Ajker Patrika

কল্যাণ বয়ে আনুক নতুন বছর

স্বপ্না রেজা
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ নজর ও ব্যবস্থা থাকা সত্বেও থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপন নিয়ে সাধারণ জনমনে শিথিলতা দেখা যায় না। ছবি: সংগৃহীত
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ নজর ও ব্যবস্থা থাকা সত্বেও থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপন নিয়ে সাধারণ জনমনে শিথিলতা দেখা যায় না। ছবি: সংগৃহীত

নতুনকে নিয়ে মানবজাতির ভেতর থাকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পুরাতনের নানান অভিজ্ঞতা মানুষকে ভিন্নতর তথা নতুনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা বাড়ায় এবং তা সহজাতভাবেই। যদি অভিজ্ঞতা সুখকর না হয়, স্বস্তির কারণ না হয় ­তাহলে একজন মানুষ নতুনের অপেক্ষা করে। নতুনকে তীব্রভাবে পেতে চায়। হোক সেই নতুন অজানা, অদেখা। নতুনের প্রতি মানুষের এই আচরণটা কম-বেশি সবারই একসময়ে অভ্যাসে পরিণত হয়। আবার কখনো কখনো অভিজ্ঞতার কারণ ছাড়াই নতুনকে পেতে মানুষ আগ্রহী হয়। নতুনের অপেক্ষা করে নতুন কিছু প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায়। তার ভেতর উদ্দীপনা ও উৎসাহ বেড়ে ওঠে অদেখা, অজানা এক নতুনের প্রতি। কখনো-সখনো এমন উদ্দীপনা চরম উন্মাদনায় পৌঁছে যায়। বিশেষ করে নতুন বছরকে কেন্দ্র করে মানুষের ভেতর উন্মাদনা অপেক্ষাকৃত বেশি দেখা যায়। থার্টি ফার্স্ট নাইট সেই ধরনের উন্মাদনারই ফল। থার্টি ফার্স্ট নাইট হলো নতুন বছরকে বরণের প্রাক্কালে পুরোনোকে স্মরণীয়ভাবে বিদায় জানানোর এক মুহূর্ত। অনেকটা পাশ্চাত্য স্টাইলে আমাদের দেশেও অনেক বছর ধরে এটা পালন হয়ে আসছে। সেই ধ্যানধারণায় এই দিনে আবার কোনো কোনো শ্রেণির মানুষ চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তখন দুর্ঘটনা, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ইত্যাদি নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায় প্রতিবছরই। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোনো কোনো গোষ্ঠীর ঘোর আপত্তি দেখা যায় থার্টি ফার্স্ট উদ্‌যাপন নিয়ে। তারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এই উদ্‌যাপনকে তারা ধর্মীয় দৃষ্টিতে মেনে নিতে পারে না। তারা মনে করে, এই উদ্‌যাপন ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণে কখনো-সখনো এই দিবস উদ্‌যাপনে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও উদ্ভব ঘটে। তাই থার্টি ফার্স্ট নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর থাকে বিশেষ নজর ও ব্যবস্থা। থাকে আগের থেকেই বিশেষ ঘোষণা ও সতর্ক বার্তা। সোজা কথায়, পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করা হয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তারপরেও দিন দিন থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপন নিয়ে সাধারণ জনমনে শিথিলতা দেখা যায় না। বরং দিনদিন তা বাড়ছে। বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন নিয়েও রয়েছে প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধী মনোভাব। ফলে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনেও সাধারণের মনে শিথিলতা দেখা যায়। এটা কারও অজানা নয় যে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপনকে খ্রিষ্টান ও পয়লা বৈশাখকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দিবস মনে করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একাংশ।

যাই হোক, যে যেটাই মনে করুক, ইংরেজি বছরটাই গোটা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে যেহেতু ইংরেজি ভাষার প্রচলন ও আধিক্য রয়েছে বিশ্বব্যাপী, সেহেতু ইংরেজি বর্ষকালই গোটা বিশ্বের কাছে অনুসরণীয় হয়ে উঠেছে। ইংরেজি বছরের শুরু ও শেষ তাই উদ্‌যাপনে যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্বের সামগ্রিক হিসাব-নিকাশে এবং ভাগ্য নির্দেশনায়। ইংরেজি বছরের প্রথম দিন মানেই বিশ্বের নানান ধর্মের, বর্ণের মানুষের বিশেষ আয়োজন। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটকে শৃঙ্খলায় রাখবার জন্য বাংলাদেশে সংশ্লিষ্টদের বেশ ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বলাবাহুল্য যে গেল বছরে থার্টি ফার্স্ট উদ্‌যাপন নিয়ে একধরনের শঙ্কা ছিল জনমনে। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে তাতে অনেকের মনে হয়েছিল, এ বছর অন্যান্য বছরের মতো করে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপন করা সম্ভব হবে না। জনমনে আরও শঙ্কা ছিল, এবারের থার্টি ফার্স্টে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে, নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। বরাবরের মতোই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম ছিল যা, স্যাটেলাইট চ্যানেলের সংবাদে তা দেখা গেছে, বিশেষ কিছু হোটেলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক অভিযান চালানো হয়েছে। যেখানে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপন চলছিল এবং কিছু মদের বোতল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেই উদ্‌যাপনে কিছু তরুণীকে নাচ করতে দেখা গেছে এবং আচমকা অভিযানে উপস্থিতদের তড়িঘড়ি করে বের হতে দেখা গেছে। সাধারণত পাশ্চাত্য ধ্যানে চলা হোটেলে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। অনেকে নিজের চেহারা আড়াল করে বের হয়েছেন, এ আর নতুন কী। উন্মাদনায় কিংবা এ-জাতীয় উল্লাসে মত্ত থেকে নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টা যে অন্য সময়ে ইতিবাচক বা ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকা, সেটা আর কারোর বুঝতে অসুবিধা হয় না। শুধুই তারাই এটা বোঝে না, বুঝতে চায় না কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। যাই হোক, যেটুকু জানা সম্ভব হয়েছে সংবাদ সূত্রে, গ্রাহকেরা টিকিট কেটে এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন। যদিও লোকমুখে শোনা যায়, সমাজের অনেক অভিজাত, প্রভাবশালী এ ধরনের আয়োজনে উপস্থিত হন, উপস্থিত হতে পছন্দ করেন। তাঁরা আনন্দ, উপভোগ করতে নিজেদের উজাড় করেন।

বছর আসে, বছর যায় এটাই প্রকৃতির বিধান। প্রতিটি প্রাণীর সঙ্গে এই বিধান যুক্ত। পৃথিবী কোথাও স্থির নয়। চলমান থেকে শুরু ও সমাপ্তির বিষয়টি সবাইকে অবহিত করে। জীবনের শুরু ও শেষ যেভাবে, যে পরিণতিতেই হোক না কেন, বছরের শেষ ও শুরুতে মানুষের যে আয়োজন ও উন্মাদনা থাকে তা অনেক সত্যকে আড়াল করে। ব্যাপারটা এমন যে নতুনের আগে পুরাতনের মূল্যায়ন এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে না। ফলে অহেতুক এক মোহে মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়। পুরাতনে এমন অনেক কেচ্ছা, কাহিনি থেকে যায় যেখান থেকে নতুন কোনো কিছুর সম্ভাবনা সহজে দেখা যায় না। যদি বলি ২০২৪ সাল কিংবা তার আগের সালগুলো কেমন গেছে, তার যে জবাব তা কিন্তু আগামীরই পূর্বাভাস। কারণ পুনরাবৃত্তি। নতুন যেন পুরাতনেরই প্রতিছায়া নিয়ে আসে। ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে নতুন বছরের নতুনত্ব কি থাকে, থাকে না। যে চোর ছিল, সেই চোরই থেকে যায়। যে মিথ্যে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিল, সে মিথ্যেই বলে, বরং মিথ্যে বলার গতি বাড়ে। লোকসংখ্যা বাড়ে। কেবল কৌশল পরিবর্তিত হয়। যেভাবে, যে উল্লাসে ও যে মনেপ্রাণে নতুন বছরকে মানুষ আলিঙ্গন করে, বস্তুত এসব স্রেফ নাটক ও অভিনয়।

ব্যক্তি, সমাজ, সভ্যতা যখন ক্ষতিকর চিন্তাচেতনা দ্বারা আক্রান্ত ও হুমকির মুখে, তখন নতুনের সন্ধানে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা বেমানান কি না। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক ব্যক্তি যখন পুরাতনের গ্লানি মুছে নতুনের অমৃত সুধা পান করবার আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন তাদের অতীত কার্যকলাপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মেলানো যায় না দুই সময়ের এই মানুষগুলোকে। বৈপরীত্য কিংবা দ্বৈতনীতিতে আক্রান্ত থাকা মানুষগুলো যুগে যুগে নতুন কিছু দেয় না। তবু বলি, কল্যাণ হোক নতুনের। বছর বরণ হোক অকৃত্রিম ইচ্ছা এবং আয়োজনে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত