আহমেদ শমসের, সাংবাদিক
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরীর একটি বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতূহল জাগিয়েছে। দলের মধ্যে তৈরি করেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তিনি দলীয় এক সমাবেশে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলেছেন, বিএনপি দখল করছে লঞ্চঘাট-বাসস্ট্যান্ড আর জামায়াত দখল করছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই কথাগুলো আপাতদৃষ্টিতে মজা বা রসিকতা মনে হলেও আসলে এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গভীর অসুস্থ চিত্র। মুখে কেউ স্বীকার না করলেও ‘দখল’ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বলা হয়ে থাকে, এখানে দুই ধরনের ‘দখল রাজনীতি’ চলছে। একদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতা, অর্থনীতি ও স্থানীয় আধিপত্যের জায়গা নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াত ধীরে ধীরে দখল করেছে শিক্ষাঙ্গন, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়। এ দুই ধরনের দখল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভবিষ্যতের ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলছে।
বিএনপির যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, তা অনেকাংশেই প্রতিফলিত করে দলে সংগঠনগত দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেছিলেন একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর অস্থির সময়টাতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে জন্ম নেওয়া এই দলটি শুরু থেকেই প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক শক্তিনির্ভর রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। তাই বিএনপির মধ্যে মাঠপর্যায়ের সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার সংস্কৃতি কখনোই গভীর হয়নি। যখন তারা ক্ষমতায় গেছে, তখনো স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ মূলত ক্ষমতা ব্যবহার করে জমি-বাড়ি দখল, ঘাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ, কন্ট্রাক্ট আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছেন। এই প্রক্রিয়া এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে দলীয় রাজনীতি এখানে ‘সেবা’ নয় বরং ‘দখল ও ভাগাভাগির’ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। তারা ধীরে ধীরে সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করতে থাকে। জামায়াতের কৌশল ছিল দীর্ঘমেয়াদি—প্রথমেই তারা শক্তি ঢেলে দেয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাব বিস্তারে। শিক্ষক নিয়োগ, সিন্ডিকেট নির্বাচন, হল-হোস্টেল দখল এবং ইসলামি আদর্শের প্রচারের মাধ্যমে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। শুধু তা-ই নয়, তারা আইনি কাঠামোর ভেতরেও জায়গা করে নেয়, যেমন আদালত, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থায় নিজেদের অনুসারীদের বসিয়ে দিয়ে। এভাবে জামায়াতের দখল ছিল ‘মস্তিষ্কের জায়গা’, যেখানে নীতি, সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা তৈরি হয়। এই দখলপদ্ধতি অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর।
আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বক্তব্যে এই দুই ধরনের দখলের পার্থক্য স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বিএনপি যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আটকে আছে তা হলো শর্টকাট, তাৎক্ষণিক এবং ভোগবাদী মনোভাব। একজন স্থানীয় নেতা যদি বাসস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে তবে তিনি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবেন, কিছু অনুসারীকে খাওয়াতে পারবেন এবং নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারবেন। কিন্তু এই কৌশল স্থায়ী কোনো সাংগঠনিক শক্তি তৈরি করে না। অন্যদিকে জামায়াতের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ মানে হলো তারা আগামী প্রজন্মের শিক্ষক, প্রশাসক, বিচারক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের মতাদর্শ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে জামায়াত ক্ষমতায় না থেকেও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিফলন। ক্ষমতার বাইরে ১৭ বছর কাটানোর পরও বিএনপি এখনো একটি শক্তিশালী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ।
বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা একে সংগঠিত শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেনি। ২০২২-২৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে বিএনপি দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামাতে পেরেছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল খণ্ডিত, কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বহীন এবং তৃণমূলভিত্তিক স্থায়ী শক্তিতে রূপান্তরহীন। অথচ একই সময়ে জামায়াত কম দৃশ্যমান হলেও সাংগঠনিকভাবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বজায় রেখেছে।
এখানে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনা জরুরি। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিএনপি ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় স্তরে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, মতাদর্শভিত্তিক চর্চা কিংবা গণসংগঠন তৈরির চেষ্টা তেমন হয়নি। ফলে বিএনপি সব সময় ক্ষমতার বাইরে এলে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিপরীতে জামায়াত সাংগঠনিকভাবে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে। এর কারণ হলো, তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ‘আইডিয়োলজিক্যাল’ রাজনীতির চর্চা। তারা জানে ক্ষমতা শুধু প্রশাসনিক চেয়ারে নয়, বরং মানুষের মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তারের মধ্যেই নিহিত।
আলতাফ চৌধুরীর বক্তব্য বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকটও উন্মোচিত করে। একটি দল যদি মনে করে তাদের সাফল্য মানে হচ্ছে ঘাট-বাজার দখল, তবে তা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ, জনগণ দীর্ঘ মেয়াদে এমন রাজনীতির প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। আবার একই সঙ্গে বিএনপির নেতারাই স্বীকার করছেন যে জামায়াত তাঁদের চেয়ে বেশি সংগঠিত। অথচ বিএনপি অতীতে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে বারবার রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। এই জোটের রাজনীতি বিএনপিকে স্বল্প মেয়াদে ক্ষমতায় সাহায্য করেছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে। জনগণের কাছে বিএনপি হয়ে গেছে ‘ক্ষমতাসীন দখলদার গোষ্ঠী’ এবং জামায়াত হয়ে গেছে ‘চুপচাপ কাজ করা সুসংগঠিত শক্তি’।
এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দাঁড়ায়: কেন বিএনপি জামায়াতের মতো সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি? বিএনপির নেতৃত্বে দীর্ঘদিন পরিবারতন্ত্র ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ছিল প্রবল, ফলে দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা হয়নি। এই কারণে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে সব সময় ভঙ্গুর থেকেছে।
অন্যদিকে জামায়াতের আদর্শিক ভিত্তি স্পষ্ট—তারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। অন্তত সংগঠনের মধ্যে একটি লক্ষ্য রয়েছে, যা অনুসারীদের প্রেরণা জোগায়। ছাত্রশিবির
থেকে শুরু করে মূল দলে পর্যন্ত প্রত্যেকেই জানে তারা কী চায়। এর সঙ্গে মসজিদ-মাদ্রাসাভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক যোগ হয়ে তাদের প্রভাব স্থায়ী করেছে। বিএনপির পক্ষে এমন কোনো নেটওয়ার্ক তৈরি সম্ভব হয়নি।
আলতাফ হোসেনের বক্তব্য আসলে বিএনপিকে একটি সতর্কসংকেত দিয়েছে। যদি তারা সত্যিই ভবিষ্যতের রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়, তবে শুধু দখল নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তাদের প্রয়োজন সাংগঠনিক সংস্কার, তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব গড়ে তোলা, গণসংগঠনকে সক্রিয় করা এবং একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করা। অন্যথায় তারা হয়তো স্বল্প মেয়াদে আন্দোলন করতে পারবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এ ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। দখলের রাজনীতি কখনোই টেকসই হয় না। ঘাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ করে একটি দল সাময়িকভাবে প্রভাবশালী হতে পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত বা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিই দীর্ঘ মেয়াদে সমাজকে প্রভাবিত করে। বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই দখল সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা এবং একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। অন্যথায় ইতিহাস তাদেরও শুধু একধরনের ‘অস্থায়ী দখলদার’ হিসেবে চিহ্নিত করবে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরীর একটি বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতূহল জাগিয়েছে। দলের মধ্যে তৈরি করেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তিনি দলীয় এক সমাবেশে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলেছেন, বিএনপি দখল করছে লঞ্চঘাট-বাসস্ট্যান্ড আর জামায়াত দখল করছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই কথাগুলো আপাতদৃষ্টিতে মজা বা রসিকতা মনে হলেও আসলে এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গভীর অসুস্থ চিত্র। মুখে কেউ স্বীকার না করলেও ‘দখল’ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বলা হয়ে থাকে, এখানে দুই ধরনের ‘দখল রাজনীতি’ চলছে। একদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতা, অর্থনীতি ও স্থানীয় আধিপত্যের জায়গা নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াত ধীরে ধীরে দখল করেছে শিক্ষাঙ্গন, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়। এ দুই ধরনের দখল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভবিষ্যতের ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলছে।
বিএনপির যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, তা অনেকাংশেই প্রতিফলিত করে দলে সংগঠনগত দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেছিলেন একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর অস্থির সময়টাতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে জন্ম নেওয়া এই দলটি শুরু থেকেই প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক শক্তিনির্ভর রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। তাই বিএনপির মধ্যে মাঠপর্যায়ের সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার সংস্কৃতি কখনোই গভীর হয়নি। যখন তারা ক্ষমতায় গেছে, তখনো স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ মূলত ক্ষমতা ব্যবহার করে জমি-বাড়ি দখল, ঘাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ, কন্ট্রাক্ট আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছেন। এই প্রক্রিয়া এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে দলীয় রাজনীতি এখানে ‘সেবা’ নয় বরং ‘দখল ও ভাগাভাগির’ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। তারা ধীরে ধীরে সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করতে থাকে। জামায়াতের কৌশল ছিল দীর্ঘমেয়াদি—প্রথমেই তারা শক্তি ঢেলে দেয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাব বিস্তারে। শিক্ষক নিয়োগ, সিন্ডিকেট নির্বাচন, হল-হোস্টেল দখল এবং ইসলামি আদর্শের প্রচারের মাধ্যমে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। শুধু তা-ই নয়, তারা আইনি কাঠামোর ভেতরেও জায়গা করে নেয়, যেমন আদালত, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থায় নিজেদের অনুসারীদের বসিয়ে দিয়ে। এভাবে জামায়াতের দখল ছিল ‘মস্তিষ্কের জায়গা’, যেখানে নীতি, সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা তৈরি হয়। এই দখলপদ্ধতি অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর।
আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বক্তব্যে এই দুই ধরনের দখলের পার্থক্য স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বিএনপি যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আটকে আছে তা হলো শর্টকাট, তাৎক্ষণিক এবং ভোগবাদী মনোভাব। একজন স্থানীয় নেতা যদি বাসস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে তবে তিনি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবেন, কিছু অনুসারীকে খাওয়াতে পারবেন এবং নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারবেন। কিন্তু এই কৌশল স্থায়ী কোনো সাংগঠনিক শক্তি তৈরি করে না। অন্যদিকে জামায়াতের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ মানে হলো তারা আগামী প্রজন্মের শিক্ষক, প্রশাসক, বিচারক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের মতাদর্শ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে জামায়াত ক্ষমতায় না থেকেও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিফলন। ক্ষমতার বাইরে ১৭ বছর কাটানোর পরও বিএনপি এখনো একটি শক্তিশালী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ।
বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা একে সংগঠিত শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেনি। ২০২২-২৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে বিএনপি দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামাতে পেরেছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল খণ্ডিত, কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বহীন এবং তৃণমূলভিত্তিক স্থায়ী শক্তিতে রূপান্তরহীন। অথচ একই সময়ে জামায়াত কম দৃশ্যমান হলেও সাংগঠনিকভাবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বজায় রেখেছে।
এখানে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনা জরুরি। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিএনপি ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় স্তরে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, মতাদর্শভিত্তিক চর্চা কিংবা গণসংগঠন তৈরির চেষ্টা তেমন হয়নি। ফলে বিএনপি সব সময় ক্ষমতার বাইরে এলে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিপরীতে জামায়াত সাংগঠনিকভাবে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে। এর কারণ হলো, তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ‘আইডিয়োলজিক্যাল’ রাজনীতির চর্চা। তারা জানে ক্ষমতা শুধু প্রশাসনিক চেয়ারে নয়, বরং মানুষের মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তারের মধ্যেই নিহিত।
আলতাফ চৌধুরীর বক্তব্য বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকটও উন্মোচিত করে। একটি দল যদি মনে করে তাদের সাফল্য মানে হচ্ছে ঘাট-বাজার দখল, তবে তা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ, জনগণ দীর্ঘ মেয়াদে এমন রাজনীতির প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। আবার একই সঙ্গে বিএনপির নেতারাই স্বীকার করছেন যে জামায়াত তাঁদের চেয়ে বেশি সংগঠিত। অথচ বিএনপি অতীতে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে বারবার রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। এই জোটের রাজনীতি বিএনপিকে স্বল্প মেয়াদে ক্ষমতায় সাহায্য করেছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে। জনগণের কাছে বিএনপি হয়ে গেছে ‘ক্ষমতাসীন দখলদার গোষ্ঠী’ এবং জামায়াত হয়ে গেছে ‘চুপচাপ কাজ করা সুসংগঠিত শক্তি’।
এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দাঁড়ায়: কেন বিএনপি জামায়াতের মতো সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি? বিএনপির নেতৃত্বে দীর্ঘদিন পরিবারতন্ত্র ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ছিল প্রবল, ফলে দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা হয়নি। এই কারণে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে সব সময় ভঙ্গুর থেকেছে।
অন্যদিকে জামায়াতের আদর্শিক ভিত্তি স্পষ্ট—তারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। অন্তত সংগঠনের মধ্যে একটি লক্ষ্য রয়েছে, যা অনুসারীদের প্রেরণা জোগায়। ছাত্রশিবির
থেকে শুরু করে মূল দলে পর্যন্ত প্রত্যেকেই জানে তারা কী চায়। এর সঙ্গে মসজিদ-মাদ্রাসাভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক যোগ হয়ে তাদের প্রভাব স্থায়ী করেছে। বিএনপির পক্ষে এমন কোনো নেটওয়ার্ক তৈরি সম্ভব হয়নি।
আলতাফ হোসেনের বক্তব্য আসলে বিএনপিকে একটি সতর্কসংকেত দিয়েছে। যদি তারা সত্যিই ভবিষ্যতের রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়, তবে শুধু দখল নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তাদের প্রয়োজন সাংগঠনিক সংস্কার, তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব গড়ে তোলা, গণসংগঠনকে সক্রিয় করা এবং একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করা। অন্যথায় তারা হয়তো স্বল্প মেয়াদে আন্দোলন করতে পারবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এ ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। দখলের রাজনীতি কখনোই টেকসই হয় না। ঘাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ করে একটি দল সাময়িকভাবে প্রভাবশালী হতে পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত বা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিই দীর্ঘ মেয়াদে সমাজকে প্রভাবিত করে। বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই দখল সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা এবং একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। অন্যথায় ইতিহাস তাদেরও শুধু একধরনের ‘অস্থায়ী দখলদার’ হিসেবে চিহ্নিত করবে।
কৈশোরে একবার পড়েছিলাম, ফাঁসির দড়ি তৈরি হয় ‘ম্যানিলা রোপ’ দিয়ে। তখন বুঝতাম না ‘ম্যানিলা’ কী! পরে জেনেছি, ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকেই এই বিশেষ দড়ির নামকরণ। ‘ম্যানিলা রোপ’ তৈরি হয় অ্যাবাকা নামের কলাগাছ-জাতীয় এক উদ্ভিদ থেকে। গাছের তন্তু থেকে তৈরি হয় দড়ি, কাপড়, কারুপণ্য, এমনকি বস্তাও। কোমল অথচ টেকস
২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা যেন একটি বেনারসি শাড়ির আঁচল, যার এক প্রান্তে সোনালি জরির কাজ আর অন্য প্রান্তে গলিত সুতোয় দাগ পড়া দারিদ্র্যের ছাপ। একই চাদরে ঢাকা দুটি পৃথিবী, যার একটি অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যস্ত এবং অন্যটি বিলাসিতায় গা ভাসানোর মতো। একদিকে বৈভবের বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে প্রয়োজনের হাহাকার।
২ ঘণ্টা আগেকয়েক দিন ধরেই সিলেটে পাথর লুটের খবর প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রে। আজকের পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি বিশদ সংবাদ ছাপা হয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ৩৫ জন নেতা এই লুটপাটে তৎপর। এদের অবৈধ কর্মকাণ্ডে আইনি বাধা দেওয়া হলে তাঁরা কি এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতেন?
২ ঘণ্টা আগেআগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচিত সরকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে দেশ পরিচালনা করবে—এ রকম বিশ্বাস নানা কারণেই দোদুল্যমান হয়ে উঠছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন শর্ত আরোপ করায় নির্বাচন নিয়ে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
১ দিন আগে