Ajker Patrika

বিপর্যস্ত নারীদের আত্মবিশ্বাসী হতে দেখাটাই তৃপ্তি

অর্চি হক, ঢাকা
বিপর্যস্ত নারীদের আত্মবিশ্বাসী  হতে দেখাটাই তৃপ্তি

‘হারিয়ে যাওয়া কোনো শিশু বা নারী যখন তাঁর স্বজনদের ফিরে পায়, কিংবা সহিংসতার শিকার বিপর্যস্ত কোনো নারী যখন আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, এ দৃশ্যগুলো দেখার তৃপ্তিটাই অন্য রকম। অসহায় এই মানুষগুলোর প্রতি যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি, তখন মনে হয় এই পেশায় আসাটা সার্থক।’ এ কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার হুমায়রা পারভীন।

সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সাময়িক আশ্রয়, আইনি সেবা এবং সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের কাজ করছে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। বর্তমানে এই ডিভিশনের প্রধান হিসেবে রয়েছেন হুমায়রা পারভীন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন তিনি। 

বদলির চাকরি ছিল বাবার
দুই বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে হুমায়রা বড়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন হুমায়রার বাবা আশরাফ আলম খান। বাবার বদলির চাকরি, তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় হুমায়রার কেটেছে জীবনের অনেকটা সময়। আর তাই ঘুরে দেখাও হয়ে গেছে বাংলাদেশটা। হুমায়রা জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা এবং ঘুরে দেখার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি আছে কষ্টও। পড়তে হয়েছে সাতটি স্কুলে। বছর বছর বন্ধুবান্ধব পরিবর্তন হয়ে যেত, যা ছিল খুবই কষ্টের। বন্ধুদের জন্য, প্রতিবেশীদের জন্য, স্টাফদের জন্য খারাপ লাগত। জীবনের স্মৃতিগুলো একেক জায়গায় ভাগ হয়ে যায়। যেটা খুব কষ্টকর।

ছোটবেলার স্বপ্ন
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি হুমায়রা পারভীন। পুলিশ হওয়ারই স্বপ্ন দেখেছেন। অথচ এ পেশায় আসার আগে পুলিশ নয়, হয়েছেন শিক্ষক। ২০০৫ সালে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। এরপর ২৬তম বিসিএস দিয়ে কলেজের প্রভাষক হন। কিন্তু পুলিশ হওয়ার স্বপ্নটা মাথায় গেঁথে ছিল, তাই শেষমেশ ভাগ্য তাঁকে সেখানেই নিয়ে গেছে। ২৬তম বিসিএসের পর প্রকাশ পায় ২৫তম বিসিএসের ফলাফল। আর সেই বিসিএসেই পুলিশ ক্যাডার নির্বাচিত হন তিনি।

পরিবার থেকে উৎসাহ
আমাদের দেশে মেয়েদের সমস্যা কি কম? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা পেশায় নারীদের আসাটাকে অনেকেই সহজভাবে নেয় না। পরিবার থেকেও আসে বাধা। তবে হুমায়রা পারভীন সে রকম কোনো বাধা পাননি। পুলিশ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। হুমায়রা বলেন, ‘পরিবার থেকে কখনো বাধা পাইনি, বরং উৎসাহ পেয়েছি। সব সময় বাবা উৎসাহ দিয়েছেন। আর আমার স্বামী সব সময় পাশে থেকেছেন। তা না হলে এত দূর আসা হয়তো সম্ভব হতো না।’ হুমায়রা পারভীনের স্বামী তারেক বিন রশিদ বর্তমানে পুলিশের ডিটেকটিভ শাখায় কর্মরত আছেন।

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন হুমায়রা পারভীনচ্যালেঞ্জ তো থাকবেই
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ চ্যালেঞ্জিংও বটে। প্রায় ১৭ বছর কাজ করছেন পুলিশে। চাকরিটাকে কীভাবে দেখেন তিনি? হুমায়রা পারভীন বলেন, ‘যেকোনো কাজই চ্যালেঞ্জিং। পুলিশের কাজটা তো অবশ্যই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে, সেটা জেনেই তো পুলিশে আসা। অন্য চাকরিতে নয়টা-পাঁচটা অফিস। আমাদের সে অর্থে সময় নির্ধারণ করা নেই। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অফিস চলে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মনিটরিং– এসবের জন্য শারীরিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবেও সুস্থ হতে হয়।’

হুমায়রা দুই বছর ট্রাফিক ডিভিশনে কাজ করেছেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করেন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ নারী-পুরুষ–সবার জন্যই কষ্টকর। আমাদের দেশে ট্রাফিকে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। টয়লেটের সুযোগ-সুবিধা থাকে না। তাঁদের চোখ, কান, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাঁরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা তো চাইলেই অফিস বা বাসায় যেতে পারেন না। তাঁদের জন্য অবশ্যই দায়িত্ব পালন করার জায়গায় টয়লেট থাকা দরকার।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জাপানের কিউশু ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতকোত্তর করেছেন হুমায়রা পারভীন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার স্টাডিজে পিএইচডি করেন। এখন জেন্ডার ভায়োলেন্স নিয়ে গবেষণা করছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও জানা হলো হুমায়রা পারভীনের কাছ থেকে। তিনি বললেন, ‘যেহেতু আমি জেন্ডার স্টাডিজে পড়েছি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আমি মেয়েদেরকে নির্যাতিত হতে দেখেছি। তাই মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাই। আশার কথা হলো, নারীদের মধ্যে এখন সচেতনতা বাড়ছে। আগে নিপীড়নের শিকার হয়েও অনেকে মুখ খুলত না, অভিযোগ জানাত না। এখন অভিযোগ জানাবার হার বাড়ছে। এখন নারীরা অনেক সাহসী এবং সচেতন। তবে বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং নিপীড়ন নিরসনে কিছু আইন সংশোধন ও সংযোজন প্রয়োজন। উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমরা এমন ভুক্তভোগী পাই, যাঁদের থাকার কোনো জায়গা নেই। স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হয়েও তাঁরা সেখানে পড়ে থাকেন। তাঁদের হয়তো দুটো সন্তান আছে। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও যেতে পারেন না। 
তাই নারীদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে আইনের সংশোধন ও সংযোজন প্রয়োজন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত