Ajker Patrika

আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভয়ডরহীন

তানিম আহমেদ, ঢাকা
আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভয়ডরহীন

বিদ্রোহী দমনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থান নিলেও তা আমলেই নেননি দলের তৃণমূলের নেতারা। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে তা অনেকটা প্রকাশ্য। এই নেতাদের দাবি, চেয়ারম্যান হতে পারলে দল কী করবে না-করবে, তা নিয়ে তাঁদের আদৌ কোনো ভাবনা নেই। অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী বলেছেন, কেন্দ্র অযোগ্যদের প্রতীক দেবে। তারপরও তাঁরা কি বসে থাকবেন? বিদ্রোহী প্রার্থীর ধাক্কা সামলাতে না পেরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের একাংশে কাউকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়নি।

চলতি বছরের ১১ এপ্রিল প্রথম ধাপে ৩৭১টি ইউপিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। পরে করোনাভাইরাসের কারণে সে নির্বাচন স্থগিত হয়। করোনার প্রকোপ কমায় জুনে ২০৪ ইউপির ভোট হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮ জন বিনা ভোটে বিজয়ী হন। সেপ্টেম্বরে ৭টি বাদে ১৬০টি ইউপির ভোট হয়। যার মধ্যে ৪৩ জন নৌকার প্রার্থী বিনা ভোটে বিজয়ী হন। আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৮ ইউপির মধ্যে ৩১টিতে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত এ সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, প্রথম ধাপে নির্বাচন হওয়া প্রায় সব ইউপিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে লড়তে হয়েছে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এতে ৭৭ জন নৌকার প্রার্থী হেরে যান। বিজয়ীদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, কর্মী কিংবা সমর্থক। আবার দ্বিতীয় ধাপের ভোটেও ইউপি চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিদ্রোহীরা।

উচ্চাভিলাষ, গোত্র, গোষ্ঠী ও আঞ্চলিকতা
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলীয় পদ-পদবির চেয়েও অনেকের কাছে চেয়ারম্যান পদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর সঙ্গে আর্থিক লাভক্ষতি জড়িত। বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরা জড়িত। তাই অনেকেই দলীয় সিদ্ধান্তকে অমান্য করে প্রার্থী হচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের সিলেট জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, কেউ হয়তো বর্তমান চেয়ারম্যান, বিদ্রোহী হয়ে গতবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখনো লোভটা ছাড়তে পারছেন না। কারণ, দলীয় পদের চেয়েও চেয়ারম্যানের পদের লোভটা বেশি থাকে। তিনি বলেন, সিলেটে ইউপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী, আঞ্চলিকতা ও সামাজিক চাপ থাকে। এসব কারণে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে থাকে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, অতীতে যাঁরা বিদ্রোহী হয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দল তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে দলের হুমকিকে তাঁরা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। আবার স্থানীয় সাংসদ ও অন্য নেতারা নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে অনেকেই প্রার্থী দাঁড় করান। প্রার্থীর নেপথ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কখনোই কিছু বলে না দল। এসব কারণে অনেকেই মনে করেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হলে কোনো সমস্যা হবে না।

পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর বলেন, অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা ক্ষমা পেয়েছে। ফলে অনেক জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়। দল কঠোর থাকলে এ সুযোগ থাকবে না।

বিএনপির বিকল্প বিদ্রোহী
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নির্বাচনে বিরোধী দল না থাকায় তৃণমূলের অনেকেই প্রার্থী হন। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনে তো বিএনপি নেই। তাই নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী হচ্ছেন। দলীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা হলেও সেটা শুনতে চান না তাঁরা। আবার কিছু কিছু জায়গায় প্রতিযোগিতা ধরে রাখার জন্যও বিদ্রোহীদের বিষয়ে নমনীয় থাকেন স্থানীয় নেতারা।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, দলের ভেতরের কারও না কারও ইন্ধনেই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে থাকে। আবার বিরোধী দল না থাকায় কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বিরোধী রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে আসত, সে ক্ষেত্রে আমাদের অধিক প্রার্থী দাঁড়ানোর প্রবণতা কমে যেত। এখন বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করায় দাঁড়ালেই পাস করা যেতে পারে—এমন একটা প্রবণতা আছে।’

যা বলছেন বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থীরা
গত সোম ও মঙ্গলবার আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথম ধাপে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী প্রায় পাঁচজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। যাঁদের প্রায় সবাই বলছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের দলীয় প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন। জনগণের ভোটে তাঁরা বিজয়ী হয়েছেন। তাই দল তাঁদের মূল্যায়ন করবে। আর যদি না করে, সেটা পাঁচ বছর পর দেখা যাবে।

খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটির ইউপি চেয়ারম্যান জিয়া গাজী বলেন, ‘আমি দলের মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু আগেরবার স্বতন্ত্র নির্বাচন করায় এবারও পাইনি। কিন্তু জনগণ চেয়েছে, তাই আমি নির্বাচন করেছি।’ স্থানীয় এই যুবলীগ নেতা পরপর দুবার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে জিতলেন।

ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউপির চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম সহিদুল্যা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল। আমি জনগণের ভোটেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। তাই আমার বিশ্বাস, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। ভবিষ্যতে দল আমাকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দেবে।’

যা বলছে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় অনেকেই প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। যাঁর একটু টাকাপয়সা হয়েছে—তিনিই ভাবেন, আমি চেয়ারম্যান হব। পরের ধাপে তিনি সাংসদ হবেন।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, এখন চেইন অব কমান্ড লোকে মানতে চায় না। আগে দলের নেতাদের কথা অন্যরা শুনত। এখন তৃণমূলের রাজনীতি করে বা না-করে ঢাকায় এসে বিভিন্ন পদ-পদবি নিয়েই ভেবে বসে যে, আমি এখন চেয়ারম্যান হব।

উদাহরণ দুই জেলা
মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার দলীয় সাংসদদের অনুরোধে দুই জেলার ইউনিয়নগুলোর প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সাংসদেরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এই অঞ্চলের চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চান দলের অনেকেই। তাই একক প্রার্থী দেওয়া হলে তৃণমূলের কর্মী ও সমর্থকেরা হতাশ হতে পারেন।

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে বলেন, মাদারীপুর সদর উপজেলার প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এর আগে শিবচর উপজেলার ইউপি নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে নৌকা দেওয়া হয়নি। শুধু কালকিনি উপজেলার ইউপিগুলোয় নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে।

শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেদুর রহমান খোকা বলেন, ‘নেত্রী দয়া কইরা আমাদের শরীয়তপুরে নৌকা ওঠায় দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘এখানে শতভাগই নৌকার লোক। নৌকা দিলে বিভেদ বাড়বে। কাজেই এখানে নৌকা দেওয়া ঠিক হবে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত