Ajker Patrika

শহীদ আবু সাঈদকে আমিই একুশ শতাব্দীর প্রথম ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ বলেছিলাম—বিএনপির নোটিশের জবাবে ফজলুর রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৫৬
শহীদ আবু সাঈদকে আমিই একুশ শতাব্দীর প্রথম ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ বলেছিলাম—বিএনপির নোটিশের জবাবে ফজলুর রহমান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল বিএনপি। আজ মঙ্গলবার সে নোটিশের জবাব দিয়েছেন তিনি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বরাবর লিখিত চিঠিতে এ জবাব দেন ফজলুর রহমান।

আজ বিকেলে ফজলুর রহমানের স্ত্রী উম্মে কুলসুম রেখা গণমাধ্যমকে জানান, ফজলুর রহমান এ-সংক্রান্ত চিঠির জবাবে লিখিতভাবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন। চার পৃষ্ঠার এ জবাবে দলের তরফ থেকে যা জানতে চাওয়া হয়েছে, তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষ বার্তা প্রেরক সেটা জমা দিয়ে এসেছেন। এখন তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।

শোকজের জবাবে ফজলুর রহমান যা লিখেছেন, তা আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো—

ফজলুর রহমান লিখেছেন, ‘যেহেতু আপনার শোকজ নোটিশে আমার কাছ থেকে একত্রে সবকিছু জানতে চেয়েছেন, তাই অভিযোগের উত্তরগুলো আমি একত্রেই দিচ্ছি।

(ক) আপনি জানতে চেয়েছেন, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কেন আমি ক্রমাগত কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আমি বলতে চাই—আমি কোনো দিন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিইনি, যা আমার স্বভাব ও চরিত্রের বিপরীতে। আমিই প্রথম ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদকে পুলিশ সরাসরি বুকে গুলি করে হত্যা করার পর বলেছিলাম, সে এই একুশ শতাব্দীর প্রথম ‘‘বীরশ্রেষ্ঠ’’। আমার বক্তব্যে জুলাই-আগস্ট শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছি।

(খ) আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, আমি নাকি জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে কথা বলেছি, যা আমার দৃঢ় ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবিচার। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, আমি ইসলাম ধর্ম এবং আল্লাহ রাসুলে বিশ্বাসী ব্যক্তি। তবে রাজনৈতিকভাবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের (যেমন জামায়াতে ইসলামী) বিরুদ্ধে চিরদিন কথা বলেছি, আগামীতেও বলব।

দলের নেতাদের সুবিবেচনার স্বার্থে আমি নিম্নলিখিত বক্তব্যগুলো পেশ করতে চাই—

১) কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন ছাত্রদের নেতৃত্বে প্রথম শুরু হয়েছিল, তা ছিল নির্দলীয় চরিত্রের এবং রাজনৈতিক দাবিবিবর্জিত। আমিই প্রথম তাদের ইউটিউবের মাধ্যমে উৎসাহ দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলাম, ‘বাবারা তোমরা শুধু চাকরি চাও, গণতন্ত্র চাও না? তোমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করো।’

২) জুলাই আন্দোলনের পরতে পরতে সবকিছুর সঙ্গে জীবনের শঙ্কা নিয়েও যুক্ত ছিলাম, যা আমার দল এবং এ দেশের সমস্ত মানুষ জানে।

৩) ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরে বিএনপি আহুত লাখো জনতার মহাসমাবেশকে স্বৈরাচারী সরকার ১ ঘণ্টার আক্রমণে ভেঙে দিয়েছিল। পঁচিশ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মী যখন জেলে ছিল, লাখ লাখ নেতা-কর্মী যখন মিথ্যা মামলার আবর্তে পড়ে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি তখন প্রতিদিন অনলাইন ও টেলিভিশন টক শোর মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করেছি এবং জাতির সামনে আশার আলো জাগিয়ে রেখেছি।

৪) ৫ আগস্ট আন্দোলনের বিজয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিস্ট শক্তি পালিয়ে গেল এবং জনগণ বিজয়ী হলো; আমি সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু এর কিছু দিন পরেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা সারজিস আলম ‘ইসলামী ছাত্রশিবিরের’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করল, ‘জামায়াত শিবিরই ছিল জুলাই আন্দোলনের মূল ভ্যানগার্ড’। আমি সেদিনই প্রমাদ গুনলাম এবং আন্দোলনের সমস্ত বিজয়কে তারা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করল।

