Ajker Patrika

আইনজীবীদের সাদাকালোর সীমানা পেরিয়ে মিতার গল্প

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
মাসুমা মিথিলা।
মাসুমা মিথিলা।

সেগুনবাগিচার স্বজন টাওয়ার ২-এর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে একটি নম্বর ডায়াল করলাম। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘চলে এসেছেন? ওপরে আসুন।’ লিফট দিয়ে উঠে যাঁর ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলাম, তাঁর নাম মাসুমা মিথিলা। পেশায় আইনজীবী, বসার ঘর দেখলে সেটা বোঝা যায়। মেঝে থেকে সিলিংছোঁয়া কাঠের তাকে সারি সারি ফাইল, কাগজ আর বই। একদিকে সোফা, অন্যদিকে একটু আলাদা করে অফিস ঘর। টেবিলের ওপরে ফাইলপত্র আর কম্পিউটার দেখে বোঝা যাচ্ছে, সেখানে আরও মানুষ কাজ করেন। আমি পাশের একটি ঘরে গিয়ে বসলাম। সেখানেও আইনের মোটা বই আর ফাইল সাজানো দেয়ালজুড়ে।

‘আমাকে দেখে অগোছালো মনে হলেও আমি কিন্তু জানি, কোথায় কী রেখেছি’, বলতে বলতে সাদাকালো লম্বা চুল, পরনে শাড়ি আর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়া হাসি নিয়ে যিনি এসে সামনে দাঁড়ালেন, তিনিই মিথিলা। দেখলেই বোঝা যায়, নিজের পেশাকে ভালোবেসেও মানুষ নিজের সৃজনশীলতা কতভাবে বিস্তৃত করতে পারেন!

মাসুমা মিথিলা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। শুরুতেই বললেন, ‘আমি যা করব, তার জন্য আগে নিজেকে প্রস্তুত করি। কোনো কাজ করার আগে নিজেকে বারবার বলি, আমি এটা করব, এটা করব। শেষ পর্যন্ত আমি সফল হই।’ এটাই মিথিলার কাজের সফলতার মূলমন্ত্র।

মিথিলার বাবা ছিলেন গ্রামপ্রধান, মানে মাতব্বর। এলাকার বিচার-সালিস আর সামাজিকতায় তাঁর উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। সে কারণে মানিকগঞ্জে থাকাকালীন বিভিন্ন নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মিথিলার। নিজের ছোট্ট পড়ার ঘরে অনেকে তাঁর সঙ্গে মনের কথা ভাগাভাগি করেছেন। সেখান থেকে মূলত আইনজীবী হওয়াকে নিজের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলেন মিথিলা। তাই বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ইডেন কলেজ থেকে বিএসএসের পর সমাজকল্যাণ বিষয়ে মাস্টার্স করেন তিনি। এই সময়ে পড়েছেন এলএলবি আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে। ২০০৪ সাল থেকে তিনি ডকুমেন্টেশনের কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সাল থেকে জজকোর্টে কাজ শুরু। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেছেন। ২০১৩ সাল থেকে হাইকোর্টে কাজ শুরু তাঁর। বর্তমানে কোম্পানি ল নিয়ে কাজ করছেন মিথিলা। নিজের বাড়িতে করেছেন চেম্বার। সেখানেই পেশার সঙ্গে নিজের প্যাশনের একটা দারুণ মিশেল ঘটিয়েছেন।

মিতার গল্প

মিথিলার উদ্যোগের নাম মিতার গল্প। মিতার গল্প নামটি এসেছে মিথিলা ও তানিয়া নামের প্রথম অক্ষর থেকে। মিতার গল্প আইনের কথা বলে, আইনজীবীদের কথা বলে। নিজের প্রতিষ্ঠানের পোশাক ডিজাইন করতে গিয়ে তিনি ব্যবহার শুরু করেন আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন আইনি চিহ্ন আর আইনজীবীদের ব্যবহৃত পেশাগত শব্দ। এই থিমই আদালত প্রাঙ্গণে মিথিলাকে একটা ভিন্ন পরিচিতি এনে দিয়েছে। তাঁর ডিজাইন করা শাড়িতে কখনো ফুটে উঠেছে আইনবিষয়ক বিভিন্ন মোটিফ, আবার কখনো বিভিন্ন পরিভাষা।

কাজের আনন্দ আর উৎসাহ আমাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়, কাজের শক্তি দেয়।

আমরা যখন কথা বলছিলাম, সে সময় মিথিলার পরনে যে শাড়ি ছিল, তার জমিনজুড়ে লেখা ছিল ‘সু ইউ সুন’। এ ছাড়া ফ্রিদা, ইয়োগা ইত্যাদি থিম নিয়ে কাজ করেছেন মিথিলা।

মিতার গল্পে কাজ করছেন ১৫ জন। তাঁদের কেউ বুননের সঙ্গে জড়িত, কেউ বাটিক করেন, কেউবা সেলাই। সব মিলিয়ে মিতার গল্পের সংসার। ব্লাউজের ডিজাইন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ আছে মিথিলার। একটা সময় বিভিন্ন ব্লাউজের ডিজাইন নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। কাজ করেছেন বিশ্বরঙ ও গ্রামীণ চেকের মতো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এবার নিজের প্রতিষ্ঠানে আইন বিষয়ের বিভিন্ন থিম নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হাঁটতে চান মিথিলা।

যাত্রাজুড়ে আইন

কোনো এক সুবর্ণ সকালে মিথিলা আইন পেশার সঙ্গে পোশাক নকশার কাজ শুরু করেননি। রীতিমতো লেখাপড়া করে, বিভিন্ন ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করতে করতেই বেছে নিয়েছেন নিজের পথ। ২০২২ তিনি আদালত প্রাঙ্গণে নিজের নকশা করা পোশাকের প্রদর্শনী করেন; যা আদালত প্রাঙ্গণের আইনজীবীদের সাদাকালো জীবনে একটু ভিন্নতা এনেছিল। মিথিলার নকশা করা শাড়ি পরে অনেকে বিভিন্ন পুরস্কার নিতে গেছেন, সেসবকে নিজের জীবনের আনন্দের অংশ হিসেবে দেখেন তিনি।

ল্যান্ডমার্ক ল

শুধু যে আইনের মোটিফ আর পরিভাষা তাঁর পোশাকের থিম হয়েছে, তা-ই নয়। মিথিলা দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন বা ল্যান্ডমার্ক ল-কেও পোশাকের নকশায় ব্যবহার করেছেন। এই সিরিজের প্রথম কাজ ছিল ২০২২ সালের এক্সিবিশনে। সেখানে ডিএলআর ৪৮ এই মামলার রায়ে আপিল বিভাগ স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। এই জাজমেন্ট দিয়ে প্রথম শাড়ি ডিজাইন করেছিলেন মিথিলা। ২০২৩ সালে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকেও স্বীকৃতি দেয় হাইকোর্টের একটি রায়। সেই বিখ্যাত রায়ের পেছনের মানুষদের নাম দিয়ে তিনি নকশা করেছিলেন একটি শাড়ি। এসব শাড়ি আদালতের সাদাকালো পোশাকের জমিনে ছড়িয়ে দিয়েছে রং। তাঁর সহকর্মীরা সাদরে গ্রহণ করেছেন মিথিলার কাজ। মিথিলা আরও বলেছেন, ‘সবাই জিনিসটাকে এত সুন্দর করে গ্রহণ করবেন, এটা নিজেই কল্পনা করিনি।’

এবং ক্যানসার

ঐক্য ফাউন্ডেশনের হেড অব লিগ্যাল মাসুমা মিথিলা একজন সচেতন আইনজীবী ও নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করেন। কিন্তু এই ব্যস্ততার পাখা টেনে ধরতে চেয়েছিল ক্যানসার। সালটা ২০২২। মিথিলা জানতে পারেন, ক্যানসার বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। সে বছরই অপারেশন সেরে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা করে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর মিতার গল্পের যাত্রা শুরু করেন উদ্যোক্তা হিসেবে।

মাসুমা মিথিলার একটি মেয়ে। লেখাপড়া করছেন শিলিগুড়ির একটি স্কুলে, ক্লাস নাইনে। মিথিলা বলেন, ‘আমার স্ট্রাগলটা আমার মেয়ের কাছ থেকে আড়াল রাখতে চেয়েছি। ও অনেক সাহসী।’ আদালত, কেস আর উদ্যোগের কাজ সামলে ক্লান্ত লাগে না? মিথিলা খুব সুন্দর করে হাসলেন। বললেন, ইচ্ছাশক্তি অনেক বড় ব্যাপার। তাঁর জীবন আবর্তিত হচ্ছে সন্তান, আদালত, উদ্যোগ আর নিজেকে নিয়ে।

লইয়ার্স ওয়েলবিয়িং ক্লাব

শিগগির মিথিলা নিয়ে আসছেন তাঁর নতুন উদ্যোগ লইয়ার্স ওয়েলবিং ক্লাব। ৬৪টি জেলায় এই ক্লাব থাকবে বলে আশা প্রকাশ করছেন তিনি। এখানে আইনজীবীদের গ্রুমিং করা হবে। আইনজীবীদের এটিকেটসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করবে ক্লাবটি।

মিথিলা যেমন জানেন, তাঁর কাগজভর্তি টেবিলে কোন ফাইলের নিচে কোন রায়ের খসড়া লেখা আছে, তেমনি এ-ও জানেন, পেশাকে কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে উপভোগ করতে হয়। সে জন্যই তিনি নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থেকে বেঁচে থাকতে চান হেসেখেলে। মিথিলা বলেন, ‘আমি জানি না, কোথায় যাচ্ছি; কিন্তু সব সময় আমার পথে আছি।’

কথা শেষ করে রেকর্ডার বন্ধ করলাম। আরও কিছুক্ষণ তাঁর বাড়িতে ঘুরে ঘুরে তাঁর নকশা করা শাড়িগুলো দেখালেন মিথিলা। সব শেষে তাঁর সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বিদায় জানালেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ, শান্তি রক্ষা মিশনের এক-চতুর্থাংশ ছাঁটাই করছে জাতিসংঘ

১২ অক্টোবর থেকে ৫ কোটি শিশুকে বিনা মূল্যে টাইফয়েড টিকা, টাকা চাইলে ব্যবস্থা

গাজায় থেমে গেছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান–কামানের গর্জন, ২ বছর পর শান্তির ঘুমে গাজাবাসী

৯ গোলের দুঃস্বপ্ন থেকে মশার যন্ত্রণা, বাংলাদেশ-হংকং লড়াইয়ে আরও যা ঘটেছে

সবচেয়ে প্রভাবশালী ৪ মিডিয়ার লাগাম এখন ৪ শীর্ষ ধনীর হাতে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত