আব্দুর রাজ্জাক
একাত্তরে আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের কোনো এক সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের থানা বরিশালের বানারীপাড়াও আক্রমণ করবে বলে খবর রটে গেল। ঐতিহ্যগতভাবে সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল, বসতিও কিছুটা বেশি ছিল।
দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। আমাদের বড় ভাই শাহ আলম ঢালী বানারীপাড়ার স্বনামধন্য ডাক্তার লক্ষ্মীবাবুর পাঁচজনের একটি পরিবারকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। আমাদের বিশাল বাড়ির ছয়টি ঘরের একটিতে তারা আশ্রয় নিল।
দীর্ঘ নয় মাস আমাদের বাড়িতে নির্ভয়ে এই পরিবারটি ছিল। আমাদের ইউনিয়নের বহু বাড়ি এ রকম হিন্দু পরিবারকে আপন করে আশ্রয় দিয়েছিল। মনে হতো, ওরা আমাদের পরম আত্মীয়। আসলে আমরা তো দেখতে-শুনতে, চলনে-বলনে একই রকম মানুষ। নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে মানুষ ধর্ম পালন করে। কিন্তু একই সমাজের এই মানুষগুলো বিভাজিত কেন? এটা হতে পারে না—তখন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে এই বিশ্বাস ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনী এই সংখ্যালঘু মানুষদের শত্রু মনে করল। সঙ্গে তাদের দোসর এ দেশের কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার তাদের সহযোগী হলো। সংখ্যালঘু পরিবারের সম্পত্তিকে গনিমতের মাল হিসেবে ঘোষণা করে লুটপাট করল। তবে বেশির ভাগ মানুষ এসব পরিবারকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।
সংহতির কারণ ছিল সত্তরের নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মূলমন্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা বেশির ভাগ মানুষের মনে প্রোথিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে অন্তত এই আমরা তখন সংখ্যালঘুদের আগলে রেখেছিলাম।
পঁচাত্তরের পর দেশ মৌলবাদের দিকে ধাবিত হয়। একাত্তরের পরাজিত সেই সময়ের কিছু রাজাকার ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যায়। বঙ্গবন্ধু যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়ে এই ভূখণ্ডে ধর্মনিরপেক্ষতা এনেছিলেন, সেখানে সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মকে পুঁজি করে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লালনপালন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে জাতিকে দূরে
নিয়ে যায়।
স্কুলে আমাদের সহপাঠী ছিল তুলসী শীল, নারায়ণ শীল, গীতা রানী পাল, দুলাল বাড়ৈসহ আরও অনেকে। পঁচাত্তরের পর গ্রাম থেকে কোনো এক রাতের আঁধারে ভারতে চলে যায় তারা। ওই বন্ধুদের জন্য এখনো মন কাঁদে। নিশ্চয়ই আমাদের লোভ-লালসা, ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে তুলসী-নারায়ণরা আমাদের গ্রাম থেকে সরে পড়েছে।
বর্তমান সময়ে যা ঘটছে, অনেকে এটাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে অবহিত করেছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। দাঙ্গা হয় দুই পক্ষ যদি সংঘর্ষে জড়ায়। এখানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা একটু শক্তিশালী, তারা একতরফাভাবে সম্পদ লুট করার জন্য, জায়গা-জমি দখল করার জন্য সম্মিলিতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বানারীপাড়া, উজিরপুর, আগৈলঝাড়া, গৌরনদীতে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন হয়। ওই অঞ্চলের অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অন্য জেলায় আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ পালিয়ে ভারতে চলে যায়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে একটি কমিশন গঠন করে। ২০০১ সালের সেই ঘটনার স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করে। রিপোর্ট দেওয়া হয়, কিন্তু বিচার হয়নি। আমি এলাকায় গিয়ে দেখি যারা অত্যাচার করেছিল, তারা বহাল তবিয়তে স্বপদে আছে। কেউ কেউ খোলস পাল্টিয়ে মুজিব কোট পরেছে।
সেই ঘটনার বিচার হলে আজকের এ ঘটনা ঘটত না। বর্তমানের এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে, এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
আজ যেন সর্বমহল থেকে সোচ্চার দাবি ওঠে। সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো করুণা নয়, তারা এ দেশের নাগরিক। তারা সমান অধিকার নিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে বাস করবে। এককথায়, বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা বিশ্বাস করে মেনে চলতে হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের আশা। তবে তৃতীয় কোনো অদৃশ্য শক্তি যদি এসব সাম্প্রদায়িক কাণ্ড ঘটিয়ে নিজেরা লাভবান হতে চায়—দিন শেষে তাদেরই চরম ক্ষতি হবে।
একাত্তরে আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের কোনো এক সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের থানা বরিশালের বানারীপাড়াও আক্রমণ করবে বলে খবর রটে গেল। ঐতিহ্যগতভাবে সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল, বসতিও কিছুটা বেশি ছিল।
দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। আমাদের বড় ভাই শাহ আলম ঢালী বানারীপাড়ার স্বনামধন্য ডাক্তার লক্ষ্মীবাবুর পাঁচজনের একটি পরিবারকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। আমাদের বিশাল বাড়ির ছয়টি ঘরের একটিতে তারা আশ্রয় নিল।
দীর্ঘ নয় মাস আমাদের বাড়িতে নির্ভয়ে এই পরিবারটি ছিল। আমাদের ইউনিয়নের বহু বাড়ি এ রকম হিন্দু পরিবারকে আপন করে আশ্রয় দিয়েছিল। মনে হতো, ওরা আমাদের পরম আত্মীয়। আসলে আমরা তো দেখতে-শুনতে, চলনে-বলনে একই রকম মানুষ। নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে মানুষ ধর্ম পালন করে। কিন্তু একই সমাজের এই মানুষগুলো বিভাজিত কেন? এটা হতে পারে না—তখন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে এই বিশ্বাস ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনী এই সংখ্যালঘু মানুষদের শত্রু মনে করল। সঙ্গে তাদের দোসর এ দেশের কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার তাদের সহযোগী হলো। সংখ্যালঘু পরিবারের সম্পত্তিকে গনিমতের মাল হিসেবে ঘোষণা করে লুটপাট করল। তবে বেশির ভাগ মানুষ এসব পরিবারকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।
সংহতির কারণ ছিল সত্তরের নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মূলমন্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা বেশির ভাগ মানুষের মনে প্রোথিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে অন্তত এই আমরা তখন সংখ্যালঘুদের আগলে রেখেছিলাম।
পঁচাত্তরের পর দেশ মৌলবাদের দিকে ধাবিত হয়। একাত্তরের পরাজিত সেই সময়ের কিছু রাজাকার ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যায়। বঙ্গবন্ধু যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়ে এই ভূখণ্ডে ধর্মনিরপেক্ষতা এনেছিলেন, সেখানে সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মকে পুঁজি করে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লালনপালন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে জাতিকে দূরে
নিয়ে যায়।
স্কুলে আমাদের সহপাঠী ছিল তুলসী শীল, নারায়ণ শীল, গীতা রানী পাল, দুলাল বাড়ৈসহ আরও অনেকে। পঁচাত্তরের পর গ্রাম থেকে কোনো এক রাতের আঁধারে ভারতে চলে যায় তারা। ওই বন্ধুদের জন্য এখনো মন কাঁদে। নিশ্চয়ই আমাদের লোভ-লালসা, ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে তুলসী-নারায়ণরা আমাদের গ্রাম থেকে সরে পড়েছে।
বর্তমান সময়ে যা ঘটছে, অনেকে এটাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে অবহিত করেছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। দাঙ্গা হয় দুই পক্ষ যদি সংঘর্ষে জড়ায়। এখানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা একটু শক্তিশালী, তারা একতরফাভাবে সম্পদ লুট করার জন্য, জায়গা-জমি দখল করার জন্য সম্মিলিতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বানারীপাড়া, উজিরপুর, আগৈলঝাড়া, গৌরনদীতে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন হয়। ওই অঞ্চলের অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অন্য জেলায় আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ পালিয়ে ভারতে চলে যায়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে একটি কমিশন গঠন করে। ২০০১ সালের সেই ঘটনার স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করে। রিপোর্ট দেওয়া হয়, কিন্তু বিচার হয়নি। আমি এলাকায় গিয়ে দেখি যারা অত্যাচার করেছিল, তারা বহাল তবিয়তে স্বপদে আছে। কেউ কেউ খোলস পাল্টিয়ে মুজিব কোট পরেছে।
সেই ঘটনার বিচার হলে আজকের এ ঘটনা ঘটত না। বর্তমানের এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে, এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
আজ যেন সর্বমহল থেকে সোচ্চার দাবি ওঠে। সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো করুণা নয়, তারা এ দেশের নাগরিক। তারা সমান অধিকার নিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে বাস করবে। এককথায়, বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা বিশ্বাস করে মেনে চলতে হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের আশা। তবে তৃতীয় কোনো অদৃশ্য শক্তি যদি এসব সাম্প্রদায়িক কাণ্ড ঘটিয়ে নিজেরা লাভবান হতে চায়—দিন শেষে তাদেরই চরম ক্ষতি হবে।
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ সরগরম। একাধিক প্যানেল, অসংখ্য পোস্টার, ব্যানার ও স্লোগানে মুখরিত ক্যাম্পাস। দীর্ঘদিন অবহেলিত এই কেন্দ্রীয় সংসদকে শিক্ষার্থীরা আবার আলোচনায় টেনে এনেছেন, আবারও সামনে এসেছে জাতীয় রাজনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব। আসলে ডাকসুর নাম এলেই চোখে ভেসে ওঠে এর গৌরবোজ্জ্বল..
১৭ ঘণ্টা আগেযে বিষয়ে আজ লিখব বলে ভাবছি, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সামান্য, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তবু দুই দিন যাবৎ মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে। বলে রাখা ভালো, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত আমি মাদ্রাসায় পড়েছি। আমার বড় চাচা ছিলেন একজন ইসলামিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ।
১৮ ঘণ্টা আগেভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এক নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ তুলে এক নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে, চুল কেটে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। আর এই অপকর্মে নেতৃত্ব দিয়েছেন এক বিএনপি নেতা!
১৮ ঘণ্টা আগেমুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেই আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টের ‘দোসর’ তকমা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা তো বটেই, কখনো কখনো ব্যক্তি বা জনসমষ্টির ওপর সরাসরি আক্রমণের ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। একই রকমভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিশেষ মতবাদের বিপক্ষের ব্যক্তি-গোষ্ঠী এবং নারীসমাজসহ ধর্মীয়...
২ দিন আগে