের ঘটনাগুলো নারীর জন্য আতঙ্কজনক এবং তাঁদের অবাধে চলাফেরার জন্য হুমকি।

একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আবার নারীর প্রতি নৃশংস ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

এসব ঘটনা প্রমাণ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নারীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে। এসব ঘটনায় নারীরা এক অজানা ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সঠিক বিচার না হওয়ায় ধর্ষণ, হত্যা ও মারধরের ঘটনা বারবার ঘটছে। এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তির দাবি জানিয়েছে জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম (জেএনএনপিএফ)।

এ তো গেল হত্যা ও সহিংসতার কথা। ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করে শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১টি সংস্কার কমিশনের একটি। এই কমিশন গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। তার ওপর ভিত্তি করে ৩ মে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মহাসমাবেশে বক্তারা তাঁদের অন্যান্য দাবির পাশাপাশি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি তোলেন। এ সমাবেশের মঞ্চে যে ভাষা ও ভঙ্গিতে বক্তব্য দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিতর্কের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়ে চলে পাল্টাপাল্টি তর্ক।

আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত শারীরিক আঘাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই ধরনের ঘটনাগুলো নারীর জন্য আতঙ্কজনক এবং তাঁদের অবাধে চলাফেরার জন্য হুমকি। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আবার নারীর প্রতি নৃশংস ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে ১২ মে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। ১১০ নাগরিকের পক্ষ থেকে দেওয়া এ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, কমিশনের প্রতিবেদনের নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আদর্শিক অবস্থানসহ বিভিন্ন কারণে জনমনে ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে সেসব বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা ও বিতর্কের নিশ্চিত সুযোগ রয়েছে। বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন সম্পূর্ণ বাতিলের দাবি শুধু অযৌক্তিক নয়, বরং একে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও উল্লেখ করেছেন বিবৃতিদাতারা। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যেকোনো বিষয়ে কোনো গোষ্ঠীর দ্বিমত থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিদ্বেষ, সহিংসতা বা হুমকি না দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে, যৌক্তিক উপায়ে দ্বিমত উপস্থাপন করা সম্ভব। কেন বারবার সম্ভাবনার দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে বলা হচ্ছে? নারীর বিষয়ে যেকোনো আইন কিংবা প্রস্তাবকে অঙ্কুরে বিনাশ করা হচ্ছে?

এভাবে চলতে থাকলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার ঠিক কতটা উন্মোচিত হতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, ‘নিরাপত্তা দিতে না পারলে নারীর বিকাশ ঘটবে না।’ ১২ মে জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘মেয়েরা যদি স্কুলে নিরাপদ না হয়, রাস্তায় নিরাপদ না হয়, বাসে নিরাপদ না হয়, তাহলে সে মেয়েটি কীভাবে একটি সুন্দর পরিবেশে নিজেকে গড়ে তুলবে?’

পথেঘাটে তো বটেই, নারীদের বড় একটা অংশ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নারীদের যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রতিবাদের সুরে কথা বললে সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি তোলার পর এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকে নানাভাবে হুমকি ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এ বিষয়ে কথা বললে তাঁকেও নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। এ বিষয়ে উমামা ফাতেমা বলেন, ‘যখন হেফাজতের বক্তব্য নিয়ে কথা বলেছি, তখন থেকে আমাকে বলা হয়েছে, আমি নাকি যৌনশ্রমিক। শুধু আমি না, যেসব নারী প্রতিবাদ করেছিল, তাদের সবার কমেন্ট বক্সে একই অবস্থা হয়েছে।’ সরকার এবং আইনগত সহায়তা ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন উমামা ফাতেমা।

নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও সংঘাতপূর্ণ ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে, নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের সঠিক বিকাশসহ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে এই নিরাপত্তাহীনতা বড় বাধা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত