Ajker Patrika

নাড়ির টানে এবং...

সম্পাদকীয়
নাড়ির টানে এবং...

প্রতিবছরই ঈদের সময় শব্দ দুটো পত্রপত্রিকা ব্যবহার করে থাকে, ‘নাড়ির টানে’। অর্থাৎ পরিবারবিচ্ছিন্ন মানুষ ঈদের সময় নাড়ির টানে যে যাঁর এলাকায় চলে যান।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ভয়াবহ। লকডাউন বাড়িয়ে ঈদ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ‌বলা হয়েছে, এবার ঈদটায় নাড়ির টান অনুভব না করাই ভালো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আজকের পত্রিকায় শনিবার যে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটি ভারতের কুম্ভমেলার কথাই স্মরণ করিয়ে দিল। অতিমারির এ সময়টিতে ঐতিহ্য বা উৎসবের ব্যাপারে নিজের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করাই উত্তম। কিন্তু এ ধরনের পরামর্শ যে কোনো কাজে লাগে না, সেটা প্রমাণ করে দিলেন নাড়ির টানে নিজ অঞ্চলের পথে রওনা দেওয়া মানুষ।

কোভিড পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যে বিষয়গুলো মনে হয়েছিল চিরজীবী, সেগুলোতেও ধাক্কা লেগেছে। ভেঙে গেছে বিশ্বাস। অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়েছে। রোগটি ফুসফুস পর্যন্ত ছড়ানোর পর হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সে বিষয়ে কমবেশি সবাই এখন জানেন। ‌পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তা অকল্পনীয়। তাতে বোঝা যায়, মানুষ কত অসহায়। বহুদিনের করা সঞ্চয় মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হয়ে যাচ্ছে।

এই সমস্ত কথা সবাই জানেন। ‌যাঁরা নাড়ির টানে বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন, তাঁদেরও এসব কথা অজানা নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ইত্যাদির দিকে নজর দেওয়ার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে হলেও গ্রামের বাড়ি যাওয়াটা মুখ্য হয়ে উঠেছে।

রসিক ভাইরাসটি ভ্যাকসিন দেওয়া মানুষকে কতটা রক্ষা করবে, সেটাও কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। যাঁরা এখনো দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিতে পারেননি, তাঁরা কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নিম্নবিত্ত মানুষেরা সূর্যের আলো এবং ইমিউনিটির কারণে কিছুটা সুরক্ষা পাচ্ছেন বলে অনেকে বিশেষজ্ঞ বলেছেন। কিন্তু যেভাবে ভাইরাসটি নানাভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে সুরক্ষা প্রশ্নাতীত নয় এবং এই অতিমারি কত দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে, সেটাও অজানা।

এরই মধ্যে ঈদ যাপন করার জন্য লকডাউনের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষের অনুভব করা ‘নাড়ির টান’ আমাদের হতাশ করে।

নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়া মানুষের পাশাপাশি আমরা দেখলাম, শহরের ভেতরেই কেউ মার্কেটে-শপিংয়ে, কেউ বাজারে ছোটোছুটি করছেন। দু-তিন দিন ধরেই চলছে এ অবস্থা। বলা হয়েছিল মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে, না হলে বন্ধ করে দেওয়া হবে। অথচ তা মানা হচ্ছে না। রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র প্রায় সব মার্কেটেই মানুষের উপচেপড়া ভিড়। ঈদ ঘিরে শেষ মুহূর্তে মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই।

অন্যভাবেও বিষয়টিকে দেখা যায়। যারা করোনার ভয়াবহতাকে থোড়াই কেয়ার করে বিপদ বাড়াচ্ছেন, সরাসরি তাদের কি দোষ দেওয়া যায়? এটা তো চিরায়ত, বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ—মানুষ ঈদে গ্রামের বাড়ি পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে—সব ঈদেই আমরা এমনটা দেখি। আর শুধু ঈদকেই বা দোষ দিচ্ছি কেন? এই করোনায় মানুষের আয় নেই। অনেক খরচ বাঁচাতে, খরচ কমাতে বা টিকে থাকতেও গ্রামে ছুটছেন।

লকডাউনে বইমেলা চলে, মার্কেট খোলা, গণপরিবহন বন্ধ, প্রাইভেটকার চলছে, রিকশাচালককে পদে পদে হয়রানি, ২০ জনের বেশি মুসুল্লি নিয়ে জামাত পড়া যাবে না, জেলার মধ্যে বাস চলতে দেওয়া, আন্তঃজেলায় বন্ধ—এ রকম অসংখ্য অসামঞ্জস্য সিদ্ধান্তই কাল হয়েছে। এখানে বিচক্ষণতার বড় অভাব ছিল। সরকারের সমন্বয়হীন ঘোষণা ও ব্যবস্থাপনা এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। মানুষও তাই সুযোগ নিয়েছে, সবকিছু করছে বেপরোয়াভাবে।

পুরো ব্যাপারটাই পড়েছে গ্যাঁড়াকলে। একদিকে সরকারি সিদ্ধান্তে সমন্বয়হীনতা, অন্যদিকে জনগণের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা সামনে কোনো বড় বিপদ ডেকে আনছে কি না, সেটা কে জানে? আনন্দ উৎসব যদি বেদনার সূত্রপাত করে, তাহলে সে ট্র্যাজেডি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা কি আমাদের আছে?

আমরা মনে করি, সরকারকে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন করা যাবে– এমন বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল, যাতে একদিকে করোনা ঝুঁকি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়—সীমিত পরিসরে মার্কেট খোলা রাখা; মানুষকে রাজধানীর বাইরে না যেতে দিতে চাইলে যাঁরা গরিব, অসহায় ও আয়হীন মানুষ, তাঁদের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সমন্বিতভাবে যদি কাজগুলো করত, তাহলে এই অসামঞ্জস্যতা দেখা যেত না, যার পরিণাম হলো এখন মানুষের বেপরোয়া ও বাঁধভাঙা জনস্রোত। তবে এখনো সময় আছে, যতটা পারা যায় সরকারকে বিষয়গুলো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর জনগণকেও বিষয়গুলো বুঝতে হবে। সব সময়ের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি তো এক নয়। সবাই সচেতন না হলে সামনে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পুরোনো রাউটার ফেলে না দিয়ে যে কাজে ব্যবহার করতে পারেন

পাকিস্তানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভারত: ব্রিটিশ বিশ্লেষক

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত