Ajker Patrika

বায়ুচড়া

রাজীব কুমার সাহা
বায়ুচড়া

বাংলা ভাষায় একটি পরিচিত শব্দবন্ধ হলো বায়ুচড়া। এর আভিধানিক অর্থ হলো পাগলামি। পাগলামি, উন্মাদনা বা উন্মত্ততা অর্থে আমরা ‘মাথা গরম হওয়া’র কথা কমবেশি সবাই জানি। একই অর্থে বায়ুরোগ বা বায়ুগ্রস্ততাও তুলনামূলকভাবে পরিচিত। এমনকি পাগলামি অর্থে ‘মাথা ফোরটি নাইন হওয়া’র কথাও প্রচলিত রয়েছে। এই ফোরটি নাইনের গল্প না হয় আরেক দিন বলব। কিন্তু বায়ুচড়া শব্দবন্ধে বায়ুর অর্থ জানলেও বাংলা ভাষায় কীভাবে শব্দবন্ধটি প্রবেশ করল সেটি আমরা জানি কি? এই পাগলামির সঙ্গে বায়ুর কী সম্পর্ক। আবার সেটি চড়ে গিয়ে কী রূপ লাভ করে সেটিও বিবেচ্য বিষয়। তবে চলুন আজ জানব এই বায়ুচড়া তথা পাগলামির আদ্যোপান্ত।

সংস্কৃত ‘বায়ু’ ও ‘চড়া’ শব্দের সমন্বয়ে ‘বায়ুচড়া’ শব্দবন্ধের উৎপত্তি। এটি বিশেষ্য পদ। এ শব্দবন্ধের আভিধানিক অর্থ হলো পাগলামি বা বায়ুগ্রস্ত অবস্থা। মূলত ভারতীয় পৌরাণিক বৃত্তান্ত থেকে বায়ুচড়া শব্দবন্ধটি বাংলা ভাষায় বিস্তার লাভ করেছে। এই বায়ুচড়া শব্দের সঙ্গে ‘উনপঞ্চাশ বায়ু’ বাগধারার যোগ রয়েছে। বায়ু শব্দের প্রতিশব্দ রূপে মরুৎ শব্দটিও কমবেশি ব্যবহৃত হয়। মরুৎ শব্দটিকে আশ্রয় করেই বায়ুচড়া শব্দবন্ধটির আলংকারিক প্রয়োগ বাংলা ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। চতুর্বেদের প্রথম এবং প্রধান বেদ ‘ঋগ্বেদ সংহিতা’র বর্ণনা অনুসারে ‘মরুৎগণ’ হলেন ঝঞ্ঝার দেবতাদের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী। এঁরা সংখ্যায় হলো উনপঞ্চাশ জন, অর্থাৎ ‘উনপঞ্চাশৎ মরুৎ’। মরুৎগণ দেবরাজ ইন্দ্রের সখা ও অনুচর। এঁরা গান ও স্তুতি দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্রের শক্তি বৃদ্ধি করে থাকেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর যাবতীয় কাজ মরুৎগণের সাহায্যেই সম্পন্ন করে থাকেন। এই উনপঞ্চাশ জন মরুৎ বা ঝঞ্ঝার দেবতা একসঙ্গে যখন কোনো কাজ বা কোনো আদেশ পালন করতেন তখন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতো। মরুৎগণ এসব কাজ করার সময় কেবল কর্মেই নিবিষ্টমনা থাকতেন; কারও ভালোমন্দ, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি কোনো কিছুই বিবেচনা করতেন না। এ বিষয়টির অনুরূপ কারও মাথায় ভয়ানক গণ্ডগোল বোঝাতে বা কোনো কারণে মেজাজ বিগড়ে গেলে সচরাচর ‘বায়ু চড়েছে’ শব্দবন্ধটির ব্যবহার করা হতো, যা প্রকৃত অর্থে অতি মাত্রায় অস্থিরতা তথা পাগলামিরই নামান্তর।

বায়ুচড়া শব্দবন্ধটি গ্রামবাংলার লোকজ চিকিৎসা ও সংস্কৃতিতে বহুল ব্যবহৃত। গ্রামীণ সমাজে মনে করা হয় এটি একটি লোকবিশ্বাসভিত্তিক রোগ বা অবস্থা। সেখানে বায়ুচড়া বলতে সাধারণত বোঝানো হয় হঠাৎ শরীরে বাতাস প্রবাহিত হয়ে যাওয়া বা বাতাসের প্রভাবে শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বিঘ্ন ঘটার মতো অবস্থা তৈরি হওয়া। মানুষ সাধারণত প্রথমে স্থানীয় কবিরাজ, ঝাড়ফুঁকের লোক বা তেল মালিশকারীর কাছে যায়, পরে প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।

বাংলা সাহিত্যেও বায়ুচড়া শব্দটি বা এর ধারণা লোকজ রোগবিশ্বাস হিসেবেই উঠে এসেছে। বিশেষত গ্রামীণ জীবনের কাহিনি, উপন্যাস, লোককাহিনি এবং নাটকে বায়ুচড়াকে চরিত্রের অসুখ-বিসুখ বা দুরবস্থার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অনেক গ্রামীণ পটভূমির গল্পে লোকবিশ্বাসভিত্তিক রোগের কথা তুলে ধরেছেন। যেমন: ‘পল্লীসমাজ’, ‘গৃহদাহ’ প্রভৃতি উপন্যাসে গ্রামবাংলার নারী ও বৃদ্ধরা হঠাৎ অসাড় হয়ে গেলে বা পঙ্গু হলে লোকেরা একে ‘বায়ুচড়া’ বলে ধরে নেয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আরণ্যক’ ও ‘ইছামতী’ উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের নানা রোগ-ব্যাধি উল্লেখ করেছেন। সেখানেও ‘বায়ুচড়া’র মতো রোগের নাম পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে নদীপারের দরিদ্র জেলেদের মধ্যে নানা কুসংস্কার প্রচলিত। উপন্যাসের চরিত্ররা যখন অকারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন ‘বায়ুচড়া’কেই সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে লেখকেরা দেখিয়েছেন দারিদ্র্যের পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভাব ও লোকবিশ্বাস কেমনভাবে গ্রামীণ মানুষের জীবনে জায়গা করে নেয়। পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীন তাঁর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ রচনায় গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির নানা চিত্র যত্নসহকারে এঁকেছেন। সেখানেও গ্রামীণ মানুষের ভাষায় ‘বায়ুচড়া’ শব্দটি এসেছে অসুখ-বিসুখ বা বাতুলতা বোঝাতে। এ ছাড়া আমরা প্রাচীন লোককাহিনি ও প্রবাদে ‘বায়ুচড়া’ শব্দবন্ধের উল্লেখ পাই।

সুতরাং আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে ‘বায়ুচড়া’র প্রবণতা না বাড়িয়ে তা কীভাবে প্রশমিত করা যায় সে জীবনবোধের চর্চা অব্যাহত রাখা উচিত। অবিবেচনাপ্রসূত যেকোনো কর্মকাণ্ডই ‘বায়ুচড়া’ তথা পাগলামির শামিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত