Ajker Patrika

ছবির জীবন, জীবনের ছবি

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
ছবির জীবন, জীবনের ছবি

ষাটের দশকে রাঙামাটির তবলছড়ি ঠিক এখনকার মতো ছিল না। পাহাড়ের গায়ে ক্ষত ছিল না, বন ছিল আরও ঘন, প্রকৃতি ছিল রঙিন। সেই পাহাড়, অরণ্য আর রঙিন প্রকৃতির মাঝে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কনক চাঁপা চাকমার। তারপর এসেছেন রাজধানীতে, লেখাপড়ার সুবাদে। গেছেন আমেরিকা। তা-ও লেখাপড়ার সুবাদে। সময় আর অভিজ্ঞতা তাঁকে করেছে সমৃদ্ধ। সেই সমৃদ্ধ জীবনের ছায়া পড়েছে তাঁর চিত্রকর্মে। সেসবের হাত ধরে এসেছে দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার। এবার সেই মুকুটে যুক্ত হলো দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক। 

একজন বিনয়ী মানুষ
অভিনন্দন জানাতে গিয়ে কথা হলো বরেণ্য শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার সঙ্গে। ভীষণ বিনয় ফুটে উঠল তাঁর অবয়বে। অনুভূতির কথা জানতে চাইলাম। কনক চাঁপা বললেন, ‘আমি আমার চিত্রশিল্পীজীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু আমার দেশ সম্মান দিয়েছে, পুরস্কৃত করেছে, সেটি আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। এর চেয়ে বড় অর্জন আর কিছু হয় না।’ 

জীবনের পথে পথে
কনক চাঁপার মা শরৎ মালা চাকমা ছিলেন একজন বুননশিল্পী। চাকমা সম্প্রদায়ের বস্ত্র বয়নের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তি চরিত্র। এ জন্য তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। সেই শিল্পিত পরিবেশে ছেলেবেলায় চক আর কয়লা দিয়ে ছবি আঁকার হাতেখড়ি কনক চাঁপার। আজও চারুকলায় পড়তে আসার জন্য মা-বাবার সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় অনেক ছেলেমেয়েকে। কনক চাঁপার অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। ছেলেবেলায় চক, কয়লা দিয়ে ছবি আঁকতে আগ্রহী কনক চাঁপাকে নিজের স্বপ্ন থেকে আলাদা করেননি তাঁর মা-বাবা। তাঁরা আনন্দের সঙ্গেই তাঁকে চারুকলায় ভর্তি করিয়ে দেন।

ফলে চারুকলার জীবন আনন্দপূর্ণ আর কর্মময় কেটেছে কনক চাঁপার। ‘শিল্পী হতেই হবে’—এই বিশ্বাসে তিনি যেকোনো কষ্ট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হওয়ার জন্য তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন নিজের লক্ষ্যের দিকে। নিজের এই কৃতিত্ব আর কাজ করার স্বাধীনতার জন্য মা-বাবার পাশাপাশি নিজের জীবনসঙ্গীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কনক চাঁপা। পরিবারের সহযোগিতা অনেক বড় বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স অব ফাইন আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন কনক চাঁপা চাকমা। এরপর তিনি মিড-আমেরিকান আর্টস অ্যালায়েন্স ফেলোশিপ নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। পড়ালেখা শেষ করে ফিরে আসেন দেশে।

তত দিনে জীবনের বেশ খানিকটা পথ হেঁটে ফেলেছেন তিনি। দেখেছেন মানুষ আর প্রকৃতি। অর্জন করেছেন বিবিধ অভিজ্ঞতা। ক্রমে ছোটবেলার সেই চক ও কয়লা বিভিন্ন মিডিয়ামের রং ও তুলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বেড়েছে। বিদগ্ধ জীবন ও দক্ষ হাতের স্পর্শে ক্যানভাসগুলো আরও পল্লবিত হয়েছে, জীবনমুখী ও উজ্জ্বল হয়েছে। তাঁর রেখা ও চরিত্রগুলো এখন জীবনের কথা বলে। সেই জীবন পাহাড়ের, সেই জীবন এক ভিন্ন বাংলাদেশের। 

স্টুডিওতে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কাজ করেন কনক চাঁপা চাকমাছবির জীবন
পাহাড় থেকে সমতলে এসে নিজের অস্তিত্ব আলাদা করে সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা খুব সাধারণ কথা নয়। যাত্রাটা কখনোই রংতুলির আঁচড়ের মতো পেলব নয়। তবু এই যাত্রায় নিজেকে ক্রমেই বিকশিত করেছেন এবং করে যাচ্ছেন কনক চাঁপা চাকমা। রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা, সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, সংগ্রাম, প্রকৃতি—এসব অনুপ্রেরণা দিয়েছে তাঁকে। তাঁর তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠেছে সেই প্রকৃতি, নারীর জীবন, তাদের সংগ্রাম, বাধা, জীবনধারা।

চিত্রকর্মে নারীর জীবনের নানান দিক বিভিন্ন রঙে ফুটিয়ে তোলেন কনক চাঁপা। নারীকে চিত্রকর্মে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে রয়েছে তাঁর নিজস্ব মতামত। নারীর বঞ্চনা, তাদের কষ্ট, সমাজে উপেক্ষিত হওয়া—সব মিলিয়ে তিনি তাদের লড়াইটা তুলে ধরতে চান সব সময়। তাদের শ্রম, মেধা কখনোই সমাজ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে না বলেই মনে করেন কনক চাঁপা। একটি সংসারের অর্ধেক ভার যখন নারীর কাঁধে, তখন তাদের সঠিক মূল্যায়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি। আর এমন ভাবনা থেকে কনক চাঁপা তাঁর চিত্রকর্মে নারীকে প্রাধান্য দেন বেশি। নারীর দৈহিক আর বাহ্যিক ছন্দের বাইরেও তাদের মন, ভালোবাসা, বিকশিত হওয়ার ইচ্ছাশক্তিকে চিত্রকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরেন। 

শিক্ষাটা চলমান প্রক্রিয়া
পুরো জীবনটাই শিক্ষার—এই বিশ্বাস কনক চাঁপার। ফলে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু শিখে চলেছেন তিনি। বললেন, ‘আমি এখনো শিখছি, এখনো কাজ করছি। যত দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকব, আমি কাজ করে যেতে চাই।’ প্রতিদিন নিজের স্টুডিওতে তিনি একটানা সময় ব্যয় করেন চার ঘণ্টা। এরপর কিছুটা বিরতি। তারপর আবারও কাজ। ক্যানভাসের পর ক্যানভাস, চরিত্রের পর চরিত্র আঁকা হয়ে যায় ততক্ষণে। কখনো কখনো নিজেই তাকিয়ে থাকেন সেগুলোর দিকে, অপলক।

একুশে পদকের ইতিহাসে, বিশেষ করে চারুকলার ইতিহাসে ২০২০ সালে শিল্পী ফরিদা জামান এবং এ বছর শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার এই রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমাদের চারুশিল্পের ইতিহাসে এই দুই ঘটনার ইতিবাচক প্রভাব থাকবে দীর্ঘকাল। হয়তো এর মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের কনক চাঁপারা। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত