Ajker Patrika

নারীর জন্য শান্তির বাড়ি

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
নারীর জন্য শান্তির বাড়ি

ঢাকা শহরের লালমাটিয়া এলাকার আর দশটা সাধারণ ভবনের মতোই। লিফটে পাঁচতলায় উঠে ডান দিকের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দেখা মিলবে অনেক জুতার। কলবেল চাপ দিতেই খুলে যাবে দরজা। ভেতরে উঁকি দিতেই নানান বয়সী বেশ কয়েকজন নারী সেখানে। তাঁদের কেউ বই পড়ছেন এক কোণে, কোথাও জমে উঠেছে আড্ডা, কেউ রান্নাবান্না করছেন। দৃশ্যটা প্রথমে চোখে ধাক্কা মারে। কিন্তু চোখ ও মনে সয়ে গেলে তার অন্য কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায়।

ছেলেবেলায় রান্নাবাটি খেলে বয়সের একটা স্তর পার করার পর নিজেকে অনেক ভাগে ভাগ করে ফেলেন। এত সব ভাগের মধ্যে নিজের জন্য নিজেকে রাখতেই ভুলে যান। ভুলে যান নিজের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার খোঁজখবর নিতেও। আর বয়স বাড়লে এসব থেকে তৈরি হয় হতাশা ও বিষণ্নতা।

শান্তিবাড়িতে চলছে নারীদের নির্মল আড্ডানিজের কাজ, বাসা—সব মিলিয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন সাবরিন শারমিন। নিজেকে সময় দিতে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে বের হতেন। ঘুরতে ঘুরতেই তিনি একদিন চলে আসেন মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকার শান্তিবাড়ি নামের বাসায়। এখানে চাইলে নিজের মতো করে একা একা বসে থাকা যায়, আড্ডা দেওয়া যায়, মন খুলে হাসা যায়। এখানে নিজের অনেক কথা মন খুলে বলতে পারেন শারমিন। এখানে তাঁর কথা, কাপড়, চুল কিংবা গায়ের রং দেখে কেউ তাঁকে বিচার করে না। যতটা সময় এখানে অবস্থান করেন, থাকেন নির্ভার। বিষণ্নতা তাঁর কাছে আসতে পারে না। এই বাড়িতেই তিনি নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাউন্সেলিং নেন। শারমিন জানান, এখন মানসিকভাবে অনেকটাই ভারমুক্ত।

‘শান্তিবাড়ি’ নারীদের জন্য এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে তাঁরা নিজেদের মতো করে সময় কাটান। প্রতিষ্ঠানটি নারীর মানসিক স্বাস্থ্য এবং আইনি অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে। ভিন্ন পেশার ছয়জন বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করা হয় শান্তিবাড়ি। তাঁদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট শারমিন শামস, সাংবাদিক শুমী শাহাবুদ্দিন, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ ভৌমিক, আইনজীবী নাহিদ শামস, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা কিশোয়ার জাবিন এবং প্রকৌশলী অপরাজিতা গোস্বামী।

পেশাগত কারণে বিভিন্ন সময় অনেক মেয়ের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন শারমিন শামস। শান্তিবাড়ির সহ-উদ্যোক্তা ও নির্বাহী পরিচালক শারমিন বলেন, ‘যখন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, অনেক মেয়েই আসতেন এবং নিজেদের সমস্যার কথা বলতেন। আইনি ও মানসিক সহায়তার জন্য আসতেন তাঁরা। কথা বলতাম। কিন্তু সেভাবে তাঁদের সঙ্গে লেগে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই এই প্রতিষ্ঠানের চিন্তা মাথায় আসে। এখান থেকে একজন মেয়েকে সাহায্য করা হবে এবং তাঁদের ফলোআপে রাখা যাবে, যাতে পরে তাঁরা আবারও একই সমস্যার সম্মুখীন না হন।’ শারমিন জানান, অভিজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত মনোবিদেরা এখানে মানসিক কাউন্সেলিং ও থেরাপি দেন; পাশাপাশি আইনজীবীরা আইনি পরামর্শ ও সেবা দেন। মন খুলে কথা বলা, নিজের সমস্যা ভাগাভাগি করা এবং পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ করে দেয় এই প্রতিষ্ঠান। এসবের বাইরে মনোরোগ, নারীর স্বাস্থ্য, নারীর মন, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, পারিবারিক সমস্যা, প্যারেন্টিং, আইনি অধিকার, ইয়োগা, মেডিটেশনসহ নানান বিষয়ে সেশন হয় শান্তিবাড়িতে।

শান্তিবাড়িতে মেয়েদের আইনি পরামর্শ ও সাহায্য দিয়ে থাকেন আইনজীবী নাহিদ শামস। তিনি বলেন, ‘যাঁরা এখানে আসেন, আমরা প্রথমে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা বোঝার চেষ্টা করি। সেটা কীভাবে সমাধান করা যায়, আগে সেটা নিয়ে ভাবি। সরাসরি আইনি লড়াইয়ে না গিয়েও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমরা সেভাবেও সমাধানের চেষ্টা করি, কাউন্সেলিং করি।’

শান্তিবাড়ি লাইব্রেরিতে বই পড়ার সুযোগ আছে। আরও আছে সবুজ শান্ত ছোট্ট একটি পরিসর, ভার্জিনিয়া উলফ কর্নার। সেখানে লেখালেখি ও নিজের কাজ করার ব্যবস্থা আছে। আছে ছোট্ট একটি ক্যাফে, চ্যারিটি মর্গান ক্যাফে কর্নার। সেখানে চা এবং বিভিন্ন মজাদার নিরামিষ খাবার কিনে খেতে পারবেন আগত নারীরা। এ ছাড়া শান্তিবাড়িতে আছে নারী উদ্যোক্তাদের নিজস্ব পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য একটি কর্নার, মাদার ওয়াকার উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর কর্নার। এখানে পণ্য দেখার ও কেনার সুযোগ আছে; পাশাপাশি কিছু তাঁতের শাড়িও রয়েছে।

শারমিন শামস জানান, এখানে উদ্যোক্তাদের নিয়ে তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজনের চেষ্টা করেন তাঁরা।

শান্তিবাড়িতে বছরজুড়ে চিত্রকলা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ঋতুভিত্তিক আড্ডা, গানের জলসা, স্বরচিত লেখা পাঠের আসর ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে নারীরা তাঁদের শিল্পকর্ম, চিত্র প্রদর্শনী ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারেন স্বল্প খরচে।

এই শহরে, এই অস্থির সময়ে শান্তিবাড়ি নারীদের জন্য শান্তির জায়গা। প্রাণে প্রাণ মেলানোর জায়গা। কিছুটা স্বস্তির জায়গা। এখানকার বিভিন্ন আয়োজন পুরো বিষয়কে রঙিন করে রাখে।

শান্তিবাড়িতে চলছে নারীদের নির্মল আড্ডা। ছবি: জাহিদুল ইসলাম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত