Ajker Patrika

মেঘের রাজ্যে ট্রেনে ভ্রমণ

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১১: ২৩
মেঘের রাজ্যে ট্রেনে ভ্রমণ

আন্দিজ পর্বতমালার প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচুতে মেঘের ভেতর দিয়ে চলে যায় ট্রেন। একের পর এক সেতু পেরোনোর সময় কিংবা পাহাড়ি কড়া কোনো মোচড় অতিক্রমের সময় রোমাঞ্চ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভাগ্য ভালো থাকলে যাত্রীরা চাইলে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারেন মেঘ। আশ্চর্য এই রেলপথের গল্প শোনাব আজ। 

আর্জেন্টিনার সালতা থেকে লা পলভরিলা পর্যন্ত ট্রেনযাত্রা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের ভারি পছন্দ। ‘ট্রেন এ লাস নুবেস’ অর্থাৎ ‘ট্রেন টু দ্য ক্লাউডস’ নামে পরিচিত রেলপথটি পৃথিবীর উচ্চতম রেলপথগুলোর একটি। এই পথে যাত্রা শুরু হয় সাড়ে তিন হাজার ফুট উচ্চতায়, আর্জেন্টিনার সালতা শহর থেকে। ভ্যালে দা লারমার নামে একটি উপত্যকার মধ্য দিয়ে গিয়ে কুয়েবারদা দেল তরো এলাকা পেরিয়ে যাত্রা শেষ হয় ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় লা পলভরিলা নামের দীর্ঘ এক সেতু বা ভায়াডাক্টে। 

১৬ ঘণ্টার এই যাত্রায় ট্রেনটি অতিক্রম করে ২১৭ কিলোমিটার দূরত্ব। পথে ২৯টি সাধারণ সেতু, ১২টি ভায়াডাক্ট (একধরনের দীর্ঘ সেতু। যেখানে পাশাপাশি পিলারের ওপর ধনুক আকৃতির কাঠামো তৈরি করে তার ওপর সড়ক বা রেলপথ স্থাপন করা হয়), ২১টি সুড়ঙ্গ ছাড়াও ট্রেন অতিক্রম করে চক্রাকার ও কড়া মোচড়ের সব পথ। 

রোমাঞ্চকর এক ট্রেনযাত্রা

কিন্তু এর নাম ‘ট্রেন টু দ্য ক্লাউড’ বা ‘মেঘে চলা ট্রেন’ হলো কেন? নামটা পরিচিতি পায় ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে। তখন কিছু শিক্ষার্থী এই রেলপথে ট্রেন ভ্রমণের একটি ভিডিও ধারণ করে বগির ভেতর থেকে। ওই সময়কার বাষ্পীয় ইঞ্জিনের বাষ্পের সঙ্গে পর্বতের শীতল বাতাস মিলে বাষ্পের একটি চাদরের মতো তৈরি করে। এটি পরে আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র ক্লারিনকে দেওয়া হয় একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে। বাষ্প ও মেঘের বিপুল উপস্থিতির কারণে তথ্যচিত্রটির নাম হয়ে যায় ট্রেন এ লাস নুবেস কিংবা ‘ট্রেন টু দ্য ক্লাউডস’। পরে আর্জেন্টিনার রেলপথ নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা ফেরোকেরিলস আর্জেন্টিনা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে লুফে নেয় নামটি। এখন অবশ্য পথটিকে ‘হেরিটেজ রেলওয়ে’ বলা হয়। তবে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সেই পুরোনো নামই। 
 
পর্যটকেরা উপভোগ করছেন পৃথিবীর উচ্চতম রেলপথগুলোর একটিতে ভ্রমণএই এলাকায় একটি রেলওয়ের পরিকল্পনা শুরু উনিশ শতকের শেষ দিকে। তবে ১৯২১ সালের আগে কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। রেলপথটি তৈরি করা হয় মূলত এখানকার বোরাক্স খনিগুলোর কথা ভেবে। আমেরিকান প্রকৌশলী রিচার্ড ফন্টেন মারি পুরো রেলপথের নকশা করেন। তবে গোটা রেলপথের কাজ শেষ হতে হতে ১৯৪৭ সাল। এই রেলপথের উদ্বোধন হয় ১৯৪৮ সালে। 

রেলশ্রমিকদের সঙ্গে রিচার্ড মারি (বাঁ থেকে তৃতীয়)

রেলপথ চালুর ফলে খনি থেকে উত্তোলিত বোরাক্স চিলির উপকূল থেকে আন্দিজ পর্বতমালা হয়ে উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনায় পৌঁছানো সহজ হয়ে যায়। তবে বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা সফল হয়নি তখন উদ্দেশ্যটা। অতএব, নতুন চিন্তা-ভাবনা শুরু করল আর্জেন্টিনার সরকার। ১৯৭০-এর দশকে পর্যটকদের আনা-নেওয়া শুরু করল এই পথের ট্রেনগুলো। এখন এটি একটি হেরিটেজ ট্রেনে রূপান্তরিত হয়েছে। পর্যটক বহনই যার মূল কাজ। 

মেঘের রাজ্যে ট্রেন যায়

সালতা শহর থেকে খুব সকালে ছাড়ে ট্রেন। লারমা উপত্যকা ও তরো গিরিখাদ পেরিয়ে পুনার বিশাল এলাকার ভেতর দিয়ে যাত্রা করে ট্রেনটি। রেলপথটির মোটামুটি শেষ দিকে স্যান এন্টোনিও দে লেস কবরেস নামে একটি জায়গায় যাত্রাবিরতি দেয় ট্রেন। পুরোনো শহরটিতে কিছু বাড়ি-ঘর আর ছোট্ট একটি বাজার আছে। তবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এখানকার দোকানগুলো। সেখানে মেলে নানা ধরনের হস্তশিল্প, পোশাক আর স্মারক। তারপর থামে পথের শেষ প্রান্তে লা পলভরিলা ভায়াডাক্টে। বাঁকানো এই সেতু প্রায় ৬৮০ ফুট লম্বা, উপত্যকা থেকে এর উচ্চতা ২০০ ফুটের বেশি। এই সেতুর ওপর দিয়ে মেঘের ভেলায় চেপে শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় ট্রেন। তারপর অপেক্ষায় থাকে ফিরতি ভ্রমণের। 

সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর একটি ট্রেন রেলসেতু পাড় হচ্ছে

এখানে নেমে পর্যটকেরা মুখে শীতল বাতাসের পরশ নিতে পারেন, তারপর ধীরে-সুস্থে হেঁটে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ছবি তোলেন। সালতার দিকে ফিরতি যাত্রাটি শুরু হয় সন্ধ্যার দিকে, তাই তখন দেখার কিছু নেই তেমন। মধ্যরাতের একটু আগে ট্রেন পৌঁছে যায় সালতায়। অবশ্য বেশির ভাগ যাত্রী ট্রেনে গিয়ে বাসে ফেরেন সালতায়। 

লা পলভরিলা সেতুর নিচে পর্যটকেরা স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে নানা জিনিসপাতি কিনছেন

নানা উত্থান-পতন আছে এই মেঘরাজ্যের রেলওয়ের ইতিহাসে। শুরুতে রেলপথটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিল আর্জেন্টিনার রেলপথ নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা ফেরোকেরিলস আর্জেন্টিনা। ১৯৯১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়িত্ব দেওয়া হয় ট্রেন রুট পরিচালনার। ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৫০০ মিটার বা প্রায় ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় নষ্ট হয়ে যায় একটি ট্রেন। বাধ্য হয়ে যাত্রীদের হেলিকপ্টারের সাহায্যে উদ্ধার করা হয়। পরে নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে ১২০০ হাজার ফুট উচ্চতায় লাইনচ্যুত হয় ট্রেনটি। ৪০০ যাত্রীকে নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়। তারপর থেকে সালতার প্রাদেশিক সরকার রেলওয়ের দায়িত্ব নেয়। এরপর রেলপথ ও রেলের ইঞ্জিন ও বগির সংস্কার করা হয়। ২০১৫ সালে আবার চালু হয় সালতা থেকে পলভরিলার এই ট্রেন। 

২০১৫ সালে রেলপথটি পুনরায় চালুর পর প্রথম ট্রেনযাত্রা

কাজেই আপনার যদি খুব বেশি উচ্চতাভীতি না থাকে, তবে অনায়াসেই মেঘের রাজ্যে এই ট্রেন ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। এর জন্য প্রথমে আপনাকে যেতে হবে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে। তারপর সালতায় গিয়ে চড়ে বসবেন মেঘরাজ্যের সেই আজব ট্রেনে। 

সূত্র: এমিউজিং প্ল্যানেট, স্প্যানিশ একাডেমি, উইকিপিডিয়া

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত