Ajker Patrika

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল: রাজকীয় অপারেটরেও কাটছে না গরিবি হাল

  • নিয়োগের ১৫ মাসেও প্রয়োজনীয় যন্ত্র-সরঞ্জাম আনতে পারেনি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল।
  • অপারেটরটির অদক্ষতায় এলসিএল কনটেইনার আনস্টাফিং ও এফসিএল কনটেইনার ডেলিভারি বিলম্বিত হচ্ছে।
 আবু বকর ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। ছবি: আজকের পত্রিকা
চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। ছবি: আজকের পত্রিকা

চট্টগ্রাম বন্দরে কাজের গতি বাড়াতে ২২ বছরের জন্য পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সৌদি আরবের ‘রাজকীয়’ অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে (আরএসজিটিআই)। কিন্তু নিয়োগের ১৫ মাসেও রাজকীয় এই বিদেশি অপারেটরের গরিবি হাল কাটছে না। প্রতিষ্ঠানটি এখনো পণ্য খালাসের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারেনি। স্ক্যানার, গ্যান্ট্রি ক্রেন, রাবার গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্র-সরঞ্জাম না থাকায় প্রত্যাশিত কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারছে না বিদেশি অপারেটরটি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব যন্ত্র-সরঞ্জাম আসতে আরও এক-দুই মাস সময় লাগবে। ফলে শিগগিরই গতি ফিরছে না পিসিটিতে।

গত বছরের ১১ জুন পিসিটি পরিচালনার জন্য আরএসজিটিআইকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা উন্নত প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে—এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু ১৫ মাসেও সেই প্রত্যাশার ধারেকাছে যেতে পারেনি বিদেশি অপারেটরটি। তাদের এই অক্ষমতার কারণে ভুগতে হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ অন্যদের।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি অপারেটরটির নানা ঘাটতি তুলে ধরে গত রোববার চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। এতে বলা হয়, অপারেশনাল কার্যক্রমে বিদেশি অপারেটরটির অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে এলসিএল কনটেইনার আনস্টাফিং এবং এফসিএল কনটেইনার ডেলিভারির কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিলম্বিত হচ্ছে। এতে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চিঠিতে ছয়টি সমস্যার কথা তুলে ধরে বলা হয়, পিটিসিতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কনটেইনার রাখার কারণে মারাত্মক কনটেইনার জট সৃষ্টি হচ্ছে। এলসিএল কনটেইনার আনস্টাফিং এবং এফসিএল কনটেইনার ডেলিভারির কার্যক্রম অত্যধিক বিলম্বিত হচ্ছে। এতে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আমদানি কাঁচামাল যথাসময়ে কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না, ফলে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য উৎপাদন। পিটিসিতে পর্যাপ্ত ও উন্নতমানের ইকুইপমেন্ট না থাকায় আমদানি পণ্য খালাসে বিলম্ব হচ্ছে।

কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আরও জানায়, পিটিসিতে অদক্ষ অপারেটরের মাধ্যমে ইকুইপমেন্ট পরিচালনা করা হচ্ছে, এতে প্রায় সময় পণ্য নষ্ট হয়। তাদের কাজে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করা প্রয়োজন।

পণ্য লোডিং-আনলোডিং কাজে অদক্ষ ও অপর্যাপ্ত শ্রমিক নিয়োগের দাবিও তুলেছে কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। তারা বলেছে, অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ হওয়ায় লোডিং-আনলোডিং কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমসবিষয়ক সম্পাদক মো. রেজাউল করিম স্বপন জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের জন্য বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হস্তান্তরের ১৫ মাসেও তারা ইকুইপমেন্ট সংযোজন করতে পারেনি।

বন্দর সূত্র জানায়, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের এ টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বছরে ৫ লাখ টিইইউস। বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে বিপুল অর্থ খরচ করে তৈরি করা এই টার্মিনালের সক্ষমতার বড় অংশ অলস বসে রাখার ফলে হাজার কোটি টাকা রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ব্যবস্থার অধীনে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে ‘ইকুইপ, অপারেট অ্যান্ড মেইনটেইন’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার অনেক আগেই বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তা এমন চুক্তির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তারপরও প্রভাবশালী মহলের চাপেই তড়িঘড়ি করে আরএসজিটিআইকে বিদেশি অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০২২ সালের জুলাই মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরপরই সিপিএ পতেঙ্গা টার্মিনালের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে বছরের নভেম্বরে মিয়ানমার থেকে চালবোঝাই জাহাজের বার্থিং এবং পরের বছর জানুয়ারিতে আরেকটি জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে সফল ট্রায়াল অপারেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালটির নিজস্ব পরিচালনার সক্ষমতার প্রমাণ দেয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা যায়, বন্দর কর্তৃপক্ষ টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য প্রায় ৪৬০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কিনতে হতো, যা টার্মিনালের এক বছরের আয় থেকেই ফেরত পাওয়া যেত। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পতেঙ্গা টার্মিনালের জন্য একটি বিদেশি অপারেটর নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালের কার্যক্রম ২২ বছরের জন্য আরএসজিটিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বন্দর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার জন্য আরএসজিটিআই ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে, এমন কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই অর্থ বিনিয়োগ করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত রোববার পতেঙ্গা টার্মিনালের একটি সভা হয়েছে, এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতি আনতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর আর কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই আগামী ২২ বছর ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জনের আশা করছে। তিনি আরও বলেন, তা ছাড়া সৌদি আরব ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত