চবি সংবাদদাতা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৫ম সমাবর্তনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দুটি নোবেল পুরস্কারের জন্য গৌরববোধ করতে পারে। একটি আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে পেয়েছি। আর দ্বিতীয়টি—যে গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি হলো, তার গোড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে পরিষ্কার লেখা আছে, এই ব্যাংক কোথা থেকে এসেছে। এই ব্যাংকের জন্ম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। গ্রামীণ ব্যাংকও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। তাই চবি দুটি নোবেল পুরস্কারের জন্য গৌরব বোধ করতেই পারে।’
আজ বুধবার দুপুর ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজিত সমাবর্তনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘চবি যখন নিজের পরিচয় দেয়, তখন হয়তো বলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। একই সঙ্গে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় গৌরব বোধ করে যে আমি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি বলি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গৌরব করার বড় দুটি কারণ রয়েছে। নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন বা এর যে কর্মসূচি, তা শুরু হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দ্বিতীয়ত, আমি শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই ছিলাম না, পাশের গ্রামের ছাত্রও ছিলাম।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যে ধরনের বিশ্ব গড়তে চাই, সেই বিশ্ব গড়ার ক্ষমতা সকল মানুষেরই আছে। কিন্তু আমরা গৎবাঁধা পথে চলি বলে নতুন পৃথিবীর কথা চিন্তা করি না। আমি আশা করি, এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন সবসময় এটা স্মরণ রেখে তার পাঠদান কর্মসূচি, গবেষণা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য চালু রাখে। আমরা শুধু খণ্ডিত বিষয়ে গবেষণা করার জন্য নিয়োজিত নই, আমাদের প্রত্যেকটি গবেষণার পেছনে একটিই উদ্দেশ্য, তা হলো সমস্ত বিশ্ব আমাদের মনের মতো করে সাজাতে হবে। আমাদের যদি সেই লক্ষ্য না থাকে, তাহলে এগুলো গন্তব্যবিহীন শিক্ষায় পরিণত হবে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে, আমরা কী ধরনের বিশ্ব, সমাজব্যবস্থা এবং শিক্ষাব্যবস্থা চাই, সেটাই মুখ্য।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি এখানে শিক্ষক হিসেবে এসেছিলাম, তবে দিন দিন ছাত্র হয়ে গেছি। ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার। অর্থনীতির ভিত্তি হবে মানুষ। কোনোদিন নোবেল পাবো, এটা মনে আসেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।’
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিজের ভেতরে পরিবর্তন এনে দেয় জানিয়ে সমাবর্তন বক্তা বলেন, ‘৭৪ সালে বিরাট দুর্ভিক্ষ হলো। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মনের মধ্যে বহু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবলাম, সারা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নেই, আমি চেষ্টা করতে পারি, এই বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের, কয়েকটি পরিবারের যদি দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারি, তাহলে সেটা আমার জন্য তৃপ্তির বিষয় হবে যে আমি একটা কিছু করেছি। সে কারণে নজর পড়ল পাশের গ্রাম জোবরার ওপর। কী করবে জোবরাতে, সারাদেশে হাহাকার। জোবরাতে কেউ তখনও মারা যায়নি, কিন্তু অবস্থা কাহিল। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল, এই চবি আর জোবরা গ্রামের মাঝামাঝি বিশাল জমি পড়ে আছে, এখানে তো অনেক ফসল হওয়ার কথা, তাতে তো তাদের সারাবছরের খাবার সংস্থান হওয়ার কথা। জিজ্ঞেস করলাম, বলে—এখানে ফসল হয় না। কেন হয় না—বলে, ‘বৃষ্টি না হলে তো ফসল হবে না।’ আমি তখন রাউজানের উদাহরণ দিলাম, রাউজানে তখন সবেমাত্র ইরিধানের চাষ শুরু হয়েছে। বলে—‘আমরা তো জানি না এগুলো।’ ’
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে জিজ্ঞেস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় যদি জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়, এই জ্ঞান পাশের গ্রামে উপচে পড়ে না কেন, তারা জানে না কেন? কেউ কোনো সদুত্তর দিল না বা দেওয়ার চেষ্টাও করল না। তখন আমি চেষ্টা করলাম এদের চাষের দিকে আগ্রহী করা যায় কিনা, তখন বলে যে—পানি তো নেই, রাউজানে পানি আছে, এখানে তো পানি নেই। ডিপ টিউবওয়েল তখন কেবল এসেছে দেশে, ওদের ডিপ টিউবওয়েল আছে, আমাদের নেই। বহু চেষ্টা তদবির করে একটা ডিপ টিউবওয়েল বসালাম। কী হবে—এখানে শীতকালে চাষ হবে, অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড, শীতকালে চাষ হয়, এটা মানুষের ধারণার মধ্যেও নেই। তাদের ধারণা ছিল, শীতকালে যদি চাষের বিষয় থাকত, তাহলে আল্লাহ শীতকালে বৃষ্টি দিতেন। যেহেতু আল্লাহ শীতকালে বৃষ্টি দেননি, তাহলে শীতকালে ফসল চাষের বিষয় নেই, আপনি জোর করে আল্লাহর হুকুম উলটে দিচ্ছেন না।’
ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আগে তেভাগা খামার তৈরির ইতিহাস স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বলতে থাকলাম, ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবস্থাও করা হলো। ফসলও হলো। পরের বছর ছড়া থেকে পানি নিয়ে চাষ করবে বলল। ছড়ায় বাঁধ দেওয়া হলো। বাঁধে যে পানি আসল, সেটা ডিপ টিউবওয়েল থেকে অনেক বেশি পানি। নতুন একটা শিক্ষা হলো। বুঝলাম, ইচ্ছা না থাকলে, গরজ না থাকলে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও অভাব থেকে যায়। পানি আছে, জমি আছে, চাষ করা যায়, কিন্তু কেউ করেনি কোনোদিন, আমরা কেন করব? একটা শিক্ষা লাভ হলো। এর ফলে জন্মলাভ করল তেভাগা খামার, সেটা দিয়ে যাত্রা শুরু। তেভাগা খামারে চাষ করতে গিয়ে আবার সমস্যা হলো। ইরি ধান চাষ করতে গেলে লাইন ধরে রোপা লাগাতে হয়, এমনিতে তো ধান ছিটিয়ে দিলে ফসল হয়ে যায়। কিন্তু ইরিতে কষ্ট করতে হয়। তো, আমি বললাম, খাবেন যখন, কষ্ট তো করতে হবে। বলে—‘না, বেশি কষ্ট।’ তখন আমি ছাত্রদের সঙ্গে বসলাম। তারা দলে দলে মাঠে নামল, লাইন ধরে ইরি ধানের রোপা লাগাল। পরে অন্যান্য গ্রামেও নজর পড়ল।’
এরপর নারীদের ঋণদানের কাহিনী তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘এরপর যে কাজ শুরু করলাম, সেটা মহিলাদের খুব পছন্দ হলো। মহিলাদের হাতে ঋণ দিলাম, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা। ৫ টাকা, ১০ টাকায় মানুষ যে এত খুশি হতে পারে জানা ছিল না, কোনোদিন ভাবিওনি। আমি যে মাগনা টাকা দিয়েছি তা না, তাদের বললাম—কাজ করে রোজগার করে টাকা ফেরত দিতে হবে। তাতেই তারা খুশি। অনেক কাহিনী শুনলাম। তাদের অনেকে তাদের নিজের নাম পর্যন্ত বলতে পারে না। আমাদের সমাজ এমন, তাদের নাম জানারও সুযোগ করে দেয় না। ছোটবেলায় অমুকের মেয়ে, বিয়ে হলে অমুকের বউ, মা হলে অমুকের মা, সে যে কে, সে নিজেও জানে না। আমরা প্রথম চেষ্টা করলাম, আমাদের ছাত্রীদের দিয়ে কোনোভাবে তার নামটা বের করার জন্য, হয়তো কোনো একসময় তার নাম একটা ছিল অথবা মনে না পড়লে একটা নতুন নাম দেওয়া যাতে করে সেটা সে লিখতে পারে। এভাবে লেখা শেখানো। এই লেখা শেখাতে গিয়ে তার জীবনের অনেক কাহিনী আসল। প্রতি কাহিনী একটার চাইতে একটা চমৎকার।’
সমাবর্তন বক্তা বলেন, ‘এর থেকে আমি একটা সিদ্ধান্তে আসলাম, সভা-সমিতিতে বললাম, লেখালেখিতে বললাম—ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার। মানুষ হাসাহাসি করল। আপনি ঋণের কথা বলেন, অধিকারের কথাও বলেন—এটা কী ধরনের কথা! অর্থনীতিতে তো অধিকারের বিষয় নেই। অনেক খটকা, তা-ও আবার মানবিক অধিকার, একটা খটকার পর আরেকটা খটকা। তারপর বললাম, আমরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবো। বলে—‘আপনি কে জাদুঘরে পাঠাবেন।’ আমি বললাম—আমি আপনার মতোই একজন মানুষ। তখন বলল—‘এটা আপনার কাজ না, এটা সরকারের কাজ।’ আমি বললাম—আমি আমার কাজ করি, সরকার আমাকে বাধা দিলে দেখা যাবে। জোবরার মহিলাদের কাছ থেকে নতুন অর্থনীতি শিখলাম। জোবরা গ্রাম আমার জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। আজ পর্যন্ত যা করে যাচ্ছি, তা জোবরা থেকে যা শিখেছি তার বহিঃপ্রকাশ। আজ অর্থনীতি যা পড়াচ্ছি, সেটা ব্যবসার অর্থনীতি, মানুষের অর্থনীতি না। আমাদের মানুষের অর্থনীতি গড়তে হবে।’
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন সভাপতি ও চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, ‘আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করেছি। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর জীবনের অর্জনগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক রয়েছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। প্রধান অতিথি এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে দিনটি পূর্ণতা পেয়েছে।’
সমাবর্তনে প্রধান উপদেষ্টাকে ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ৪২ জনকে পিএইচডি ও ৩৩ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৯ বছর পর চবির সমাবর্তনে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ২২ হাজার ৬৮৬ জন শিক্ষার্থী। অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েটরা তাঁদের মা–বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এক মিলনমেলায় পরিণত হয়।
চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস. এম. এ. ফায়েজ, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ ছাড়া চবি উপ–উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, শিক্ষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রথম সমাবর্তন, ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়, ২০০৮ সালে তৃতীয় এবং ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৫ম সমাবর্তনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দুটি নোবেল পুরস্কারের জন্য গৌরববোধ করতে পারে। একটি আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে পেয়েছি। আর দ্বিতীয়টি—যে গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি হলো, তার গোড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে পরিষ্কার লেখা আছে, এই ব্যাংক কোথা থেকে এসেছে। এই ব্যাংকের জন্ম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। গ্রামীণ ব্যাংকও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। তাই চবি দুটি নোবেল পুরস্কারের জন্য গৌরব বোধ করতেই পারে।’
আজ বুধবার দুপুর ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজিত সমাবর্তনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘চবি যখন নিজের পরিচয় দেয়, তখন হয়তো বলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। একই সঙ্গে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় গৌরব বোধ করে যে আমি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি বলি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গৌরব করার বড় দুটি কারণ রয়েছে। নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন বা এর যে কর্মসূচি, তা শুরু হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দ্বিতীয়ত, আমি শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই ছিলাম না, পাশের গ্রামের ছাত্রও ছিলাম।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যে ধরনের বিশ্ব গড়তে চাই, সেই বিশ্ব গড়ার ক্ষমতা সকল মানুষেরই আছে। কিন্তু আমরা গৎবাঁধা পথে চলি বলে নতুন পৃথিবীর কথা চিন্তা করি না। আমি আশা করি, এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন সবসময় এটা স্মরণ রেখে তার পাঠদান কর্মসূচি, গবেষণা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য চালু রাখে। আমরা শুধু খণ্ডিত বিষয়ে গবেষণা করার জন্য নিয়োজিত নই, আমাদের প্রত্যেকটি গবেষণার পেছনে একটিই উদ্দেশ্য, তা হলো সমস্ত বিশ্ব আমাদের মনের মতো করে সাজাতে হবে। আমাদের যদি সেই লক্ষ্য না থাকে, তাহলে এগুলো গন্তব্যবিহীন শিক্ষায় পরিণত হবে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে, আমরা কী ধরনের বিশ্ব, সমাজব্যবস্থা এবং শিক্ষাব্যবস্থা চাই, সেটাই মুখ্য।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি এখানে শিক্ষক হিসেবে এসেছিলাম, তবে দিন দিন ছাত্র হয়ে গেছি। ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার। অর্থনীতির ভিত্তি হবে মানুষ। কোনোদিন নোবেল পাবো, এটা মনে আসেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।’
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিজের ভেতরে পরিবর্তন এনে দেয় জানিয়ে সমাবর্তন বক্তা বলেন, ‘৭৪ সালে বিরাট দুর্ভিক্ষ হলো। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মনের মধ্যে বহু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবলাম, সারা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নেই, আমি চেষ্টা করতে পারি, এই বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের, কয়েকটি পরিবারের যদি দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারি, তাহলে সেটা আমার জন্য তৃপ্তির বিষয় হবে যে আমি একটা কিছু করেছি। সে কারণে নজর পড়ল পাশের গ্রাম জোবরার ওপর। কী করবে জোবরাতে, সারাদেশে হাহাকার। জোবরাতে কেউ তখনও মারা যায়নি, কিন্তু অবস্থা কাহিল। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল, এই চবি আর জোবরা গ্রামের মাঝামাঝি বিশাল জমি পড়ে আছে, এখানে তো অনেক ফসল হওয়ার কথা, তাতে তো তাদের সারাবছরের খাবার সংস্থান হওয়ার কথা। জিজ্ঞেস করলাম, বলে—এখানে ফসল হয় না। কেন হয় না—বলে, ‘বৃষ্টি না হলে তো ফসল হবে না।’ আমি তখন রাউজানের উদাহরণ দিলাম, রাউজানে তখন সবেমাত্র ইরিধানের চাষ শুরু হয়েছে। বলে—‘আমরা তো জানি না এগুলো।’ ’
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে জিজ্ঞেস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় যদি জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়, এই জ্ঞান পাশের গ্রামে উপচে পড়ে না কেন, তারা জানে না কেন? কেউ কোনো সদুত্তর দিল না বা দেওয়ার চেষ্টাও করল না। তখন আমি চেষ্টা করলাম এদের চাষের দিকে আগ্রহী করা যায় কিনা, তখন বলে যে—পানি তো নেই, রাউজানে পানি আছে, এখানে তো পানি নেই। ডিপ টিউবওয়েল তখন কেবল এসেছে দেশে, ওদের ডিপ টিউবওয়েল আছে, আমাদের নেই। বহু চেষ্টা তদবির করে একটা ডিপ টিউবওয়েল বসালাম। কী হবে—এখানে শীতকালে চাষ হবে, অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড, শীতকালে চাষ হয়, এটা মানুষের ধারণার মধ্যেও নেই। তাদের ধারণা ছিল, শীতকালে যদি চাষের বিষয় থাকত, তাহলে আল্লাহ শীতকালে বৃষ্টি দিতেন। যেহেতু আল্লাহ শীতকালে বৃষ্টি দেননি, তাহলে শীতকালে ফসল চাষের বিষয় নেই, আপনি জোর করে আল্লাহর হুকুম উলটে দিচ্ছেন না।’
ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আগে তেভাগা খামার তৈরির ইতিহাস স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বলতে থাকলাম, ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবস্থাও করা হলো। ফসলও হলো। পরের বছর ছড়া থেকে পানি নিয়ে চাষ করবে বলল। ছড়ায় বাঁধ দেওয়া হলো। বাঁধে যে পানি আসল, সেটা ডিপ টিউবওয়েল থেকে অনেক বেশি পানি। নতুন একটা শিক্ষা হলো। বুঝলাম, ইচ্ছা না থাকলে, গরজ না থাকলে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও অভাব থেকে যায়। পানি আছে, জমি আছে, চাষ করা যায়, কিন্তু কেউ করেনি কোনোদিন, আমরা কেন করব? একটা শিক্ষা লাভ হলো। এর ফলে জন্মলাভ করল তেভাগা খামার, সেটা দিয়ে যাত্রা শুরু। তেভাগা খামারে চাষ করতে গিয়ে আবার সমস্যা হলো। ইরি ধান চাষ করতে গেলে লাইন ধরে রোপা লাগাতে হয়, এমনিতে তো ধান ছিটিয়ে দিলে ফসল হয়ে যায়। কিন্তু ইরিতে কষ্ট করতে হয়। তো, আমি বললাম, খাবেন যখন, কষ্ট তো করতে হবে। বলে—‘না, বেশি কষ্ট।’ তখন আমি ছাত্রদের সঙ্গে বসলাম। তারা দলে দলে মাঠে নামল, লাইন ধরে ইরি ধানের রোপা লাগাল। পরে অন্যান্য গ্রামেও নজর পড়ল।’
এরপর নারীদের ঋণদানের কাহিনী তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘এরপর যে কাজ শুরু করলাম, সেটা মহিলাদের খুব পছন্দ হলো। মহিলাদের হাতে ঋণ দিলাম, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা। ৫ টাকা, ১০ টাকায় মানুষ যে এত খুশি হতে পারে জানা ছিল না, কোনোদিন ভাবিওনি। আমি যে মাগনা টাকা দিয়েছি তা না, তাদের বললাম—কাজ করে রোজগার করে টাকা ফেরত দিতে হবে। তাতেই তারা খুশি। অনেক কাহিনী শুনলাম। তাদের অনেকে তাদের নিজের নাম পর্যন্ত বলতে পারে না। আমাদের সমাজ এমন, তাদের নাম জানারও সুযোগ করে দেয় না। ছোটবেলায় অমুকের মেয়ে, বিয়ে হলে অমুকের বউ, মা হলে অমুকের মা, সে যে কে, সে নিজেও জানে না। আমরা প্রথম চেষ্টা করলাম, আমাদের ছাত্রীদের দিয়ে কোনোভাবে তার নামটা বের করার জন্য, হয়তো কোনো একসময় তার নাম একটা ছিল অথবা মনে না পড়লে একটা নতুন নাম দেওয়া যাতে করে সেটা সে লিখতে পারে। এভাবে লেখা শেখানো। এই লেখা শেখাতে গিয়ে তার জীবনের অনেক কাহিনী আসল। প্রতি কাহিনী একটার চাইতে একটা চমৎকার।’
সমাবর্তন বক্তা বলেন, ‘এর থেকে আমি একটা সিদ্ধান্তে আসলাম, সভা-সমিতিতে বললাম, লেখালেখিতে বললাম—ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার। মানুষ হাসাহাসি করল। আপনি ঋণের কথা বলেন, অধিকারের কথাও বলেন—এটা কী ধরনের কথা! অর্থনীতিতে তো অধিকারের বিষয় নেই। অনেক খটকা, তা-ও আবার মানবিক অধিকার, একটা খটকার পর আরেকটা খটকা। তারপর বললাম, আমরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবো। বলে—‘আপনি কে জাদুঘরে পাঠাবেন।’ আমি বললাম—আমি আপনার মতোই একজন মানুষ। তখন বলল—‘এটা আপনার কাজ না, এটা সরকারের কাজ।’ আমি বললাম—আমি আমার কাজ করি, সরকার আমাকে বাধা দিলে দেখা যাবে। জোবরার মহিলাদের কাছ থেকে নতুন অর্থনীতি শিখলাম। জোবরা গ্রাম আমার জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। আজ পর্যন্ত যা করে যাচ্ছি, তা জোবরা থেকে যা শিখেছি তার বহিঃপ্রকাশ। আজ অর্থনীতি যা পড়াচ্ছি, সেটা ব্যবসার অর্থনীতি, মানুষের অর্থনীতি না। আমাদের মানুষের অর্থনীতি গড়তে হবে।’
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন সভাপতি ও চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, ‘আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করেছি। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর জীবনের অর্জনগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক রয়েছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। প্রধান অতিথি এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে দিনটি পূর্ণতা পেয়েছে।’
সমাবর্তনে প্রধান উপদেষ্টাকে ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ৪২ জনকে পিএইচডি ও ৩৩ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৯ বছর পর চবির সমাবর্তনে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ২২ হাজার ৬৮৬ জন শিক্ষার্থী। অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েটরা তাঁদের মা–বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এক মিলনমেলায় পরিণত হয়।
চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস. এম. এ. ফায়েজ, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ ছাড়া চবি উপ–উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, শিক্ষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রথম সমাবর্তন, ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়, ২০০৮ সালে তৃতীয় এবং ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না জবি শিক্ষার্থীরা। চলমান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পক্ষে জবি ছাত্রদলের সদস্যসচিব সামসুল আরেফিন এ কথা বলেন...
১ ঘণ্টা আগেপুলিশি হেফাজত থেকে যুবক পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আজ বুধবার বরিশাল স্টিমারঘাট পুলিশ ফাঁড়ির দুই কর্মকর্তাসহ চারজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কর্মকর্তারা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) রেজা ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাহবুব। বাকি দুজন কনস্টেবল।
৩ ঘণ্টা আগেসিরাজগঞ্জে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নিহত শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য (২৫)। আজ বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়াবেড়া ইউনিয়নের সরাতৈল গ্রামে সরাতৈল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা হয়। পরে তাঁকে দাফন করা হয় পাশের জান্নাতুল বাকি...
৩ ঘণ্টা আগেশিক্ষার মান উন্নয়নে শিল্প খাতের মতামত জরুরি উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, শিক্ষার সঙ্গে শিল্প ও চাকরির প্রয়োজনীয়তার মধ্যে বড় একটি ব্যবধান রয়েছে। তাই পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, হাতে-কলমে শেখার সুযোগ ও ক্যারিয়ার গাইডেন্সের গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীর ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে...
৩ ঘণ্টা আগে