Ajker Patrika

বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস ২০২৫

বার্ধক্যে ফিজিওথেরাপি

হাসান আলী 
হাসান আলী
হাসান আলী

বিশ্বব্যাপী ১৯৯৬ সাল থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো, ‘সুস্থ বার্ধক্যে ফিজিওথেরাপি—পড়ে যাওয়া ও দুর্বলতা প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব’। ফিজিওথেরাপি ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বার্ধক্যে নানান রোগশোক মানুষকে চিন্তিত করে তোলে। আমাদের দুর্বল প্রস্তুতি বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত নয়। যৌবনে শরীর ও মনের যত্ন নিতে শুরু করলে বার্ধক্যে সুফল পাওয়া যায়। আমাদের উদাসীনতা, গুরুত্ব না দেওয়া, অহেতুক বিলম্ব করার কারণে শারীরিক নানা রকমের সীমাবদ্ধতা দ্রুততম সময়ে সামনে এসে হাজির হয়। শুরুতেই ফিজিওথেরাপির সেবা গ্রহণ করতে পারলে রোগীর কষ্ট কমে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সহজ হয়।

বয়স বাড়ার সঙ্গে পেশিশক্তির দুর্বলতা বাড়ে, হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়, জয়েন্টে ব্যথা হয়, ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়; কার্ডিও রেসপিরেটরি, মানসিক সংকট রোগীকে প্রতিনিয়ত সক্রিয় বার্ধক্য যাপন এবং সামাজিক অংশগ্রহণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

প্রবীণদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার সমস্যা একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। বয়সের সঙ্গে শরীরে নানা পরিবর্তন আসে, যা তাদের চলাফেরাকে অনিরাপদ করে তোলে। প্রবীণেরা সাধারণত শারীরিক, মানসিক ও পরিবেশগত কারণে পড়ে যান।

শারীরিক কারণ—পেশির ক্ষয় বা ক্ষমতা কমে গেলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। আবার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ছানি, গ্লুকোমা ইত্যাদি হলে আশপাশের পরিবেশ স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। যেসব প্রবীণের বাত, আলঝেইমার, পারকিনসন্স, স্ট্রোক হয়েছে, তাদের পক্ষে স্বাভাবিক চলাফেরা করা কঠিন। দীর্ঘদিন ধরে নানান রোগের ওষুধ সেবনের ফলে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কারও কারও ভার্টিগো বা মাথা ঘোরানো অসুখ থাকে, সেটা কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লেও প্রবীণ পড়ে যেতে পারেন।

মানসিক কারণ—হাঁটার সময় অমনোযোগী হওয়া, দ্রুত ওঠাবসা, হঠাৎ সাড়া দিতে গিয়ে পড়ে যাওয়া, মোবাইল ফোন বেজে উঠলে ধরতে গিয়ে, দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা, ব্যায়াম না করা, পুষ্টির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে যাওয়া। আগে যদি কখনো পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়ে থাকেন, পরবর্তীকালে আত্মবিশ্বাস কমে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন অনেকে।

পরিবেশগত কারণ—উঁচু-নিচু বা অসমতল রাস্তাঘাট, ফুটপাতে চলাচল, সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামার সময় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। গোসলখানা বা শৌচাগারে যাওয়া-আসার সময় পড়ে যাওয়ার দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়।

বয়স বাড়লে পেশির ভর ও শক্তি কমে যায়। প্রবীণেরা সহজে ভারসাম্য হারান এবং ছোটখাটো কাজকর্মে ক্লান্তি অনুভব করেন। আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টের শক্তভাব দুর্বলতাকে আরও বাড়ায়। শরীরের ওজন বাড়লে চলাফেরায় আগ্রহ থাকে না।

নিয়মিত ফিজিওথেরাপি পেশি ও জয়েন্টকে সক্রিয় রাখে। ফলে প্রবীণেরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে পারেন। থেরাপিস্টরা ভারসাম্য ও সমন্বয়ের বিশেষ অনুশীলন করান, যাতে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে। ব্যথা উপশমে ফিজিওথেরাপি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যাদের চলাফেরা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তাদের ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়। সুস্থ শরীর বাড়িয়ে তোলে মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস। ফিজিওথেরাপি প্রবীণের শারীরিক সুস্থতা তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রবীণেরা ফিজিওথেরাপি নিলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং ওষুধনির্ভরতা কিছুটা হলেও কমে।

আলঝেইমার্স রোগীরা শেষের দিকে হাঁটাচলা বন্ধ করে দেন। খাবারদাবার চিবোতে কিংবা গিলতে পারেন না, কথা বলতে বা শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি ভালো কাজ দেয়।

বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন, ২০১৮ অনুযায়ী পুনর্বাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কার্যক্রম, সেবা প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবীদের নিবন্ধন এবং তাদের সেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে।

কেউ যদি ভুয়া সনদ বা মিথ্যা ডিগ্রি ব্যবহার করেন, তাঁকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। সরকার অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ফিজিওথেরাপিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি এবং সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা হয়েছে। সবাইকে রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলের শর্ত পূরণ করে নিবন্ধন নেওয়ার কথা রয়েছে। দ্রুত নিবন্ধন চালু করা গেলে সেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে রোগীর সুবিধা বাড়বে।

ফিজিওথেরাপি নিয়ে প্রতারণার দিকগুলো আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। ফিজিওথেরাপি মূলত ব্যথা উপশম, কার্যক্ষমতা বাড়ানো এবং পুনর্বাসনে কার্যকর। কিছুসংখ্যক ভুয়া ফিজিওথেরাপিস্ট মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, বিভ্রান্তমূলক কথা বলে, অতিরিক্ত সেশনে বাধ্য করে, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রবীণদের ক্ষতি করে।

ফিজিওথেরাপি নিয়ে যেমন অনেক ইতিবাচক সংবাদ আছে, তেমনি কিছু বিতর্ক ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। ফিজিওথেরাপিস্টদের দ্রুত লাইসেন্সের আওতায় আনতে পারলে প্রবীণেরা সঠিক চিকিৎসা পাবেন এবং একই সঙ্গে প্রতারণা অনেকখানি কমে যাবে।

হাসান আলী, প্রবীণবিষয়ক লেখক ও সংগঠক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত