একটি অধিকতর উন্নত, মার্জিত, পরিশীলিত ও মননশীল সমাজ গঠনের প্রয়োজনে এবং একই সঙ্গে আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত করার স্বার্থে বাংলাদেশ সমাজে রবীন্দ্রকর্মের চর্চা শুধু অব্যাহত রাখলেই হবে না, এটিকে আরও বহুগুণে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
আবু তাহের খান
২২শে শ্রাবণ (৬ আগস্ট) ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ওই দিন বাংলা একাডেমি ও ছায়ানট কর্তৃক রবীন্দ্রনাথ স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠানের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। অবশ্য এর বাইরেও হয়তো দেশের অন্যত্র আরও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে এ-জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকতে পারে, যেগুলোর পরিসর বৃহৎ নয় বলে গণমাধ্যমে সেগুলোর স্থান হয়নি। তবে পাশাপাশি এটিও ঠিক যে, অন্য স্বাভাবিক সময়ে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে এবং রবীন্দ্রকেন্দ্রিক অন্যান্য উপলক্ষে দেশজুড়ে যে ধরনের ব্যাপকভিত্তিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে আসছিল, সেটি সাম্প্রতিক সময়ে অনেকখানি কমে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ, সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন প্রকাশ, বিশেষ অনুষ্ঠানাদি আয়োজন এবং বিশেষ নাটক, সংগীত, প্রামাণ্যচিত্র ইত্যাদি প্রচারের একটি রীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছিল, যার সঙ্গে বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে এ দিনগুলোতে এ ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজনের রীতি স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকেই শুরু হয়। এমনকি পরবর্তী সময়ে ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের সামরিক শাসনামলেও তা প্রায় একই ধারায় অব্যাহত থাকে। কিন্তু অতিসাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অধ্যয়নিক চর্চায় রবীন্দ্রনাথ যেন অনেকটাই প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রবীন্দ্রবিষয়ক পাঠ, আলোচনা, গবেষণা ইত্যাদি অনেকটাই স্থবিরতাপূর্ণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি ঘটছে সচেতনভাবে পরিহার বা এড়িয়ে চলার কারণে। এমনকি কখনো কখনো তা ঘটছে ভয় থেকেও, যে ভয় তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর হামলা হওয়ায় বা তা বন্ধ করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। মোট কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রবীন্দ্রচর্চার বিষয়টি এখন আর স্বতঃস্ফূর্ততার পর্যায়ে নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রেও এখন ভাটার টান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বেসরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এ বছরের পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণে কী ধরনের অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করেছিল, তার হিসাব নিলেই বিষয়টি অনেকখানি স্পষ্ট হবে। অন্যদিকে পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় এ বছর দেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কতসংখ্যক প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার হিসাব নিতে পারলেও তা থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে একটি অধিকতর সহজ কাজ হচ্ছে এটি যাচাই করে দেখা যে, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক এ সময়ে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকাগুলোতে পূর্ববর্তী একই সময়ের তুলনায় রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধের সংখ্যা বেড়েছে নাকি কমেছে। প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, উল্লিখিত গবেষণা পত্রিকাগুলোতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি শুধু কমেইনি, রবীন্দ্রনাথ সেখানে অনেকটা প্রায় অস্তিত্বহীনই হয়ে পড়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এমনটি কেন ঘটল বা কোন কারণে তা ঘটে চলেছে? এ ক্ষেত্রে স্পষ্টীকরণের জন্য প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে, এ বিষয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরূপ নতুন নীতি-নির্দেশনা বা বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে এমনটি ঘটছে, তার কারণ অন্যবিধ। এর সঙ্গে বস্তুত যোগ রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, মবের মতো দুষ্ট সামাজিক শক্তির আবির্ভাব, ক্ষমতার নতুন ভরকেন্দ্রের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের নতুন ধারার লোভপূর্ণ আনুগত্য, উগ্র সাম্প্রদায়িক আচরণের প্রতি রাষ্ট্রের নমনীয়তা (কারওয়ান বাজারে গরু জবাইয়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে) ইত্যাদির মতো নেতিবাচক অনুষঙ্গগুলোর। আর রাষ্ট্র ও সমাজে এ ধরনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকার কারণে অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম যেমন স্বনিয়ন্ত্রণেই (সেলফ সেন্সরশিপ) অনেক কথা বলা, লেখা ও প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছে, তেমনি অনেক ব্যক্তি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও এ সময়ে রবীন্দ্রচর্চায় নিজেদের সীমিত করে ফেলেছে। এটি একটি রাষ্ট্রের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে শুধু বড় বাধাই নয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের জন্য ভয় ও আতঙ্কেরও বিষয়। বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এটি তো হচ্ছে পরোক্ষ প্রতিবন্ধকতা, যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক যুক্ততা নেই। কিন্তু পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা ছিল একেবারে প্রত্যক্ষ ও আনুষ্ঠানিক। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনকে তৎকালীন সরকার একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবেই বাধা দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান বেতারে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নাগরিক চর্চার ক্ষেত্রেও এটিকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছিল (পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশন তখনো চালু হয়নি, হলে সেটিও নিশ্চয়ই এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ত)। তবে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও ছাত্রসমাজ সেটিকে পরিপূর্ণভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং ১৯৬০-এর দশকের আন্দোলন ও সংগ্রামে এই প্রতিবাদও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণগত সংযোজন।
সে যাই হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাধীন দেশে এ কোন অবস্থায় পড়লাম আমরা? বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সমাজের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তো এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা। তাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালির ভাষিক ও সাহিত্যিক অস্তিত্বকে কল্পনা করা কি আদৌ সম্ভব? অথচ সংকীর্ণ চিন্তার অতি ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মহল তাঁকে ধর্ম কিংবা জন্মস্থানের বিবেচনায় বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী করে রাখার অপপ্রয়াসে লিপ্ত, যেটি কোনো সভ্য ও পরিশীলিত জাতিগোষ্ঠীর আচরণ হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কিংবা প্রথম বাঙালি নোবেল বিজয়ী—এটিই এ দেশের জনগণ এবং জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি নয়। বরং তার চেয়েও বড় ভিত্তি এটি যে, একটি তুলনামূলক অনগ্রসর ভাষাকে তিনি তাঁর মেধা ও প্রতিভাজাত অবদান দিয়ে সমৃদ্ধির এমন এক স্তরে নিয়ে গেছেন, যার জন্য বিশ্বসমাজে বাংলা ভাষা এবং এর সাহিত্য ও সংস্কৃতি আজ একটি বিশেষ সম্মানের জায়গা অধিকার করে আছে। আর এর সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যোগ করার বিষয় এটি যে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন সে সমৃদ্ধিকে বিশ্ব মানচিত্রে এক নতুন মাত্রা দান করেছে।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সব মিলিয়ে তাই বলব, একটি অধিকতর উন্নত, মার্জিত, পরিশীলিত ও মননশীল সমাজ গঠনের প্রয়োজনে এবং একই সঙ্গে আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত করার স্বার্থে বাংলাদেশ সমাজে রবীন্দ্রকর্মের চর্চা শুধু অব্যাহত রাখলেই হবে না, এটিকে আরও বহুগুণে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা যে ব্যক্তি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে নিরন্তর হতাশায় ভুগছি, সেখান থেকে উদ্ধার পেতে হলেও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও মূল্যবোধের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। আর সে সহযোগিতা পাওয়ার উত্তম উপায় হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে আরও বেশি করে ধারণ করা। বস্তুতই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য এক অনন্য সম্পদ—যার চর্চা তাঁর প্রয়োজনে নয়—এ দেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের জন্যই অধিক প্রয়োজন।
লেখক: অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বিসিক
২২শে শ্রাবণ (৬ আগস্ট) ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ওই দিন বাংলা একাডেমি ও ছায়ানট কর্তৃক রবীন্দ্রনাথ স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠানের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। অবশ্য এর বাইরেও হয়তো দেশের অন্যত্র আরও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে এ-জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকতে পারে, যেগুলোর পরিসর বৃহৎ নয় বলে গণমাধ্যমে সেগুলোর স্থান হয়নি। তবে পাশাপাশি এটিও ঠিক যে, অন্য স্বাভাবিক সময়ে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে এবং রবীন্দ্রকেন্দ্রিক অন্যান্য উপলক্ষে দেশজুড়ে যে ধরনের ব্যাপকভিত্তিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে আসছিল, সেটি সাম্প্রতিক সময়ে অনেকখানি কমে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ, সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন প্রকাশ, বিশেষ অনুষ্ঠানাদি আয়োজন এবং বিশেষ নাটক, সংগীত, প্রামাণ্যচিত্র ইত্যাদি প্রচারের একটি রীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছিল, যার সঙ্গে বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে এ দিনগুলোতে এ ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজনের রীতি স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকেই শুরু হয়। এমনকি পরবর্তী সময়ে ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের সামরিক শাসনামলেও তা প্রায় একই ধারায় অব্যাহত থাকে। কিন্তু অতিসাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অধ্যয়নিক চর্চায় রবীন্দ্রনাথ যেন অনেকটাই প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রবীন্দ্রবিষয়ক পাঠ, আলোচনা, গবেষণা ইত্যাদি অনেকটাই স্থবিরতাপূর্ণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি ঘটছে সচেতনভাবে পরিহার বা এড়িয়ে চলার কারণে। এমনকি কখনো কখনো তা ঘটছে ভয় থেকেও, যে ভয় তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর হামলা হওয়ায় বা তা বন্ধ করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। মোট কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রবীন্দ্রচর্চার বিষয়টি এখন আর স্বতঃস্ফূর্ততার পর্যায়ে নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রেও এখন ভাটার টান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বেসরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এ বছরের পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণে কী ধরনের অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করেছিল, তার হিসাব নিলেই বিষয়টি অনেকখানি স্পষ্ট হবে। অন্যদিকে পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় এ বছর দেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কতসংখ্যক প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার হিসাব নিতে পারলেও তা থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে একটি অধিকতর সহজ কাজ হচ্ছে এটি যাচাই করে দেখা যে, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক এ সময়ে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকাগুলোতে পূর্ববর্তী একই সময়ের তুলনায় রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধের সংখ্যা বেড়েছে নাকি কমেছে। প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, উল্লিখিত গবেষণা পত্রিকাগুলোতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি শুধু কমেইনি, রবীন্দ্রনাথ সেখানে অনেকটা প্রায় অস্তিত্বহীনই হয়ে পড়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এমনটি কেন ঘটল বা কোন কারণে তা ঘটে চলেছে? এ ক্ষেত্রে স্পষ্টীকরণের জন্য প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে, এ বিষয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরূপ নতুন নীতি-নির্দেশনা বা বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে এমনটি ঘটছে, তার কারণ অন্যবিধ। এর সঙ্গে বস্তুত যোগ রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, মবের মতো দুষ্ট সামাজিক শক্তির আবির্ভাব, ক্ষমতার নতুন ভরকেন্দ্রের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের নতুন ধারার লোভপূর্ণ আনুগত্য, উগ্র সাম্প্রদায়িক আচরণের প্রতি রাষ্ট্রের নমনীয়তা (কারওয়ান বাজারে গরু জবাইয়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে) ইত্যাদির মতো নেতিবাচক অনুষঙ্গগুলোর। আর রাষ্ট্র ও সমাজে এ ধরনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকার কারণে অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম যেমন স্বনিয়ন্ত্রণেই (সেলফ সেন্সরশিপ) অনেক কথা বলা, লেখা ও প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছে, তেমনি অনেক ব্যক্তি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও এ সময়ে রবীন্দ্রচর্চায় নিজেদের সীমিত করে ফেলেছে। এটি একটি রাষ্ট্রের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে শুধু বড় বাধাই নয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের জন্য ভয় ও আতঙ্কেরও বিষয়। বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এটি তো হচ্ছে পরোক্ষ প্রতিবন্ধকতা, যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক যুক্ততা নেই। কিন্তু পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা ছিল একেবারে প্রত্যক্ষ ও আনুষ্ঠানিক। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনকে তৎকালীন সরকার একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবেই বাধা দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান বেতারে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নাগরিক চর্চার ক্ষেত্রেও এটিকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছিল (পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশন তখনো চালু হয়নি, হলে সেটিও নিশ্চয়ই এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ত)। তবে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও ছাত্রসমাজ সেটিকে পরিপূর্ণভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং ১৯৬০-এর দশকের আন্দোলন ও সংগ্রামে এই প্রতিবাদও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণগত সংযোজন।
সে যাই হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাধীন দেশে এ কোন অবস্থায় পড়লাম আমরা? বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সমাজের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তো এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা। তাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালির ভাষিক ও সাহিত্যিক অস্তিত্বকে কল্পনা করা কি আদৌ সম্ভব? অথচ সংকীর্ণ চিন্তার অতি ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মহল তাঁকে ধর্ম কিংবা জন্মস্থানের বিবেচনায় বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী করে রাখার অপপ্রয়াসে লিপ্ত, যেটি কোনো সভ্য ও পরিশীলিত জাতিগোষ্ঠীর আচরণ হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কিংবা প্রথম বাঙালি নোবেল বিজয়ী—এটিই এ দেশের জনগণ এবং জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি নয়। বরং তার চেয়েও বড় ভিত্তি এটি যে, একটি তুলনামূলক অনগ্রসর ভাষাকে তিনি তাঁর মেধা ও প্রতিভাজাত অবদান দিয়ে সমৃদ্ধির এমন এক স্তরে নিয়ে গেছেন, যার জন্য বিশ্বসমাজে বাংলা ভাষা এবং এর সাহিত্য ও সংস্কৃতি আজ একটি বিশেষ সম্মানের জায়গা অধিকার করে আছে। আর এর সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যোগ করার বিষয় এটি যে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন সে সমৃদ্ধিকে বিশ্ব মানচিত্রে এক নতুন মাত্রা দান করেছে।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সব মিলিয়ে তাই বলব, একটি অধিকতর উন্নত, মার্জিত, পরিশীলিত ও মননশীল সমাজ গঠনের প্রয়োজনে এবং একই সঙ্গে আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত করার স্বার্থে বাংলাদেশ সমাজে রবীন্দ্রকর্মের চর্চা শুধু অব্যাহত রাখলেই হবে না, এটিকে আরও বহুগুণে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা যে ব্যক্তি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে নিরন্তর হতাশায় ভুগছি, সেখান থেকে উদ্ধার পেতে হলেও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও মূল্যবোধের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। আর সে সহযোগিতা পাওয়ার উত্তম উপায় হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে আরও বেশি করে ধারণ করা। বস্তুতই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য এক অনন্য সম্পদ—যার চর্চা তাঁর প্রয়োজনে নয়—এ দেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের জন্যই অধিক প্রয়োজন।
লেখক: অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বিসিক
আগস্ট মাসটি আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। আমাদের ভূখণ্ডে এই আগস্টে ঘটেছে ইতিহাসের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। কিশোর বয়সে ১৪ আগস্টে আমরা উদ্যাপন করতাম পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে এবং কাগজের পতাকা রশিতে লাগিয়ে, পতাকাদণ্ডের চারপাশে লাগিয়ে...
৪ ঘণ্টা আগেখবরটা শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারছি না। বসুন্ধরা শপিং মলে যুথী নামে যে চোর ধরা পড়েছেন, তিনি নাকি আন্তজেলা পকেটমার চক্রের নেতৃত্বে আছেন! তার মানে পকেটমারদেরও সংগঠন রয়েছে এবং তাতে নেতা ও কর্মীও রয়েছেন।
৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক গভীর রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের পরিণতিতে যখন দেশে একধরনের দমন-পীড়ন ও এককেন্দ্রিক ক্ষমতার গঠন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তখন নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজ মিলে গড়ে তোলে এক অভাবিত প্রতিরোধ,
১ দিন আগেজুলাই অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে আমাদের অর্জন কী, সে প্রশ্ন আজ সবার। জুলাই আন্দোলনের সময় কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য না থাকলেও শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল—রাষ্ট্রের যে পদ্ধতি শাসককে কর্তৃত্বপরায়ণ, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্টে পরিণত করে, সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
১ দিন আগে