৫) আমি জামায়াত-শিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এই অনৈতিক দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শতবার বলেছি। বিগত ১৫ বছরের আন্দোলনে জমিটি তৈরি করেছিল বিএনপি, বীজ ও চারা রোপণ করেছিল বিএনপি, তেল-মবিল-পানি দিয়ে ধান ফলিয়েছিল বিএনপি, কিন্তু ধান কাটার লগ্নে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সেই তৈরি ধানটি কেটে দিয়েছিল। তারা ছিল আমার ভাষায় ‘দাওয়াল’, কাজেই আন্দোলনের সমস্ত ফসল পাওয়ার দাবিটি অনুচিত।

৬) কিন্তু পরবর্তী সময়ে অবাক বিস্ময়ে সবাই দেখল, একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত-শিবির সদর্পে মাঠে হাজির হয়েছে এবং দাবি করছে, সমস্ত আন্দোলনের ভ্যানগার্ড তারাই এবং শুধু একটা নির্বাচনের জন্যই তারা আন্দোলন করেনি, বরং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকারের মতো দুঃসাহস তারা প্রদর্শন করতে লাগল। জামায়াত-শিবির পত্রিকায় আহ্বান জানাল—‘৭১-এ যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল, তারা আল্লাহর কাছে মাফ চাও।’ (সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা)। সেদিন থেকে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে তাদের সাবধান করার চেষ্টা করেছি।

৭) এর পর থেকে জামায়াত-শিবির ও এনসিপি একসঙ্গে বলতে শুরু করল—১৯৪৭ হলো প্রথম স্বাধীনতা এবং ২০২৪ হলো দ্বিতীয় স্বাধীনতা, আর ১৯৭১ হলো ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া (সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা)। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে হলো—এসব অশ্রাব্য এবং মিথ্যা তথ্য শোনার আগে আমার মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল। তাই জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের সত্য কথাগুলো বলতে শুরু করলাম এবং জামায়াত-শিবিরকে ‘কালো শক্তি’ চিহ্নিত করে এনসিপিকে তাদের সহযোগী বলতে শুরু করলাম। তারাই এখন দেশের সমস্ত প্রশাসন, অর্থ ও বিশ্ববিদ্যালয় দখল করেছে।

৮) আমি সবশেষে বলতে চাই, মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছে, জুলাই আন্দোলনের দুটি রূপ ছিল। প্রথমত, ‘বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্বে’ ‘গণ-আন্দোলন’; যার লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে পরাজিত করে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করা। যার প্রধান স্লোগান ছিল, ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’। কিন্তু আমি যাদের অন্ধকারের ‘কালো শক্তি’ বলেছি, তারা হলো জামায়াত-শিবির; যারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনের ফসলকে কুক্ষিগত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র এবং শক্তি সৃষ্টি করছে। জাতীয় নির্বাচন তাদের কাছে গৌণ ব্যাপার।

৯) আমার প্রিয় দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের মহান ঘোষক ‘মেজর জিয়া’ পরবর্তী সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তাঁর মহান স্মৃতিকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করেই আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর কথা বলা এবং প্রতিবাদ করাকে আমার পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। গত ৬ মাস ধরে এ ব্যাপারে আমি শত শত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছি, এর মধ্যে দুই-একটা বক্তব্যে আমার কিছু ভুল-ত্রুটিও থাকতে পারে। কারণ আমি তো মানুষ। আমি আরও দাবি করতে চাই, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার অন্যায়ভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করার পরে আমি স্বৈরাচারী সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আমার নেত্রীর মুক্তির জন্য সমগ্র বাংলাদেশে শত শত সভা ও জনসভায় বক্তব্য রেখেছি। এমনকি ইদানীংকালে একটি দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রিয় নেতা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এমন জঘন্যতম কুৎসিত স্লোগান দিয়ে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে অপমান করা হচ্ছিল, যার উদাহরণ ‘গাছের ডালে কাউয়া’। তখন আমিই প্রথম ইউটিউব চ্যানেল পুর্নিয়াতে কঠিনভাবে এর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলাম।

১০) আমার সার্বিক বক্তব্য উপস্থাপনায় যদি প্রমাণিত হয়, আমি কোনো ভুল বক্তব্য দিয়েছি, তবে আমি দুঃখ প্রকাশ করব।

১১) আমার প্রিয় দল বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়, এমন কোনো কথা ও কাজ আমি করিনি এবং করব না। জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বের বিচার বিবেচনার প্রতি আমার সর্বোচ্চ আস্থা আছে, আশা করি, আমি সুবিচার পাব এবং দলের বৃহত্তর স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রতি সর্বদাই অনুগত থাকব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত