Ajker Patrika

নিজের কোনো বাড়ি নেই শাহনাজের

মো. তারেক রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
নিজের কোনো বাড়ি নেই শাহনাজের

প্রায় ২২ বছর আগে পাঁচ সন্তানসহ শাহনাজ পারভিনকে রেখে অন্যখানে বিয়ে করেন সেরাজুল ইসলাম। স্বামীর জমি ও বসতভিটা না থাকায় শিশুসন্তানদের নিয়ে শাহনাজ আশ্রয় নেন ভাশুরের একটি কুঁড়েঘরে। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে দুই দশকের বেশি সময় ধরে শাহনাজ করে চলেছেন জীবনযুদ্ধ। ধীরে ধীরে প্রতিকূলতা জয় করেছেন। দিয়েছেন চায়ের দোকান। হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য। সন্তানদের স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। সংক্ষেপে এই হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়ন পরিষদের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহনাজ পারভিনের গল্প।

কিন্তু ৪৮ বছরের জীবন তো আর সহজ-সরল পথে চলেনি। গরম চায়ের কেতলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে শাহনাজ পারভিন একদিন সে গল্পই শোনালেন তাঁর দোকানে বসে। সে প্রায় ৩২ বছর আগের ঘটনা। শ্যামপুর ঘোনটোলা এলাকায় পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। তারপর সংসারে একে একে আসে পাঁচ সন্তান। সঙ্গে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে বিচ্ছেদ। পাঁচ সন্তান আর নিজে বাঁচাতে নেমে পড়েন জীবনসংগ্রামে।

শুরু করেন ঝালমুড়ির ব্যবসা। প্রথমে স্কুল-কলেজ এলাকায় ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন শাহনাজ। সেখান থেকে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। শিবগঞ্জের পাইকারি বাজার থেকে কাপড় সংগ্রহ করে খুচরা বিক্রি করতেন বিভিন্ন গ্রামে। কাপড়ের ব্যবসা করে সংসার চালিয়ে পাঁচ ছেলেমেয়ের বিয়ে দেন তিনি। তাঁর বড় ছেলে আমির চাঁদ ব্যবসা করেন, দ্বিতীয় ছেলে নূর আমিন একই এলাকায় আরেকটি চায়ের দোকান চালান। মেয়ে লিসার বিয়ে দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায়। চতুর্থ ছেলে রায়হান পানির পাম্পের মিস্ত্রি। ছোট ছেলে সিয়াম মায়ের সঙ্গেই থাকে।

বছর তিনেক আগে কিছু টাকা জমিয়ে সাহাপাড়া বাজারে মাসিক ১ হাজার ৬০০ টাকায় জায়গা ভাড়া নিয়ে একটি টিনের ঘর তুলে চায়ের দোকান শুরু করেন শাহনাজ। তখন থেকে এলাকার মানুষ তাঁকে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ শুরু করেন। এলাকাবাসীর অনুরোধেই প্রচারণা শুরু করেন। বিনয়ী ও মিষ্টভাষী হিসেবে পরিচিত শাহনাজ দ্রুতই মানুষের মনে জায়গা করে নেন। পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য হিসেবে।

শাহনাজ জানান, যেদিন বাইরে মিটিং থাকে, সেদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দোকান খুলে ঘণ্টাখানেক বিক্রিবাট্টা করে মিটিংয়ে চলে যান। কাজ শেষে আবার বিকেলে দোকান খুলতে হয়। সেখান বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসে লোকজন। চা বিক্রির পাশাপাশি সেখান থাকেই চারিত্রিক সনদসহ বিভিন্ন জরুরি কাগজপত্র স্বাক্ষর করে লোকজনকে দেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সিঙ্গাপুরে ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিল—জেলের ভয়ে ছিলেন ৩ নারী, কিন্তু ঘটল উল্টো

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৩৫
সিঙ্গাপুরে ফিলিস্তিনপন্থী মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই তিন নারী। ছবি: দ্য ইনডিপেনডেন্ট
সিঙ্গাপুরে ফিলিস্তিনপন্থী মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই তিন নারী। ছবি: দ্য ইনডিপেনডেন্ট

সিঙ্গাপুরের কঠোর আইনব্যবস্থার মধ্যে এক নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিন তরুণী—সিতি আমিরাহ মোহাম্মদ আসররি, কোকিলা আন্নামালাই ও মোসাম্মদ সবিকুন নাহার। ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল আয়োজনের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।

রোববার (২ নভেম্বর) যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, দেশটির ‘পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, অনুযায়ী তাঁরা সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার জরিমানার মুখে পড়তে পারতেন। কিন্তু বিচারক জন এনজি সম্প্রতি তাঁদের নির্দোষ ঘোষণা করেছেন। এই রায় পুরো সিঙ্গাপুরকেই অবাক করে দিয়েছে।

এই তিন নারী ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে প্রায় ৭০ জনকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের দপ্তর অভিমুখে এক শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা করেন। তাঁদের দাবি ছিল—ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সিঙ্গাপুর যেন তেলআবিবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। গাজার চলমান যুদ্ধে হাজারো ফিলিস্তিনির মৃত্যু তাঁদের গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।

এদিকে প্রসিকিউশন পক্ষ অভিযোগ তোলে, তাঁরা অনুমতি ছাড়া একটি ‘অবৈধ মিছিল’ আয়োজন করেছেন, যা প্রেসিডেন্টের ভবন ‘ইস্তানা’ এর সংরক্ষিত এলাকার পাশ দিয়ে গেছে।

কিন্তু বিচারক এনজি তাঁর রায়ে বলেছেন—রাস্তার কোথাও সংরক্ষিত এলাকার কোনো চিহ্ন ছিল না এবং প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, অভিযুক্তরা জানতেন তাঁরা কোনো নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করছেন। এই প্রযুক্তিগত দিকই মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

৩৭ বছর বয়সী আন্নামালাই বলেন, ‘আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম আমরা দোষী সাব্যস্ত হব। এমনকি রায় ঘোষণার পর আদালতে প্রতিবাদী বক্তব্য পড়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম।’ খালাসের ঘোষণায় আদালতকক্ষে নেমে আসে এক অপ্রত্যাশিত স্বস্তি, নিঃশব্দ উল্লাস।

২৬ বছর বয়সী সবিকুন নাহার জানান, প্রচার পাওয়া নয়, বরং নৈতিক দায়বোধ থেকেই ওই মিছিলের আয়োজন করেছিলেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘গাজার মানুষের যন্ত্রণা দেখে মনে হয়েছে কিছু না কিছু করা জরুরি।’

তাঁদের মতে, সিঙ্গাপুরে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বা প্রতিবাদে অংশ নিতে ভয় পায়। তাই এই রায় সমাজে সাহস জোগাবে।

রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু তরুণ তাঁদের ‘আশার প্রতীক’ হিসেবে বরণ করেছেন। অনেকেই মনে করেন, এই রায় সিঙ্গাপুরে ভিন্নমত প্রকাশের সংস্কৃতিতে এক ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

আন্নামালাই বলেন, ‘এই জয় শুধু তিনজনের নয়; এটা সেই সব মানুষের বিজয় যারা ভয়কে অতিক্রম করে সাহসের পক্ষে দাঁড়াতে চায়। সিস্টেম আমাদের বিরুদ্ধে হলেও, লড়াই চালিয়ে যাওয়াই আসল শক্তি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নারীর বৈতনিক ও অবৈতনিক কর্মঘণ্টা কত

ফিচার ডেস্ক
ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।
ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।

বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে নারী ও পুরুষের কাজের সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। তবে এই পার্থক্য সরাসরি আইনি বাধ্যবাধকতার ফল নয়; বরং এটি মূলত গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের প্রতিফলন। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নত দেশগুলোতে, নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি হারে খণ্ডকালীন কাজ করেন। এর ফলে, গড়ে তাঁদের প্রতি সপ্তাহে বেতনভুক্ত কাজের সময় পুরুষের তুলনায় কম হয়। তবে এটি কোনো আইনের কারণে হয়নি। আইন দিয়ে যা করা হয়েছে, তা আফগানিস্তানে। সেটি অবশ্য নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নয়, বরং নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে প্রায় ২৮ শতাংশ কর্মজীবী ​​নারী খণ্ডকালীন কাজ করেন। যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৮ শতাংশ। সেই পরিসংখ্যান থেকে হিসাব করলে বলা যায়, নারীদের কর্মঘণ্টা কম। তবে তা লৈঙ্গিক হিসাবের কারণে নয়। এই পার্থক্যের প্রধান কারণ হলো সামাজিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগত লৈঙ্গিক ভূমিকা। সমাজ ও পরিবারে যত্নের দায়িত্ব নারীদের ওপর বর্তানোর কারণে কর্মক্ষেত্রে নারীরা নমনীয়তা বা কম সময়ের কাজের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। এ ছাড়া করকাঠামো এবং শ্রমবাজারের নীতিগুলোও নারী ও পুরুষের কাজের সিদ্ধান্তকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যে মহাদেশ বা অঞ্চলে শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও পারিবারিক দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে, সেখানে সামগ্রিকভাবে উভয় লিঙ্গের জন্যই কম বেতনভুক্ত কাজের সময় দেখা যায়।

এশিয়ার কিছু দেশ; যেমন ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া বা বড় অনানুষ্ঠানিক খাত রয়েছে এমন দেশগুলোতে, পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য খুব উচ্চ বার্ষিক বেতনভুক্ত কাজের হার দেখা যায়। ফ্রান্স, ডেনমার্ক বা নরওয়ের মতো কিছু ইউরোপীয় দেশে সাধারণত পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩৫ থেকে ৩৯ কর্মঘণ্টা প্রচলিত। তবে নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে নারী কর্মীদের একটি বড় অংশ প্রতি সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার কম কাজ করেন। উত্তর আমেরিকায়; যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, পূর্ণকালীন কর্মরত নারীরা পুরুষদের তুলনায় গড়ে দৈনিক সামান্য কম ঘণ্টা কাজ করেন। যেমন নারীদের জন্য প্রতিদিন ৭ দশমিক ৯ ঘণ্টা এবং পুরুষদের জন্য ৮ দশমিক ৪ ঘণ্টা প্রচলিত আছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি সময় অবৈতনিক কাজে; যেমন গৃহস্থালি, সন্তান ও আত্মীয়দের যত্নের পেছনে ব্যয় করেন। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের ২০২৪ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭৪৮ মিলিয়ন মানুষ পরিচর্যার দায়িত্বের কারণে শ্রমবাজারের বাইরে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৭০৮ মিলিয়ন নারী। এতে অঞ্চলভিত্তিক; যেমন উত্তর আফ্রিকা, আরব রাষ্ট্র, ইউরোপের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, গড়ে পুরুষদের তুলনায় প্রতিদিন প্রায় আড়াই গুণ বেশি সময় ঘরোয়া ও পরিচর্যার কাজে সময় ব্যয় করেন নারীরা। যখন এই অবৈতনিক সময়কে বেতনভুক্ত কাজের সময়ের সঙ্গে যোগ করা হয়, তখন দেখা যায়, নারীরা পুরুষের চেয়ে সামগ্রিকভাবে বেশি ঘণ্টা কাজ করেন। তবে সেই কর্মঘণ্টার কোনো অর্থমূল্য হয় না। হোক তা ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা কিংবা এশিয়া।

কাজের সময়ের এই লৈঙ্গিকভিত্তিক পার্থক্য মূলত নারীর ওপর অবৈতনিক যত্নের কাজের অস্বাভাবিক বোঝা এবং সামাজিক প্রত্যাশার ফল, যা তাঁদের বেতনভুক্ত কাজের ধরনকে প্রভাবিত করে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শিখতে ও শেখাতে ভালোবাসেন মুক্তা

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১৫
আফরোজা খানম মুক্তা
আফরোজা খানম মুক্তা

‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র/ নানান ভাবের নতুন জিনিস, শিখছি দিবারাত্র।’ কবি সুনির্মল বসুর এই কবিতা সবাই পড়েছি ছোটবেলায়। তবে শিখতে পারার এই আনন্দ সবাই উপলব্ধি করতে পারেন না। কিন্তু যাঁরা পারেন, তাঁরা নিজেকে একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে সফল হন যেকোনোভাবেই। তেমনই একজন মানুষ আফরোজা খানম মুক্তা।

ছোটবেলা থেকে হস্তশিল্প শেখার আগ্রহ তাঁর মায়ের কাজ দেখে। এখনো নতুন নতুন জিনিস তৈরি করা শিখে চলেছেন তিনি। কখনো কাপড়ের ফুল, কখনো চকলেট কিংবা সাবান। ৩০ বছর ধরে নিজের বাড়ির নিচতলায় শৌখিন কারুশিল্প নামের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করছেন তিনি। দু-তিন শিফটে এক শ থেকে দেড় শ শিক্ষার্থী তাঁর কাছে মোম, ব্লক, বাটিক, সাবান তৈরি এবং পুঁতির বিভিন্ন কাজ শেখেন।

হাতেখড়ি ছোটবেলায়

মুক্তা যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন, তখন সাটিনের কাপড় দিয়ে ফুল বানানো শিখেছিলেন। তাঁর বড় বোনের বান্ধবীরা সেই সময় তাঁর কাছে এই ফুল বানানো শিখতে আসেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়ার পাশাপাশি নতুন নতুন কাজ শেখা শুরু করেন বিসিক থেকে। ১৯৯১ সালের দিকে মোটামুটি দক্ষ হয়ে ওঠেন মুক্তা। তাঁর বাবা সুইডেন দূতাবাসে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে একবার রাষ্ট্রদূত আসেন তাঁদের বাসায়। তিনি মুক্তার কাজ দেখে প্রশংসা করেন। বিষয়টি তাঁকে আরও উৎসাহিত করে তোলে।

ধীরে ধীরে বিসিক এবং যুব উন্নয়নে বিভিন্ন সরকারি কোর্স করতে থাকেন মুক্তা। একবার বোনের চিকিৎসার জন্য বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন। সেখান থেকে চায়না পুঁতি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফল-ফুল তৈরির কাজ শিখে আসেন! নিজে অনুশীলন করে বারো রকমের ফল বানানো শিখে ফেলেন মুক্তা।

শেখার জন্য দেশ থেকে বিদেশে

মুক্তা বলছিলেন জাপানি টাইডাই শেখার কথা। যে সময় তিনি এই কাজ শেখেন, তখন দেশে জাপানি টাইডাইয়ের কাজ হতো না বললেই চলে। তাদের কাজ করার কৌশল শিখে ফেলেন মুক্তা। ডাক আসে, টেলিভিশনে শেখাতে হবে। ২২ দিনের একটা অনুষ্ঠানে তিনি জাপানি টাইডাই শেখান টেলিভিশনের পর্দায়। মুক্তা বলেন, ‘আমি যখনই কোনো কিছু শিখেছি, সেখানে একটা নিজস্বতা রাখার চেষ্টা করেছি। সর্বোচ্চটা শেখার চেষ্টা করেছি, যেন কাজটা নিখুঁত হয়। এই ধৈর্য আমি সব সময় রাখি।’

ভারতে গিয়ে লীনা বসাকের কাছে ডিসকভারি মোমের কাজ শেখেন। সেই কাজ দেখেও মুগ্ধ হয়েছেন অনেকে। অরগানিক সাবান তৈরি শেখার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মুক্তাকে।

এ ধরনের সাবান তৈরি শিখতে তিনি গিয়েছিলেন ভারতে। সেখানে থাকাকালীন দুর্ঘটনায় আহত হন। ফিরে আসার আগে পাঁচ দিনের ক্লাসে ১২ ধরনের সাবান তৈরি শিখে তবেই ফিরেছিলেন দেশে। বর্তমানে তিনি ২২ ধরনের সাবান তৈরি করছেন।

বসে থাকা নয়, কাজ করতে ভালোবাসেন

নিজের পরিচয় তৈরি করার একটা তাগিদ সব সময় তাড়া করে ফেরে আফরোজা খানম মুক্তাকে। তিনি কাজ করেন, কাজ শেখান আসলে নিজের জন্যই। ‘একজনকে শেখাতে হবে’—এ কারণেই তিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস শেখার চেষ্টা করেন। মুক্তা নিজে যেমন কোর্স করে শিখেছেন, তেমনই রান্না ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন কোর্সে ক্লাসও নিয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কোর্স করানোর সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি।

‘রান্নার একাল সেকাল’ নামের একটি ফেসবুক পেজে নিজের বিভিন্ন ধরনের রেসিপি প্রকাশ করেন মুক্তা। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এবং কাজের প্রতি ভালোবাসা দেখে নতুন করে একটি কাজ শেখার আগ্রহ তৈরি হয় মুক্তার ভেতর। তিনি জানান, এমন অনেক মেয়ে আছে, যারা অর্থের কারণে কোর্স করতে পারে না। তাদের জন্য তিনি সরকারি কোর্সের কথা বলেন। তাতে টাকার দরকার নেই।

নিজের মতো তৈরি করা

প্রতিটি কাজে নিজস্বতার ছাপ রাখতে চান মুক্তা। তাই মন দিয়ে কাজের পাশাপাশি নিজের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটান তিনি। এতে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে যান বলে বিশ্বাস করেন। ১০ থেকে ১২ বছর আগে ভারতে গিয়ে শিখেছিলেন চকলেট তৈরি করা। এরপর দেশে ফিরে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মোল্ড কিনেছেন। এর ফলে তাঁর তৈরি চকলেটে এসেছে ভিন্নতা। তা দেখে অনেকে চমকে গিয়েছিল। একটি ডাল প্রতিযোগিতায় তিনি খেসারির ডালের পরোটা বানিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন বিচারকদের। সেই রেসিপি

ও পরোটার পুষ্টিগুণ সম্পর্কেও জানিয়েছিলেন তাঁদের। সে জন্য পরামর্শ নিয়েছিলেন পুষ্টিবিদের।

মুক্তার এমন চিন্তা তাঁর শিল্পকে আরও নিখুঁত করে দেয়। সম্প্রতি চা-বাগানে গিয়ে চা ভর্তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন তিনি। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছেন চা-পাতার পরোটা! মুক্তা বলেন, ‘যদি আবারও কোনো দিন সেই চা-শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তাঁদের বলব, এভাবে বানিয়েও তাঁরা খেতে পারেন।’

শুধু শিখে নয়, শিখিয়েও আনন্দ

‘কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু দেখেছি, শিখেছি।’

এ যেন মুক্তার জীবনের বিশাল গল্পের সারমর্ম। শুধু ব্লক-বাটিক নয়; একজন মানুষের শিখতে চাওয়া, সুযোগের অভাবে পিছিয়ে যাওয়ার অনেক গল্প কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। ফলে তিনি অন্য নারীদের শেখার পথ সহজ করতে চান। তাই সুযোগ পেলেই মুক্তা এমন প্রশিক্ষণে অংশ নেন, যেন অন্যদের নতুন কিছু শেখাতে পারেন। মুক্তা বলেন, ‘যারা আমার মতো শিখতে আগ্রহী, তাদের জন্য আমি নিজেকে উন্মুক্ত রেখেছি।’

এ যেন এক নিরন্তর শিখে চলার গল্প, শেখানোর গল্প। অন্যকে সামনের দিকে নেওয়ার গল্প।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নিজেকে সময় দিন

ডা. ফারজানা রহমান 
ডা. ফারজানা রহমান
ডা. ফারজানা রহমান

প্রশ্ন: আমি একজন কর্মজীবী নারী। একজনের সঙ্গে আমার ৮ বছরের সম্পর্ক ছিল। তিন মাস আগে সেই প্রেমিকের ইচ্ছায় আমাদের বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের মানসিক ধকল আমি এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। অথচ আমি এই সম্পর্কে যেতে চাইনি। আমাকে সে ইমোশনাল কথাবার্তা বলে সম্পর্ক তৈরি করেছিল। আমাকে ছাড়া বাঁচবে না; এমন কথা বলেছিল। অথচ সেই মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমাদের বিচ্ছেদ হওয়ার তিন-চার মাস আগে সে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।

বিচ্ছেদের পর কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়? যাদের এ রকম দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয়, তারা কি পরবর্তী জীবনে সুখী আছেন?

ইরা, কুষ্টিয়া।

উত্তর: আমি মনে করি, আপনি সৌভাগ্যবান। সেটি দুটি কারণে—আপনি কর্মজীবী আর সম্পর্কটা বিয়ের পর্যায়ে যাওয়ার আগেই শেষ হয়েছে। আমি আপনার মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও পরিমিত রুচিবোধের পরিচয় পাচ্ছি। আপনি কিন্তু আপনার প্রাক্তনের আবেগকে প্রাধান্য দিতেই সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত কোনো বিষয়ে তেমন সিরিয়াস নন। এ রকম কিছু মানুষ থাকে, এদের সঙ্গে সম্পর্ক এমনিতেও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিচ্ছেদের পর স্বাভাবিক জীবনে আসতে হলে, মন থেকে এই ভালোবাসার অধ্যায়ের ইতি এখানেই টানুন। নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করুন। নিজের যা অর্জন, সেগুলোর মূল্যায়ন করুন।

যে মানুষটি আট বছরের সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে মাত্র তিন মাসের ভালোবাসাকে গুরুত্ব দেয়, তাঁর কথা চিন্তা করে আপনি আর একমুহূর্তও নষ্ট করবেন না। তবে প্রাক্তনকে ভুলতে গিয়ে এখনই বিয়ে কিংবা নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হবে না। শুধু নিজেকে সময় দিন; সময় নিন।

এমন অনেককে খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি, যাঁরা বিচ্ছেদের পর খুব ভালো আছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো ভুল নেই, দোষও নেই।

যে মানুষটি আট বছরের সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে মাত্র তিন মাসের ভালোবাসাকে গুরুত্ব দেয়, তাঁর কথা চিন্তা করে আপনি আর একমুহূর্তও নষ্ট করবেন না। তবে প্রাক্তনকে ভুলতে গিয়ে এখনই বিয়ে কিংবা নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হবে না। নিজেকে সময় দিন; সময় নিন। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি আপনার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। আমি নিশ্চিত, একজনের কথা এবং আবেগসর্বস্ব মানুষের ভালোবাসার অভিনয় থেকে মুক্তি পেয়ে আপনি স্বস্তি ও শান্তি ফিরে পাবেন। একটু বুঝেশুনে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আপনি অবশ্যই পরবর্তী জীবনে সুখী হবেন।

পরামর্শ দিয়েছেন

ডা. ফারজানা রহমান

সহযোগী অধ্যাপক

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত