Ajker Patrika

কারমেন হিখোসা: চামড়ার বিকল্প উদ্ভাবন করেছেন যে নারী

মইনুল হাসান, ফ্রান্স
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২: ৩৫
কারমেন হিখোসা: চামড়ার বিকল্প উদ্ভাবন করেছেন যে নারী

কোনো কোনো মানুষ ঘুমিয়ে নয়, জেগে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন এবং সেই স্বপ্নকে লালন করেন একান্ত মমতায়। সে রকম একজন মানুষ হলেন কারমেন হিখোসা, বয়স ৭০, স্পেনের নারী নাগরিক। একজন গবেষক, ডিজাইনার ও সফল উদ্যোক্তা। অধ্যবসায়, মেধা আর অসাধারণ ধৈর্য্য তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে তাঁর স্বপ্নের উজ্জ্বল জগতে। নিজে স্বপ্ন দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি, স্বপ্ন দেখতে উদ্ভুদ্ধ করে চলছেন, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন বিশ্ব জুড়ে উদ্যোক্তাদেরও।

কারমেন হিখোসা আনারসের পাতা থেকে চামড়ার চমৎকার বিকল্প উদ্ভাবন করে চামড়া শিল্পে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়েছেন। আনারসের লম্বা পাতায় আছে তাপ এবং আর্দ্রতা প্রতিরোধী খুব মিহি টেকসই আঁশ। এই আঁশ দিয়ে তৈরি উদ্ভিজ্জ চামড়ার গুণগত মান আসল চামড়া থেকে কোনো অংশে কম নয়। উদ্ভিজ্জ এ চামড়ার নাম দেয়া হয়েছে ‘পিনিয়াটেক্স’।

ফিলিপাইনের একজন আনারস চাষিএকজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের হয়ে নব্বই-এর দশকে ফিলিপাইনে অবস্থানকালীন তিনি চামড়ার বিকল্পের কথা ভাবতে শুরু করেন। কারণ চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার যেমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্যও বিপদজনক। এ ছাড়াও আনারস পাতার মিহি এবং টেকসই আঁশে তৈরি স্থানীয়দের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘তাগালগ বারং’ দেখেও তিনি উদ্ভিজ্জ চামড়া উদ্ভাবনে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন।

পিনিয়াটেক্সনিজেকে শানিত করার জন্য ৬০ বছর বয়সের পরে টেক্সটাইলে পিএইচডি করেন কারমেন হিখোসা। তিনি বলেছেন, ‘আমি ৬০ বছর বয়সে নতুন করে জীবন শুরু করি’। এক যুগের বেশি একাগ্র সাধনার পর কারমেন হিখোসা উদ্ভিজ্জ চামড়া ‘পিনিয়াটেক্স’-এর কৃতিস্বত্ব লাভ করেন ২০১১ সালে। ২০১৬ সাল থেকে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেন।

পৃথিবীব্যাপী ৮০টি দেশের প্রায় ৩ হাজার ব্র্যান্ড পিনিয়াটেক্স ব্যবহার শুরু করেছেবর্তমানে শ্যানেল, হুগো বস, এইচ অ্যান্ড এম, পল স্মিথসহ পৃথিবীব্যাপী ৮০টি দেশের প্রায় ৩ হাজার ব্র্যান্ড পিনিয়াটেক্স নামের এই উদ্ভিজ্জ চামড়া ব্যবহার শুরু করেছে। তাই বলা চলে, পৃথিবীর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে অচিরেই প্রাণীর চামড়া ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত হয়ে পরবে। কারণ পিনিয়াটেক্স টেকসই, পরিবেশ বান্ধব এবং সস্তা। ড. হিখোসার চমৎকার উদ্ভাবনের জন্য তিনি ইউরোপিয়ান ইনভেন্টর অ্যাওয়ার্ড ২০২১ অর্জন করেন।

পিনিয়াটেক্সে বানানো জুতাসুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল আনারসের সঙ্গে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় আট কোটি টন আনারসের পাতা উৎপন্ন হয়। কৃষকেরা এই বিপুল কৃষি বর্জ্য প্রায় সময় খেতেই পুড়িয়ে ফেলেন। ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ ঘটে। ড. হিখোসা জানিয়েছেন, এক বর্গমিটার উদ্ভিজ্জ চামড়া অর্থাৎ পিনাটেক্স প্রস্তুতের জন্য ৪৮০টি আনারসের পাতার প্রয়োজন হয়। ২০২০ সালে তিনি পিনাটেক্স উৎপাদনে ব্যবহার করেছেন ৮২৫ টন পাতা, ফলে ২৬৪ টন গ্রিনহাউস গ্যাস কম উৎপন্ন হয়েছে। পিনাটেক্স উৎপাদনে আনারসের পাতা ব্যবহার পরিবেশের জন্য ইতিবাচক, তেমনি এটি কৃষকদের জন্য বাড়তি আয়ের উৎস।

পিনিয়াটেক্সে বানানো জ্যাকেটঅন্যদিকে প্রাণীর চামড়া প্রক্রিয়াজাত একটি শ্রমসাধ্য, জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উপরন্তু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে প্রচুর পানির প্রয়োজন পড়ে। এক কিলোগ্রাম চামড়া ট্যান করতে ৩৫ লিটার পানি খরচ হয়। বিশ্ব বাজারে প্রায় ৮০ শতাংশ চামড়ার সরবরাহ আসে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে। এ সব দেশে প্রায়ই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাড়তি খরচ এড়াতে ক্ষতিকর এবং বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী-নালাতে ফেলে দেয়া হয়। এটি পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া প্রাণীর চামড়া সংগ্রহ একটি নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। পশুর প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই পরিবেশবাদীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আরও অনেকেই পশুজাত চামড়া ব্যবহার বাদ দিয়ে উদ্ভিজ্জ চামড়ার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আর তাই উদ্ভিজ্জ চামড়ার জনপ্রিয়তা ও চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আজ যখন জলবায়ু পৃথিবীর আয়ুর জন্য হুমকি, তখন একজন কারমেন হিখোসা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত